somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ রোদ

১৭ ই জুন, ২০১২ সকাল ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
নিউজ ফ্ল্যাশ...
কে বা কারা ঘুম ভেঙ্গে উঠেই আজকের রৌদ্রজ্জল সকালটিকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।

আলসে অথবা দেরীতে ঘুমাতে যাওয়া নাগরিকেরা অবশ্য জেগে উঠেই খানিক বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো, অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে তারা বড্ড বেশী ঘুমিয়ে ফেলেছে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ক্ষুধার্ত চোখে গিলে নিচ্ছিলো এই অদ্ভুত একটা দিন। অবশ্য কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন সৌন্দর্যপিপাসু, প্রলাপ বকে যাচ্ছিলো এই বলে যে ছায়াবৃত শহরের সেই হারিয়ে যাওয়া লাবণ্য কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে। আমরা কিছু সচেতনদের দেখেছিলাম ছাতা নিয়ে রাস্তায় বেরোতে, এই নিয়ে অবশ্য একচোট হেসেছিলো কেউ কেউ। খবরের শিরোনাম বাতলে যাচ্ছিলো, ক্ষতবিক্ষত লাশটা খুঁজে পাওয়া গেছে এক পরিত্যক্ত ডাস্টবিনের গোড়ায়, প্রথমে সেটাকে অবশ্য কোন কুকুরের মৃতদেহ বলে ভুল করেছিলো ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরা এক নাইটগার্ড। আরো জানা গেলো যে, শোকাভিভূত সুর্য সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোর প্রতিবাদ জানিয়েছে এই নৃশংসতার। প্রতিবাদস্বরুপ পরবর্তী দিনে মামা ঘন্টাখানেক পরে উদয় হবেন বলে হুমকিও দিয়েছেন। অবশ্য ছোটোখাটো একটা ঝামেলা বেঁধে গেলো যখন প্রতিবেদক পরবর্তী দৃশ্যে এক মাঝবয়েসী গৃহিণীকে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বললেন,
"ডিমের দাম বেড়ে গেছে ভীষণ!"

উত্তর শুনে প্রতিবেদক সশব্দে খাবি খেলেন।
তবে কিছুক্ষণ পরেই শহরের টোকাই সংঘের মুখপাত্র এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনদিনব্যাপী ধর্মঘটের প্রতিজ্ঞা জানিয়ে দিলে সেই গৃহিণীর নির্বুদ্ধিতাটুকু ভুলে গেলেন প্রায় সবাই।


২.
খানিক ভিন্ন একটা সংবাদ দেয়া যাক,
খুব সম্প্রতি শহরের শেষ প্রান্তে একটি ঘোলাটে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। তারুণ্যের সস্তাদর, কোলাহল, যান্ত্রিকতা এবং ধুলোবালিতে নাভিশ্বাস উঠলে অবশেষে কর্মক্ষেত্রে পদত্যাগপত্রটা জমা দিয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেই কেটে পড়বার। প্রথম দর্শনেই নতুন আবাসটি পছন্দ হয়ে উঠেছিলো। প্রয়াত বাড়িওয়ালা বেঁচে থাকতে সম্ভবত সৌখিন ছিলো বেশ, সদর দরজা এবং সিঁড়িতে ভারী কাঠের রেলিং দেখে সেইরকম আভাসই পেয়েছি। এমনকী বছর পুরনো দেয়ালের ময়লা দাগের আঁকিবুকি দেখে দেখে দিব্যি কয় হপ্তা পার করে দেয়া যাবে এমনটা ভেবেও কিছুটা আনন্দিত ছিলাম। তবে আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই একটা জানালা। দশ ফুট চওড়া এই জানালা দিয়ে প্রয়োজনের চাইতেও বেশি আলো ঢুকে পড়ে, আমি ভারী ভারী সব পর্দা এঁটেও কুলিয়ে উঠতে পারি নি। তবে কখনও দরকার পড়ে জানালাটার। বাসার কাছাকাছি একটা জীর্ণ এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে, যেখান থেকে প্রত্যহ দুটো ডানাওয়ালা ডলফিন ওড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মাঝে মধ্যে আমি ওদের চকচকে উড়ন্ত পেট দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

মাঝেসাঝেই ক্ষেপণযোগ্য কোন অস্ত্রের অভাব অনুভূত হয়।



৩.
চোখ আটকে গেলো নিউজ চ্যানেলে। শিরোনামে দেখাচ্ছে পুলিশ কিছু সূত্র পেয়েছে এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে। টাকমাথার উর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা কষ্টেসৃষ্টে প্রমিত বাংলায় সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচ্ছিলো। জানা গেলো, তদন্ত বেশ কিছুদুর এগিয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের তালিকা ছোট হয়ে আসছে প্রতিদিনই। টিভি বরাবর তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দেই, যেহেতু ওদের অপদার্থতায় আমার প্রবল বিশ্বাস রয়েছে।

তখনই, দরজায় টোকার আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠি। আন্দাজ করতে পারছি না কে হতে পারে। দরজা খুলে দিলে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন মানুষকে দেখলাম। খানিক লম্বা বিষণ্ণ চেহারার একজন কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই আমাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লো রুমের ভেতরে। আমি সতর্ক হয়ে উঠি, আমার শঙ্কিত চেহারা দেখে অন্যজন চকচকে একটা হাসি দিয়ে বললো, "ভয়ের কিছু নেই।" লম্বা লোকটা এগিয়ে গেলো জানালাটার দিকে। পর্দা একটানে সরিয়ে দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো খানিক। সামলে উঠে প্রশ্ন করি,
"আপনারা কারা?"
"সেটা জানার দরকার নেই।" মুখে হাসি লেগে রয়েছে তখনও। "বেশ বড়, তাই না?" জানালার পাশ থেকে বলে ওঠে অন্যজন। আমি ভদ্রগোছের হাসি দেই মাথা নেড়ে। "খুলে রাখলে দিনের বেলা প্রচুর আলো ঢোকে...।" আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করতে থাকি লোক দু'টোকে, পুলিশের কেউ হবে কি? কিন্তু ওতে দুঃশ্চিন্তা কমে যাবার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না।

"কোনরকম আইডেন্টিফিকেশন দেখানো যাবে?" বলে ছোটোখাটো লোকটা। আমি পিছিয়ে টেবিলের উপর থেকে মানিব্যাগ খুঁজে নেই, সেটা খুলে পরিচয়পত্রটি বের করে আনি। কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে বেঁটে লোকটা প্রশ্ন করলো, "এই এলাকায় আছেন কতদিন ধরে?"
"বেশিদিন নয়।" এরপরে বুঝিয়ে বলি কেন এই এলাকায় আসতে হয়েছে আমাকে। কিছুদুর বলতেই খুব দ্রুত উৎসাহ হারিয়ে ফেললো বিষণ্ণমুখের লোকটা। রাস্তাঘাটের ধুলোয় হাঁচি দেবার কথা শুনতে যায় না কেউই। ওরা চলে যাবার আগে আমাকে বলে গেলো যে শহরের বাইরে আমি যেনো পরবর্তী কিছুদিন না যাই, তেমনকিছু নয়, শুধুমাত্র তদন্তের সুবিধার্থে। আমি হাসতে থাকি আপনমনে, শহর ছেড়ে যাবার ইচ্ছেটা যে বহুদিনের!



তিনদিন পরে,
ঘরে আটকা পড়া আলস্যের বোঁটকা গন্ধটা বের করে দিতে পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিতে গেলাম, অত্যুজ্জ্বল একটা দিন। তখনই পাশের ছাদে কিছু একটা চোখে পড়লো। ভীষণ রোদে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, বাঁ হাতে ধরা চকচকে একটা ছোরা। আঁতকে উঠে দ্রুত পর্দা ঢেকে দিয়ে হেলান দিলাম দেয়ালে। সন্দেহভাজনদের তালিকায় নাম উঠবার কারণটা পরিষ্কার হলো শেষ পর্যন্ত।

কিছুক্ষণ পর পর ডলফিনদের একটাকে উড়ে যেতে শোনা গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলি, দেখা হচ্ছে না আজ ওদের।
হ্যাঁ, অবশেষে সময় হয়েছে এই শহর ছেড়ে যাবার।





১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২[রোদ]
৪৫৬ বার পঠিত
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×