পথ হাটি। সবুজ উদ্যান, পাখিদের ঘর এসব পার হয়ে আমার ঘরে ঢুকি। শরতের ঝরা পাতার উপর বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। আমার ঘরের সামনে বারান্দায় আমি বসলাম কফি হাতে। প্রতিবেশী বাড়ির মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছি আমি।
বিদেশের মাটিতে পিএইচডি করতে এসেছি। কিশোরের মত আবেগে প্রতিদিন বারান্দাতে বসে থাকার বয়স না। আসার পর যখন মেয়েটাকে দেখেছি বসে থাকতে। সেও তাকিয়ে থাকে পলকহীন। নীল চোখ। আমি ভাবতাম অনুভূতিহীন কিছু। লিডিয়া তার নাম। বাঙালিদের মত আইকনট্যাক্টে প্রেম হয়ে যাবে ভাবতেই পারি নি। কিন্তু সে আমার দিকে তাকাত। আর মিষ্টি করে
হেসে ফেলত। একদিন না। প্রতিদিন। কি যে নেশা হল। সকালে উঠে বারান্দায় বসতাম খবরের কাগজ মেলে জুতোর ফিতে ঠিক করতাম।
সেও তখন এসে অন্য কাজের ছুতোয় রকিং চেয়ারে দোল খেত। সন্ধ্যায় আমি বসার কিছুক্ষণ পর সে আসতো। আর তখনি বুঝে যাই সে
আমাকে খেয়াল করে। মেয়েরা সব অনুভব লুকাতে পারে না। সে বিদেশী হলেই বা কি। ভাবলাম গল্প করি। তা আর হল না। যেতে হল ফ্রাঙ্কফুর্টে। আমি লিডিয়াকে মনে গেঁথে ফেলছিলাম। ফিরে আসার পর তাকে পেলাম না। সে কি তবে অভিমান করে ফেলল? কেন করবে?
লিডিয়া নামটা কি করে জানলাম? আমি ভাবছিলাম ওর কাছে এগিয়ে যাব। কিন্তু সঙ্কোচ কাজ করে। একদিন সেই আমাকে দেখে উঠে এলো। আমিও উঠলাম। হাত বাড়িয়ে পরিচিত হলাম। হ্যাণ্ডশেক যদিও নিছক নিয়ম কিন্তু লিডিয়ার হাতের স্পর্শ আমি ভুলতে পারি নি।
সে রাতে কবিতা লিখলাম
Blue eyes are crystal river
Blue ocean; Sailing forever
কিন্তু লিডিয়াকে আমি বুঝতে পারতাম না। সে মাঝে মাঝে আমাকে দেখলেও সাড়া দিত না। হয়তো খুব কাছে এলে মেয়েরা আগ্রহ হারায় । বিদেশীরাও ব্যতিক্রম নয়। লিডিয়া বারান্দায় আসত এরপর। তাকাতো না। যেন আমাকে চিনতেই পারে নি। সাধারণত উজ্জ্বল পোশাক পরত। সবুজ বা নীল। একসময় দেখলাম সে মুখ চেপে কাঁদছে । আমি এগোলেও সে তার বারান্দা থেকে নেমে আসে নি।
কিন্তু দু দিন পর আমার ভুল ভাঙে। মেয়েটি ফের আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়। আমি বুঝেছিলাম এমন হতেই পারে।
কিন্তু প্রেমের এসব টানাপড়েন আমার ভাল লাগে না।
বিদেশের মাটিতে আমি মিলনাত্মক কিছু চাইছিলাম। দুজন হাঁটবো পাশাপাশি, বন্ধুর মত ফিস ফিস করে কথা বলব, স্বপ্ন বিনিময় করব।
দুর থেকেই এভাবে আমাদের দেখা হয়। আমি বসে থেকে পুতুলের মত কোঁকড়ানো চুল দেখেছি। হয়তো পুতুলই সে। আঙুল দিয়ে তাকে বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় সেই চুল।
ওকে নিয়ে জানার কৌতূহল বাড়ছিল। আমি একদিন নিজে উঠে গেছি। লিডিয়া এগিয়ে এসে হ্যালো বলল। কণ্ঠটা মিহিন, রেকর্ডের বাজা সঙ্গীত যেন। সে যতটুকু রূপবতী তার চেয়েও বেশী। বয়সটা কত? কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণী? তার চেয়ে কম? আমি লাজ লজ্জা ভেঙে বলে ফেলেছিলাম, লিডিয়া আমার দেখা
সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে।
ও কি কিছু বুঝতে পারে নি? আমার মুখে হাসি দেখে শুধু হেসে ফেলেছিল।
জানলাম তার বিয়ে হয় নি। আর এই বাড়িতেই তার জন্ম। আর কথায় কথায় বাড়ির কর্তা জুলিয়ানের কথা বলল। জুলিয়ান যে তার পিতা সে বুঝতে কষ্ট হল না।এর পর থেকে আমরা দ্রুত ঘনিষ্ঠ হলাম।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হত লিডিয়ার সঙ্গে। এখানে আঠারো পার হলে বাবা মায়ের কোন মাথা ব্যথা থাকে না। আমি ভেবেছিলাম তাকে আমার বাড়িতে ডাকব। ভ্যানিলা আইসিং এ কেক বানানো শিখেছি মাত্র। ছুটির দিন। বিকেলে সে পরেছিল লেসের টুপি। আমি ওর সঙ্গে দীর্ঘপথ হাটতে চাইলাম। বললাম, লিডিয়া, চলো না, আজকে আরেকটু হাটি। ইউট্রেসা পার্কে বেড়াতে যাই। সব বিকেল তো এমন হবে না । লিডিয়া রাজি হয় না , বলল,
না, আমার পক্ষে এটা সম্ভব না । জুলিয়ান দেখছে। সে খুব রাগ করে। তার কথা ছাড়া যেতে পারি না। এটা তো বাংলাদেশ না।
বুড়ো জুলিয়ান এই বয়সের একটি মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখে কেন? আর পার্কে বেড়ালে কি হবে? ভাবতে বিরক্ত লাগছিল।
এর পরের সপ্তাহে সকালে হাটতে বেরিয়ে জুলিয়ানের সঙ্গে দেখা হয়। বাড়ির সামনে সে ফুল বাগান নিড়াচ্ছিল। সে নিজেই আমাকে ডাকল। বলল,
"আমি জানি, আপনার সঙ্গে আমার সবচেয়ে মেধাবী রোবট কন্যা লিডিয়ানার পরিচয় হয়েছে। কথাও হয়। আপনি কি তার সঙ্গে পার্কে ঘুরতে চান?
আমি, থতমত খেয়ে বললাম, জি । শুনেছিলাম জুলিয়ান বড় বিজ্ঞানী কিন্তু.. নিজের মেয়ে কে এমন যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা বিরল।
কথা শেষ হবার আগে জুলিয়ান বলল,"তাতে সমস্যা নেই। রোবটের কন্ট্রোল ইউনিট বাড়িতে। এখনো ও পুরো প্রোগ্রাম হয় নি। এজন্য দুরে যেতে দেই না। তা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে কেমন লাগছে?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি বলছেন, লিডিয়া মানুষ না?
-না, ও ৯ম জেনারেশন রোবট। আমার বহুদিনের গবেষণার ফসল। ওকে বলা হয়েছে আমি ওর পিতা। কিন্তু ওর শরীর চামড়া স্পর্শ সবই অর্গানিক কম্পাউণ্ডে। ওর সেন্সরগুলো ন্যানো টেকনোলজিতে গড়া
ও জানতে চাইবে আপনার ভাল মন্দ। আপনি কাঁদলে ও কাঁদবে।
আপনি হাসলে সে আপনার অনুভূতিকে কপি করে নিতে পারবে। কিন্তু একে ভালবাসা বলা যাবে কিনা সে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
আমি ধাতস্ত হয়ে বললাম,
ও কোথায় এখন?
ব্যাটারি রুমে, চার্জ হচ্ছে। ওর ম্যানটেইনেন্স লাগবে। বুকের সার্কিটটা নষ্ট। ওকে হাসি খুশি বানিয়েছি। এখন শুধু কাঁদে। এমন হবার কথা না। আর সে আপনাকে পছন্দ করে।
-কি করে জানলেন? আমি কৌতুহলী হলাম
জুলিয়ান বলল, ওকে যখন বানানো হয় মেমোরির দাম ছিল বেশী। বার বার মুছে হয় মেমোরি। গতকাল ইরেজিং মেশিনে জমাট লিডিয়ার মেমোরি মুছে দিচ্ছিলাম। দেখি পুরোটা জুড়ে আপনার ছবি। আর যখনই ছবিগুলো মুছে দিচ্ছি দেখি ওর টিয়ার গ্লান্ড দিয়ে জল ঝরচ্ছে। আগেও কত ছবি ভিডিও মুছেছি এমন হতে দেখি নি। সে কোন কারণে আপনার ছবিটা রেখে দিতে চাইছিল।
শুনে বললাম,
ওর সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?
এখন না, ওর শরীর আলাদা আলাদা । শিগগির সচল হয়ে আসবে ও। তখন পার্কে ওর সঙ্গে ঘুরতে পারবেন। বাড়িতে নিয়ে গল্প করতে পারবেন। শুধু খেয়াল রাখবেন ও যাতে মাইক্রো-ওভেন জাতীয় কিছু না ধরে।
এরপর দু দিন তিন করে পাঁচদিন লিডিয়া আর আসে নি।
আমি না জেনে রোবটের প্রেমে পড়ে গেছি। এখন জেনেও তাকে ভুলতে পারছি না। তার মেরামত শেষ হচ্ছিল না। তার শরীরের অনেকগুলো পার্টস বিকল। শুনেছি সে আর দেখতে পায় না।
ভোরে জগিং করার সময় জুলিয়ান কে পেলাম। ও বলল, একটা সুসংবাদ দেই। আমি জার্মান সরকারের অনুদান পেয়েছি। এখন অনেক ভাল রোবট বানাতে পারব। বাণিজ্যিক ভাবে এমন রোবট আসবে। যারা নি:সঙ্গ তাদের জন্য এটা খুব উপকারী । ভেবে দেখুন ঘরে ঘরে লিডিয়ার মত রোবট যাবে। ভালবাসবে গৃহকর্তাকে। আমি কেন যেন এটা মানতে পারি নি। আমি চাইছিলাম লিডিয়া আমার জন্যই থাকুক।
সন্ধ্যায় জুলিয়ান আমাকে ডাকলেন। ১০ম জেনারেশনের রোবট এসেছে। বাড়ির নিচতলায় বেসমেন্টে রোবটদের প্রদর্শনী জলসা হবে। গণ্যমান্য লোকজন এসেছে। এর মধ্যে দুটো ছেলে রোবট এসেছে।
আমি গিয়ে ভাবতেই পারছিলাম না এসব অসম্ভব রূপবতী সব মেয়েরা কেউই মানুষ না। আর সবাই কিন্নরী কণ্ঠে গান গাইছিল। বহমান নির্ঝরিনীর মত কল কল শব্দে হেসে উঠছিল।
জুলিয়ান পান পাত্র হাতে এগিয়ে এসে বলল, আপনি কি নিয়ারাকে দেখেছেন। ও আমাদের সবচেয়ে দক্ষ ও রূপবতী রোবট।
আপনাকে ওটা ফ্রি দিয়ে দেব।
ওর ভেতর লিডিয়ার চেয়ে বেশী আবেগ আছে। আর কণ্ঠটা নাইটিংগেলের মত । ওর চোখ থেকে চোখ ফেলতেই পারবেন না।
ডান্স শুরু হলে । আমি এসে পাশের রুমে দরজায় দাঁড়ালাম। সাইনবোর্ড
-- Assemble center--
Beware of lead poisoning!
Robots may contain lead.
আমি জানলাম এই স্ক্র্যাপ রুমেই খণ্ড খণ্ড করে খুলে রাখা লিডিয়াকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রেখে দেয়া হয়েছে। মানুষের অন্ত্রনালী বা পাঁজরের হাড় দিয়ে তাকে আর চেনা যায়। না। ওকে দেখলেও চেনা যাবে না।
জুলিয়ান আমাকে একা দেখে নিয়ারাকে ডেকে আনল। লম্বা ছিপছিপে পরম সুন্দর এ নারী সে। দেখলে মনে হবে ঈশ্বরের নিজের ইচ্ছে এমন নারী তৈরী করার। নিয়ারাকে দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
জুলিয়ানের কাছে শুনলাম সে দিন রাতে লিডিয়াকে স্ম্যাশ করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলা হবে । আমার কেন যেন কান্না পাচ্ছিল।
আমি সামলে বলেছিলাম, জুলিয়ান,
লিডিয়ার চেয়ে রূপবতী কাউকে আমার দরকার নেই,
যদি পারেন ওকেই প্লিজ ঠিক করে দিন।
---
ড্রাফট ১.০