এই স্যাঁতসেঁতে কুৎসিত গলিটাকে আমি ঘৃণা করি ভীষণরকম।
প্রতি সন্ধ্যায় একেকটা ক্লান্তিকর দিনশেষে আমি যখন আমার ফ্ল্যাট নামক কবুতরের খোপে ফিরে আসি, আমাকে এই অন্ধকার গলিটা পার করে যেতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে এই গলিটার বিশেষত্ব কি? আমি উত্তর দেব এইভাবে,
দুর্গন্ধময়, কর্কশ, অন্ধকার এই শহরের প্রায় সমস্ত কদর্যতার খানিক প্রতিনিধিত্ব করা এই সংকীর্ণ রাস্তাটা আশ্রয় দ্যায় একজন অনিয়মিত ভিক্ষুক, দুটো উপচে পড়া ডাস্টবিন, দুপাশে ঝুলে থাকা দালানগুলোর নির্বোধ ছায়া আর একটা পানের দোকানকে। দৈর্ঘ্যটা অনেক সংক্ষিপ্ত; তারপরেও প্রতি সন্ধ্যায় যখন আমি বাসায় ফিরি প্রায় নির্জীব দেহে, কেন জানি ব্ল্যাকম্যাজিকের মতোন আমার সকল প্রাণশক্তি উবে যায় গলিটাতে পা দেয়া মাত্র। চারপাশের দুর্গন্ধ তেড়েফুঁড়ে আমার চেতনায় আক্রমণ চালিয়ে সারাদিনে জমা সবগুলো কবিতার লাইন শিরীষ কাগজে ঘষে উপড়ে ফ্যালে। ঘরে ফিরে প্রেয়সীর সুরেলা কন্ঠ দুরালাপে শোনার ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারে। ঘর্মাক্ত শার্টের কলার সহসা যেনো লাস্যময়ী ফাঁস হয়ে ওঠে নিপুণভাবে। এইভাবে সবকিছু ঘটতে থাকলে আমার কখনোও ঘরে ফেরা সম্ভব হবার কথা নয়। তবুও আমি দিব্যি বেঁচে আছি অর্ধমৃত, কারণ...
একটা ঘেয়ো কুকুর।
আমি নিশ্চিত ব্যাটা সচেতনভাবেই আমাকে পথ দেখায় সেই গলিটাতে। আন্দাজ করে নিয়েছি এই কুকুরটা আমার সেই প্রথম আছাড় খাওয়া কবিতার কুকুরটা হবে হয়ত। ছাপার অক্ষর জ্যান্ত হয়ে লেখককে বাঁচাতে এসেছে, এমনটা ভাবা দোষের কিছু নয়। জন্তুটার গলায় একটা ঘণ্টা বাঁধা থাকে, ওরই শব্দ আমি অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে যাই প্রতি সন্ধ্যায়। অথচ আমার মনে নেই কবিতার কুকুরটার গলায় কোন ঘণ্টা বেঁধেছিলাম কিনা।
তারপরও...
এটা স্থায়ী সমাধান নয় মোটেও। ইদানীং আমার প্রতিটা পুরনো লেখার কালি ঝাপসা হয়ে আসছে খুব দ্রুত, আয়ু কমে আসছে কুকুরটার একইসাথে হয়ত। আমার পথপ্রদর্শকের অনুপস্থিতিতে খুব সহজেই গর্তে ডুবে যাবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। ফলাফল, আমি চিরকালের মতো এই অন্ধকারে আটকা পড়তে পারি; বদলে যেতে পারি অন্যসব নিস্কম্প শহুরে ছায়াতে। তাই একটা দুর্দান্ত পরিকল্পনা নিয়ে আমি এই গলিমুখে হাজির আজ। সন্ধ্যেটাকে টপকে রাত্রিকালীন আক্রমণের পাঁয়তারা করেছি...
পরিকল্পনামাফিক দুবার শিষ দিলাম। লেজ নাড়তে নাড়তে ভেতর থেকে ছুটে এলো কুকুরটা। আমাকে ঘিরে পাক খেতে লাগলো। গলায় হাত বুলিয়ে খানিক আদর করে দিলাম। হাতে ময়লা লেগে গ্যালো খানিক, তা লাগুক। খুলে নিতে গেলাম ঘণ্টাটা, "কাঁই" শব্দে আপত্তি জানালো সে। একরাশ দ্বিধা নিয়ে তাকালো আমার দিকে,
"টেনশান নিস না ব্যাটা, চেষ্টা করে দেখি চল।" হয়ত আমার লেখাগুলোর মতোই ঝাপসা আর দুর্বল হয়ে গেছে কুকুরটা, তাই সহজেই এই দুঃসাহসিক প্রস্তাবে সায় দিল সে।
ঘণ্টাটা খুলে নিলাম।
অমনি গলির ভেতরে হিসিয়ে উঠলো অন্ধকার।
ডানা ঝাপটে মুহুর্তেই গায়েব করে দিলো সকল আলো আর প্রাণের শব্দকে।
আমি পকেট হাতড়ে বের করলাম এক টুকরো কবিতা। বাড়িয়ে ধরলাম কুকুরটার দিকে, দ্রুত চিবিয়ে গিলে ফেলল সে জিনিষটাকে। একটা অক্ষরও মাটিতে পড়তে দিল না। শেষবারের মতোন জন্তুটা জ্বলে উঠলো। আলো ছড়ালো তীব্রভাবে। আমি নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,
"যা, ভেঙ্গেচুরে ফ্যাল..." তীব্রগতিতে ছুটে গ্যালো সে, আমি প্রাণপণে ছুটলাম তার পেছনে। চারপাশে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে অন্ধকার গলির শরীর। আমিও ছুটছি...কিন্তু ওই কবিতাটার প্রাণ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত! আমি দেখতে পাচ্ছি ছুটে যাওয়া কুকুরের চারপাশে আলোর তীব্রতা মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আর একটু...অল্প একটু...
হঠাৎ সব আলো নিভে গ্যালো। ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্ধকার, এবার তার পালা। চারপাশ থেকে অন্ধকারের হাত পা গুলো নখর বাগিয়ে ঘিরে ধরলো আমাকে। আমি সর্বশক্তিতে সেসব এড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কোথায় সেই কুকুরটা, আমার ত্রাণকর্তা কোথায়! পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে টের পাচ্ছি, আমি ডুবে যাচ্ছি গভীরে। তখনই...
"ঘেউ! ঘেউ!!" শব্দ অনুসরণ করে তাকালাম। গলির অপর প্রান্তে, অন্ধকার ছাপিয়ে বেশ দুরে একটা আলোকিত দরজা দেখতে পাচ্ছি। পাশে দাঁড়িয়ে অস্থির কুকুরটা, দাপাচ্ছে ঘনঘন। যেনো বলতে চাচ্ছে, "চলে এসো, চলে এসো! এইখানেই মুক্তি!"
আমি নতুন করে আশার আলো দেখতে পেলাম। পায়ের নিচে জন্ম নিতে থাকা গর্তটা তারই তোড়ে ছুটে পালালো। প্রবল উদ্যোমে আমি পা চালালাম। অন্ধকার ছিঁড়েখুড়ে এগোতে চাইলাম। আমি কোনভাবেই হাল ছাড়ব না। একটু একটু করে এগিয়ে এলো যেনো দরজাটা। চুড়ান্তরকম অস্থির হয়ে উঠলো কুকুরটা। অন্ধকারও সর্বোচ্চ ঘৃণ্যতায় আমাকে আটকে ধরতে চাইছে। আর মাত্র কয়ফুট বাকি, কুকুরটার আর্তচিৎকারে কানে তালা লেগে গ্যালো। অবশেষে আঁধার তাকে গিলে ফেলেছে। আমার সঙ্গী আর নেই। সমস্তকিছু ঢেকে দিচ্ছে দুঃস্বপ্ন। আমি প্রচন্ড আতঙ্কে একটা লাফ দিলাম, প্রাণপণে, সর্বশক্তিতে...
...............................................................................................................................................................
অন্য কোথাও;
মনে হচ্ছে অচেনা একটা জগতে এসে পড়েছি আমি। চন্দ্রালোকিত বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখা যাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা ফাটলধরা জমিনের উপর। দূরে একসারি শালগাছের অবয়ব দেখা যাচ্ছে মনে হয়। দিগন্তে মিটিমিটি অস্তিত্বের আভাস দিচ্ছে একটা জনপদ। বাঁ দিকে একটা রেললাইন, দুধারে সারবাঁধা ইউক্যালিপ্টাস। পশ্চিমে দুটো তালগাছে দেখে কেন জানি পরিচিত মনে হল।
আরে! আমি তো চিনি ওই দুটো গাছকে দারুণভাবেই। ভুল হবে না আমার। এই মাঠ, মৃত বিল, অনন্ত রেললাইন......হ্যাঁ। দিগন্তে সারঙ্গপুর দেখা যায়। আমি কোনভাবে ফিরে এসেছি আমার পিতৃপুরুষের গ্রামে। শহুরে অন্ধকার আমাকে কোথায় এনেছে? আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
"কে যায়?" আমি ঘুরে তাকালাম। বর্ষীয়ান কাউকে মনে হল। খানিক ভেবে মুখ খুললাম,
"সামনে সারঙ্গপুর না?"
"হা, আপনেরে চিনবার পারলাম না..."
"চেনার কথা না, আমি কাবেজ মন্ডলের বড় নাতি।"
এগিয়ে এলেন বৃদ্ধ, টর্চের আলো ফেলে আমার মুখ দেখার চেষ্টা করলেন।
"আরে, মতির ছোল না!"[/si
"হ্যাঁ।" একটু স্বস্তি পেলাম আমি এবার।
"এই সময় কিসে আইলেন বাহে? ট্রেনে?"
কি বলব আমি!
"যাও, শক্করি পা চালাও। ইশার ওয়াক্ত হছে মনে অয়।" তখনই আজানের সুর ভেসে এলো দূর থেকে। আমি বৃদ্ধকে সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, সারঙ্গপুরই এটা। দুঃশ্চিন্তাগুলো উবে যেতে লাগলো মাথা থেকে। পকেট থেকে বের করে সিগারেট ধরালাম। ভিটেবাড়িতে ছোটচাচা পরিবার নিয়ে থাকেন এখন, আমাকে এ সময় দেখে কতটুকু অবাক হবেন কে জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালাম...
আল ছুটে পার হল একটা ত্রস্ত মেঠো ইঁদুর; দু এক ফালি ঘাস উঁকি দিল সযত্নে। ইউক্যালিপ্টাসগুলো যেনো সুস্থির প্রশ্বাসে ভেংচি কাটছে শীর্ণ চাঁদটাকে। ফুটিফাটা মাঠ জ্যোৎস্না শুঁকে আলো বোলাচ্ছে আমার চোখে। দিগন্তে সারঙ্গপুর দেখা যায়।
সব কিছু যেন একই অস্তিত্বে মিলেমিশে একাকার। কায়া নেই, ছায়া নেই।
হয়তো আলোটাই ছায়ার মতো।
কিংবা ছায়াটা আলোর মতো।