প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এসেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঈদের বন্ধ। আনন্দের মুহুর্ত। বাবারা এসে নিয়ে যাচ্ছেন নিজ সন্তানদের। আমাদের খেলার সাথীদের। পড়ার সাথীদের। এদের চলে যাওয়ার দৃশ্যে, কেন জানি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন এরা আমাদের সাথী ছিল না কখনো। পড়ার কিংবা খেলার। অথচ গতকাল থক ছিলাম আমরা একে অন্যের আপনজন। আর আজ মনে হচ্ছে এরা আমাদের কেউ নয়। বরং কাঁদিয়ে যাওয়ায় বলা যায়, এরা আমাদের শত্রুসম। এর একটি মাত্র কারণ, ওদের পরিবার আছে। বা- মা আছে, আছে আত্মীয়স্বজন। আর আমাদের শূন্যতাই আপনজন।
আমাদের চোখে আটকে থাকা দুঃখগুলো যেন আজ আর বাধা মানছে না। দুঃখ-কষ্টেপূর্ণ আমাদের ব্যথার জোয়ার যেন এরা উথলে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উপর আছড়ে পড়ছে যেন আমাদের জীবনের প্রকাণ্ড সত্য; আমরা যা এড়িয়ে চলতে শিখেছিলাম এখানে এসে। ভুলতে শিখছিলাম আমাদের অতীত, অথচ আজ এ জায়গাটাই যেন আমাদের শূন্যতা ফিরিয়ে দিচ্ছে।
তাদের। আমাদের সাথীদের বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন আছে, আমাদের নেই শূন্যতারও স্বস্তি। আমাদের সাথীদের সাথে আমাদের বড় পার্থক্যের জায়গা এটা। এখানে এসে আমরা প্রচন্ডভাবে বুঝে নেই আমাদের পার্থক্য। সাথীরা চলে যায় নিজ নিজ বাড়ি। আপনজনদের নেয় সঙ্গী করে। বিপরীতে আমাদের অতীত এখানে এসে আমাদের সঙ্গী হয়। নিঃসঙ্গতায় যেই কালো অন্ধকার ছিল আমাদের সাথী। সেই দুর্বিষহ দিনে সাহিত্যিকেরা ডাকতো আমাদের পথ ফুল নামে। দু'দুটো বাদাম গুঁজে দিতো আমাদের ছোট্ট হাতে। রাতের খবর কে রাখে। ভোর হতেই শুরু হতো সত্যিকারের বাদামের (প্রহারের) লেলিহান লালসা। আমাদের জামা খুলে দেখতো না কখনো কোন কবি। সমাজসেবী। সাহিত্যিকদের মত ওরাও গুঁজে দিতো আমাদের হাতে ঈদের সেলামি। যা আমাদের মাধ্যমে পৌঁছতো আমাদের বড় ভাইদের উদরে।
সাহিত্যিকেরা আমাদের কবিতা শুনাতো প্রায়ই। বিনিময়ে আমরা পেতাম দু'মুটো চানাচুর মিশ্রিত মুড়ি। ওরা পেতো শ্রোতা। নিরব শ্রোতা। ভক্তকুল। আমাদের জব্বাইরা কবিদের ঢঙে বলতো, "এদের পইদ্য কেউ হুনেনা কই আমাদের হুনাতে আয়"। আমরা জব্বাইরার থেকে মুড়িকেই ভালোবাসতাম বেশি। তাই তো বর্ণজ্ঞানহীন এই আমরা কবিদের কবিতাকে বলতাম " মুড়ির পুত"। এই মুড়ির পুতেরা আমাদের সাক্ষাতে আসতো সপ্তাহে একদিন। এখন পুরো বছরে আসে হাতে গুণা মাত্র কয়েকটা দিন।
এতীম শব্দের অর্থ আমরা তখন খুব ভালো বুঝতাম। এখানে এসে যা শিখলাম, তার চেয়েও শক্ত ছিল পূর্বের সেই জ্ঞান। এখানে। আমাদের এই পাঠশালায় অনেকে চেষ্টা করে অভিভাবক হওয়ার। সেখানে। রাস্তার পাশে, সকলেই নিতে চাইতো আমাদের দেহের স্বাদ। আমরা বেঁচে আছি। এখানে বেঁচে আছি নিজেদের মত। নিরাপত্তা শিখছি। শিখছি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের ভণ্ডামি। এরা যদি ভণ্ড না হতো, তবে কেন আজ এই ঈদের দিনে নেয় না খোঁজ আমাদের। আমরা তো তাদের অপেক্ষায় আছি। একটু আদরের আকুতি নিয়ে চেয়ে আছি পথের পানে।
ঈদ এখন আমাদের আনন্দের নয়। দুঃখের। কষ্টের। নিঃসঙ্গতার। হায়, যদি আমরা ভবিষ্যৎ বুঝতে না পারতাম! তবে হয়তো এই ঈদেও রাস্তায় লাফালাফি করতে পারতাম। আপনেরা হয়তো তখন ঝাড়ি দিয়ে 'খান*কির পুত' গালি দিতেন। অথবা হয়ত কেউ মমতায় মাথায় হাত বুলাতেন। বলতেন, ঈদ মোবারক। আমরা তৃপ্তিতে তবু আপনাদের চোখে ভয়ে ভয়ে তাকাতাম। রাত্রির কালো থাবার ভয়ে। কিন্তু আজ সেই আতঙ্ক নেই। তবে আনন্দও নেই। ঈদ মানে এখন আর লাফালাফি, খেল তামাশা কিংবা বন্ধুদের সাথে আনন্দ করা নয়। আমাদের সাথীরা তাদের পরিবারে চলে যাওয়ায় আমরা পরিবার খোঁজি আজ। আজ আমাদের পরিবার প্রয়োজন। ঈদের দিনে একজন পরিবারের অভিনয় করুক, এটাই যেন আমাদের একান্ত চাওয়া।
এই আমাদের কষ্টে ফাটা বুক, চোখের জলে ভেসে যাওয়া নিঃসঙ্গতার শোক দেখার কেউ নেই। কেউ এসে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে মমতার অভিনয়টুকু করে না। কেউ এসে বলে না, একটি মুহুর্তের জন্য আসো ঈদের আনন্দ করি বণ্টন। আমাদের ঈদ মোবারক, একটু আলাদা খাবারের আয়োজন ছাড়া কিছু নয়। আপনাদের ঈদ মোবারক, পুরোটা সময় আনন্দময়।
ছবি> ইন্টারনেট
নোট: অপরিপক্ক এই লেখাটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার, আমরা চাইলেই নিকটস্থ এতিমখানায় আমাদের ঈদের আনন্দ বণ্টন করতে পারি। অর্থ দিয়ে নয়, এতিমদের সাথে কিছু সময় কাটানোর মাধ্যমে। আমরা সকলেই ব্যস্ত জীবন পার করছি। বিশেষ করে ঈদের দিন আমাদের ব্যস্ততা বেশি থাকে। এই ব্যস্ততার ফাঁকে যদি আমরা সামান্য মূহুর্ত তাদেরকে দেই, সেটা আমাদেরকে যেমন দিবে আত্মিক প্রশান্তি তেমনি তাদেরকে যোগাবে সামনে চলার সাহস।
তাই আসুন, ঈদের দিনের শিডিউলে পরিবার, পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন ও নিজের পাশাপাশি তাদের জন্য কিছু সময় রাখি। সামান্য মুহুর্তের জন্য তাদের সাথে সাক্ষাত করি। আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে সময় দিয়ে পূর্ণতা অর্জন করি ঈদের আনন্দের।
সবাইকে ঈদুল ফিতরের অগ্রীম শুভেচছা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ ভোর ৫:২০