[কবি ও কবিতার আধিক্যে মহারাজা ক্রোধান্ধ। সভা তলব । চতুর্দিক সভাসদবৃন্দ, হেকিমের আগমন]
রাজা: রাজ্যে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, যে দিকে দৃষ্টি যায় শব্দের কোলাহল যে দিকে যাই শুধু কবিতা আর কবিতা, জলে স্থলে কর্ণবিদারী কবিতাবৃত্তি, বিজ্ঞাপন বোর্ডে ঝুলন্ত কবিতা, জীবিত এবং মৃত কবিতারা পথে শুয়ে, শ্মশানেও কবিতার প্রেত!
অথচ একদা শুধুমাত্র নির্বাচিত কবির গর্ভে জন্ম নিতো প্রকৃত উচ্চবংশীয় মোহন কবিতা। স্বাধীনতার অনুমতিপত্রে, মাধ্যমের বাহুল্যে দরিদ্র পাঠকহীন কবিদের গৃহেও জন্ম নেয় লক্ষ নিযুত কবিতার ছানা! সেই সকল শিশু কাব্যের না হয় রাজ্যসভায় আবৃত্তির যোগ্যতা, না পায় ছাপানো কাগজের আহার, কোন মতে জীর্ণ শীর্ণ শরীরে সস্তা বিদ্যুতের অক্ষরে টিকে থাকে!
হেকিম(মাথা নত করে): ঠিক, মহারাজ ঠিক, রাজ্যে প্রয়োজন কবিতার জন্ম নিয়ন্ত্রণ।
সকলে( তারস্বরে): ঠিক মহারাজ ঠিক, প্রয়োজন জন্ম নিয়ন্ত্রণ।
ঢাক ঢেঢড়া বাজলো । পাইকপেয়াদা শিঙ্গায় ঘোষনা দেয়, আজ থেকে সকল কবিতা নিষিদ্ধ। কাব্য প্রজননে কাটা যাবে কবির মুন্ডু। ভাবের গর্ভদন্ড যেন ঢাকা থাকে বিজ্ঞানের লোহায়, যুক্তির চাদরে, অনুভবের পরাগ যাতে উড়ে মিলন না ঘটায় শব্দের গর্ভমূলে।
রাজা: চমৎকার! হাকিম, আমার রাজ্যে থাকুক অনন্ত গদ্যের মুর্ছনা, কবিতারা অঙ্কুরিত না হলে হিয়ার মাঠ থাকে পরিচ্ছন্ন, অবারিত।
কিন্তু সেই দিন থেকে বন্ধ হয় কবিতার আগমন, হৃদয়ের পাখিরা ডানা ঝাপটানো থামায়, সভাসদ অধিক শোকে ভুলে যায় তরঙ্গিত মহারাজের স্তুতি। আর প্রেমের প্রজাপতিরা নোনতা যুক্তি শুকেই উড়ে যায় দুর কোন দেশে। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ ভ্রমর মুমুর্ষ হয়, অন্তমিলের জলের অভাবে ঢলে পড়ে অর্থবৈভবের কাঠের পাটাতনে।
[পুনরায় জরুরী সভায় রাজা, উজির, কোটাল এবং সভাসদবৃন্দ। মহারাজা মহাউদ্বিগ্ন]
রাজা: রাজ্য আজ শ্রীহীন, পুষ্পউদ্যানে নাই বিহঙ্গের আনাগোনা, সমুদ্রে স্তব্ধ উর্মিমালা, পথে পথে যুক্তির গলিত শব। নির্বিচারে কবিতার নির্বাসনে কাব্যহীন রাজ্য যেন নিরব গোরস্তান। যে কোন প্রকারে বনেদী পদ্যের বংশবিস্তার অতি প্রয়োজন ।
উজির, কোটাল, সভাসদ( এক বাক্যে রায় দেয়): নিয়ন্ত্রিত কবিতার অনুমতি দেয়া হোক। তারকা কবি, জনপ্রিয় কবি ফিরে পাক উন্মুক্ত প্রজননের অধিকার, ধনীমানবের যেই কারণে বহুসন্তান যুক্তিসঙ্গত। পাঠকই যদি অভিনন্দনের মুদ্রায় ঠিক করে কবিতার মূল্য, অধিকপাঠ্য এবং অধিক খ্যাত কবিতা সন্তানের খাঁটি দুগ্ধ অন্নে যেন দীর্ঘজীবি হয় ।
ঢাক ঢেঢড়া আবার বাজে পাইকপেয়াদা ঘোষনা দেয় প্রতিষ্ঠিত অভিজাত কবির বংশধর শুধু যেন রাজ্যে থাকে । নামহীন অপ্রকাশিত মানবের জন্য ভাবেরসের নগ্নমৈথুন হবে নিষিদ্ধ। স্বল্পপাঠ কবিতারও হয়ে যাবে সম্পুর্ণ বিলয়। রাজ্য থেকে ক্রমে বিড়াড়িত হয়ে যাবে নমশূদ্র কবি ও কবিতা।
পাঠকেরা আশা পায়। মুদ্রিত পুরষ্কৃত কবিতা অবতার হয়, বিশ্বকবিদের কবিতা প্রশংসায় শোভা পায় উচ্চ বৃক্ষডালে। প্রজাপতি বসে ফুলে। কবিতার রস সিক্ত হোলিতে অন্তরের রাধিকা নেচে গায়।
কিন্তু অবিলম্বে অভিযোগ করে, দ্যূলোক-ভূলোকে, তারকা কবিতার অধিক ব্যবহারে জনগন ক্লান্ত।
[মহারাজা পুনরায় সভা তলব করে। উজির নাজিরের প্রবেশ]
রাজা: একি সভাসদ! সমস্যার কি সমাধান নাই? তারকা কবিতার সংখ্যা অতীব নগন্য, একই বাশরীর যেন পুনর্বার ফুৎকার হয়, একই ঘন্টা বাজে সহস্রবার। বিশুদ্ধ কবিতারা পুনরোক্ত হয়ে হয়ে পঁচন ধরায় সব। জল-স্থল, স্বর্গ-মর্ত নিদ্রামগ্ন থাকে অতিজনপ্রিয় কাব্যের বটিকায়। নক্ষত্র কবিতাশিশুও সময়ে বৃদ্ধ হয়, অথর্ব হয়, গরিমার লাঠিতে ঠক ঠক হাটে।
রাজা(আদেশের ভঙ্গীতে অঙ্গুলী প্রদর্শণপূর্বক): আজ থেকে বন্ধ হবে এই কবিতার জন্ম নিয়ন্ত্রণ!
সকলে( এক বাক্যে): যথা আজ্ঞা, মহারাজা! বন্ধ হোক এই কবিতার নিয়ন্ত্রণ । নতুন কাব্য শিশুরা ভুমিষ্ট হোক ঈষাণ,নৈঋত সহ দশ দিক । হোক কবিতা পুষ্প, আগাছা, সাদা অথবা পিঙ্গল!
আবার হাজারো হাজারো উচু নিচু মানুষ পরে নিল কবির পোষাক। ঘরে ঘরে আবার কেঁদে ওঠে নবজাতক কবিতা। বিদ্যুতের খাতায়, মুদ্রনের পাতায়, অজস্র কবিতা জন্ম হলে রাজ্যে ফিরে আসে সুকুমার চিন্তার ডাহুক। রূপক উপমা পান করে মাতাল কবিদের হয় তুমুল হট্টগোল। পাঠক ইচ্ছে মতো হাট থেকে ভুল,শুদ্ধ, ভাবের প্রলাপ ক্রয় করে। নতুন কবিরা উন্মুক্ত আড়ং থেকে আতুড় ঘরের পদ্যশিশুদের উত্তাপ দিতে বেছে নেয় মাত্রা অথবা অক্ষরবৃত্তের পশমী জামা ।
--
প্রথম আনফরম্যাটেড ভারশন:
Click This Link