প্রাক-কথনঃ আমার এই লেখাটির প্রসঙ্গ এর ঠিক আগের পোস্টটাতে কথা প্রসঙ্গে চলে এসেছিল। পোস্টের মন্তব্যে কয়েকজন পাঠক আমার এই লেখাটিও পড়তে চেয়েছেন। যেহেতু লেখাটি এর আগে ব্লগে প্রকাশ করা হয় নাই, আজ তাদের অনুরোধে লেখাটি এখানে প্রকাশ করলাম। যারা অনুরোধ করেছিলেন, আশাকরি তারা এতে সন্তুষ্ট হবেন।
একটানা বেশ কয়েকদিন টানা গরমের পর গত দু’দিন ধরে কখনো হাল্কা কখনো ভারী বৃষ্টি হবার কারণে আবহাওয়াটা অসহনীয় থেকে সহনীয়, এমনকি রাতে আরামদায়ক পর্যায়েও নেমে এসেছে। বৃষ্টির কারণে আজ জুম্মার নামাযের সময় ছাতা নিয়ে যেতে হয়েছিল। আমি পারতপক্ষে মসজিদে ছাতা-টাতা নিয়ে যেতে চাই না, কারণ এগুলো চুরি যাওয়া থেকে সামলানো বিষম দায়। মাত্র ছয় মাস আগে এই জুম্মার দিনেই মসজিদ থেকে আমার প্রায় নতুন আইফোনটি পকেটমারের কাছে খুইয়ে আমি রীতিমত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। যাহোক, নামাযের উদ্দেশ্যে নীচে নেমে দেখি বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছে; ছাতা ছাড়া যাওয়াই যাবে না। কেয়ারটেকার একটা ছাতা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘স্যার যান’। আমি ছাতাটা নেব কি নেব না, দোটানায় পড়ে গেলাম। তাকে বললাম, “এই ছাতার নীচে তো দু’জন অনায়াসে যাওয়া যাবে। তুমি আমার সাথে চলো, আমাকে মসজিদে পৌঁছে দিয়ে (চার মিনিটের হাঁটা পথ) তুমি ছাতা নিয়ে চলে এসো। ফেরার সময় আমি যেভাবে পারি, আসবো”। সে জানালো, নীচে আর কেউ নেই, সবাই নামায পড়তে চলে গেছে। অগত্যা ছাতাটা নিজের হাতে নিয়েই রওনা হ’লাম।
নামাজ শেষে সুন্নত না পড়েই ছাতাটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, কারণ ছাতা বিষয়ক দুশ্চিন্তা আমার নামাযে মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। ছাতাটা সেই কেয়ারটেকারকে ফেরত দিয়ে আমি লিফটের দিকে যেই না পা বাড়ালাম, সে বলে উঠলো, “স্যার, এ ছাতাটা আমার নয়”। তার এ কথা শুনে আমি রীতিমত বেকুব বনে গেলাম। আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দেখে সে বললো, “স্যার ছাতাটা আপনি কোথায় রেখেছিলেন”? আমি তাকে জায়গাটা বুঝিয়ে দিলাম। সে বললো, “আপনি একটু নীচে দাঁড়ান, আমি এক দৌড়ে গিয়ে একটু দেখে আসি”। একটু পরেই সে ফিরে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, “পাইছি স্যার”। আমি ভালো করে দেখলাম, সে তো আমাকে এ ছাতাটাই দিয়েছিল; আমি তো এ ছাতাটাই নিয়ে গিয়েছিলাম। আর ওর এ ছাতাটা আসলেই খুব সুন্দর। আমি যেটা এনেছিলাম, সেটাও এর কাছাকাছি, তবে এতটা ভালো ছিল না। আমি বললাম, “কোথায় পেয়েছো”? সে বললো, “আপনি যেভাবে বলেছিলেন, সেখানেই। সেখানে আপনার আনা ছাতাটা রেখে দিয়ে আমারটা আমি নিয়ে এসেছি”। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু মনে মনে একটা দুশ্চিন্তা রয়ে গেল, আমি যার ছাতাটা ভুলে এনেছিলাম, তিনি তারটা খুঁজে না পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন নি তো? কেয়ারটেকার বললো, “স্যার, অনেক মানুষ এখনো নামায পড়ছে। যার ছাতা, তিনি নামায শেষে একই জায়গায় খুঁজলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন”। আসরের নামাযের সময় মসজিদের খাদেমের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ জুম্মার নামাযের পর কেউ তার নিজের ছাতাটি খুঁজে পাননি, এমন অভিযোগ করেছেন কিনা। তার নেতিবাচক উত্তর পেয়ে মনে কিছুটা স্বস্তি লাভ করলাম।
বিকেল থেকেই আকাশটা ঝিরিঝিরি ঝরছিল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জল পড়ার শব্দ শুনছিলাম। নীচে নিম গাছের বৃষ্টিস্নাত সবুজ, সজীব পাতারা একটু একটু করে দোলা খাচ্ছিল। বৃষ্টিভেজা বাতাস শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। সামনের বিল্ডিং এর ছাদের কিনারে বসে দুটো পায়রা চঞ্চল হয়ে ওড়াউড়ি করছিল। বছর কয়েক আগে ইমারতটি যখন নির্মাণাধীন ছিল, তখন দেখতাম সন্ধ্যের পর থেকে কোথা থেকে যেন দুটো পেঁচা এসে আমাদের বাসার দিকে মুখ করে সেই ছাদের কিনারে এমনভাবে বসে থাকতো যে দেখে মনে হতো ওরা আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে সময়ে মাঝরাতে উঠেও আমি কোন কোন রাতে এভাবেই ওদেরকে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা দেখেছি। দণ্ডায়মান গাছগুলোতে ভেজা কাক-পক্ষী আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিল। যদিও ওদের দুর্দশা দেখে কেমন যেন একটু মায়া হচ্ছিল, তথাপি মনে হচ্ছিল যে অতীষ্ঠ গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে হাঁপানোর চেয়ে ওরা এ অবস্থাতেই যেন ভালো ছিল।
শয্যা গ্রহণের আগে প্রতি রাতে একবার ব্যালকনিতে এসে আমি আকাশটাকে দেখে নেই। শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার জ্যোৎস্না স্নাত আকাশ আর কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশ, দুটোই আমাকে সমভাবে আকর্ষণ করে। আমাদের বাসাটা বিমান বন্দরের কাছাকাছি হওয়াতে কয়েক মিনিট পরে পরেই আকাশে উড়োজাহাজের আনাগোনা দেখতে পাই। আকাশে উড়ন্ত চিলকে কিংবা দল বেঁধে ওড়া পাখিদেরকে দেখতে যেমন আমার ভালো লাগে, তেমনি উড়ন্ত প্লেনকে দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে। প্লেনের যাত্রীদেরকে নিয়ে, ককপিট ও কেবিন ক্রুদের নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে। আমাদের সামনের আকাশটা দিয়ে সাধারণতঃ টেক-অফ করা প্লেনগুলো উড়ে যায়। ল্যান্ডিং প্রত্যাশী প্লেনগুলো সাধারণতঃ আশুলিয়া, দিয়াবাড়ি ইত্যাদি এলাকার উপর দিয়ে ল্যান্ডিং এ্যাপ্রোচ করে। সাধারণতঃ টেক-অফ করা প্লেনের যাত্রীদের মন খারাপ থাকে, কারণ তারা স্বজনদেরকে দেশে রেখে প্রবাসে পাড়ি জমায়। ল্যান্ডিং করা প্লেনের যাত্রীরা সাধারণতঃ স্বজনদের সাথে মিলিত হবার আশায় কিছুটা আনন্দে, আর ল্যান্ড করার পর যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠায় থাকে। প্রথমোক্ত যাত্রীদের এবং তাদের স্বজনদের কথা ভেবে আমার মনে সমবেদনা জাগ্রত হয়।
রাতের আকাশ দেখার সময়, বিশেষ করে তখন যদি বৃষ্টি হতে থাকে, আমার প্রায়ই ক্ববরবাসীদের কথা মনে হয়। মাঝে মাঝে ক্ববরস্থান ভিজিট করা আমার একটা ‘হবি’ বলা চলে। এমনকি বিদেশে কোথাও বেড়াতে গেলেও সেখানকার কোন একটি ক্ববরস্থানে যেতে আমি চেষ্টা করি। যেমন গিয়েছি মেলবোর্নের ‘Bunorong Memorial Park’ এ, তেমনি গিয়েছি কানাডার রিজাইনাতে অবস্থিত ‘রিভারসাইড মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রি’ তে এবং তেমনই গিয়েছি আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের টাম্পা বে তে অবস্থিত ‘স্কাইওয়ে মেমোরিয়াল গার্ডেন্স’ এ। ভিন্ন নামে, ভিন্ন স্থানে এগুলো সবই একেকটা ক্ববরস্থান, যেখানে মুসলিম ও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে ক্ববর দেয়া হয় এবং মৃত্যুর পরে তারা সেখানে ‘শান্তি’তে সহাবস্থান করে। সমাধিলিপি আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। স্মৃতিফলকের প্রতিটি কথায় আমি ভালবাসার ছোঁয়া অনুভব করি। বিদেশের সিমেট্রিগুলোতে আমি মানুষের ক্ববরের পাশাপাশি তার পোষা প্রাণীটিরও (বিশেষ করে প্রভুভক্ত কুকুরের) ক্ববর দেখেছি, যেখানে অত্যন্ত আবেগময় ভাষা দিয়ে তার জন্য এপিটাফ লেখা হয়ে থাকে। স্বভাবমত আজও আমি শোবার আগে আকাশ দেখার জন্য ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে বৃষ্টি মুষলধারে ঝরা শুরু করেছে। আমার মনে পড়ে গেল আমার দেখা দেশ বিদেশের অনেক, অনেক ক্ববরস্থানের কথা, আমাদের পারিবারিক ক্ববরস্থানের কথা যেখানে আমার মা-বাবা, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফি এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা সমাহিত আছেন। এ ছাড়াও মিরপুর বুদ্ধিজীবি ক্ববরস্থানের কথা, মিরপুর ১০ নম্বর ও শেওরাপাড়ার ক্ববরস্থানের কথা, রংপুরের নূরপুর ক্ববরস্থানের কথা, লালমনিরহাটের হাড়িভাঙ্গা গ্রামের দরগাহপারের ক্ববরস্থানের কথা, উত্তরার আশকোনার অদূরে একটি ক্ববরস্থানের কথা। এসব ক্ববরস্থানে আমার অনেক আত্মীয় স্বজন শায়িত আছেন। এ ছাড়া বনানী ক্ববরস্থানের কথা, এমনকি বিএমএতে প্রশিক্ষণকালীন সময়ে কুমিল্লার বরুরায় রাতের আঁধারে এমনই একটা বৃষ্টি ঝরা রাতে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার সময় একটি কাঁচা ক্ববরের কথা মনে পড়ে গেল! শেষোক্ত ক্ববরটির এবং ক্ববরবাসীর কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। অনুমান করলাম, এসব ক্ববরের গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে হয়তো এখন জোনাকি পোকারা আলো দিয়ে যাচ্ছে। কোনটা হয়তো শান্তির ক্ববর, আবার কোনটা শাস্তির। আকাশের উপহার এই বৃষ্টির জল কি তাদের দেহাবশেষকে এখন ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে? জানা অজানা, চেনা অচেনা সকল ক্ববরবাসীর কথা ভেবে মনের ভেতর থেকে তাদের জন্য শান্তি কামনায় দোয়া উচ্চারিত হতে থাকলো। এক সময় ভারাক্রান্ত মনটা একটু হাল্কা বোধ করলে ব্যালকনির দরজায় তালা লাগিয়ে শয্যা গ্রহণ করলাম।
ঢাকা
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ৯৮০
এর আগের প্রাসঙ্গিক পোস্টঃ লেখকের প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টি
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৭:৪৭