দুনিয়া জুড়ে প্রায়ই হচ্ছে রায়ট।বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংঘাত,গোষ্টীগত দ্বন্ধ বা সরকারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জন অসন্তোষ এসব রায়টের পিছনে কাজ করে।কখনও কখনও রায়টে তেমন একটা প্রাণহানি না ঘটলেও প্রায়ই তা ব্যাপক প্রাণহানীকর হয়ে উঠে।ইতিহাসের ব্যাপক আলোচিত এবং ধ্বংসাত্মক কিছু রায়ট নিয়ে ইন্টারনেট কিছুদিন আগে একটা ফিচার পড়েছিলাম।ইচ্ছা ছিল ইংল্যান্ড এ দাঙ্গা চলাকালীন সময় এটি আপনাদের সাথে শেয়ার করব কিন্তু নানা কারনে হয়ে উঠেনি।
আরব রিভোল্ট ইন প্যালেস্টাইন-
১৯৩৬ এর এপ্রিল থেকে আরব বাসী ও অভিবাসী ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয় যার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ত ব্রিটিশ সরকার। অভিবাসী ইহুদিদের ভূমি দখলের প্রতিবাদ থেকে এই দাঙ্গাকে এক অর্থে দখলদারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলা যায়। শেষ পর্যন্ত যদিও আরব হায়ার কমিটি ও ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ১৯৩৯ সালে দাঙ্গা বন্ধ করা হয় কিন্তু ততদিনে
মারা যায় ৫৬০০ জন।সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল বর্বর ইহুদীরা ফিলিস্তিনি পুরুষদের প্রায় ১০% কে এই দাঙ্গার সময় মেরে ফেলেছিল।
ডাইরেক্ট অ্যাকশন-
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দাঙ্গা যার নেপথ্য কারণ ধর্মীয় বিদ্বেষ।১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলিকাতা শহরে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে এই দাঙ্গা শুরু হয়। কে প্রথম শুরু করেছিল তা এখনো পরিষ্কার না। তবে ভয়ংকর এই দাঙ্গা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনারা থামানো আগপর্যন্ত অফিশিয়ালি মারা যাওয়ার কথা ৪০০০ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ১০০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারনা। শুধু মৃত্যুই শেষ নয় এর ফলে গৃহহারা হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল অসংখ্য মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে হিন্দুদের ছাড়তে হয়েছিল পাকিস্তান।
ফার্স্ট ইন্তিফাদা-
১৯৮৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর দখলদার ইসরাইলী সেনাদের ট্যাংক এর চাপায় পড়ে ৪ জন ফিলিস্থিনি মারা যায় আহত হয় আরও ৭ জন।নির্লজ্জ ইসরাইলিরা দাবী করে এটা নিছক একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু এই খুনের ফলে সৃষ্ট বিক্ষোভ অচিরেই দাঙ্গায় মোড় নেয় এবং ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলা এই দাঙ্গায় মোট মারা যায় ২৩২৬ জন। বলাবাহুল্য যার বেশীরভাগই নিরীহ ফিলিস্থিনী।
রোমানিয়ান রেভলূশন-
নিকোলাইকো এসকুলেস এর নেতৃত্বে গঠিত বামপন্থি সরকার এর নানা পদক্ষেপে রোমানিয়ার জনগণ এমনিতেই ক্ষিপ্ত ছিল।তারউপর বিদ্যুৎ খাবার ও বস্ত্র সরবরাহে ব্যর্থতা এইসব নিয়ে জনগণকে সরকারের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছিল। প্রথম জন অসন্তোষ প্রকাশ পায় ১৯৮৯ এর ১৬ই ডিসেম্বর। সরকার বিরোধী প্রচারণায় সক্রিয় যাজক লাজলো টকস কে সরকার চাকরিচ্যুতি ও তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে চাইলে জনগণ প্রতিহত করতে যায়। তখন সরকার পুলিশ লেলিয়ে দেয়। পুলিশ জনগণকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেও পরেরদিন থেকে জনগণ একত্রিত হয়ে ভাঙচুর শুরু করে। শুরু হয় এক ভয়াবহ দাঙ্গার। ডিসেম্বর এর ২২ তারিখ দাঙ্গা মোকাবেলাই বার্থ এসকুলেস হেলিকপ্টার এ করে তার বাসগৃহ থেকে দুরে কোথাও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যান্ত্রিক সমস্যার জন্য পাইলট হেলিকপ্টার জরুরী অবতরণে বাধ্য হয়। বিক্ষোভকারীরা এসকুলেস কে আটকায় এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী চলা এই দাঙ্গায় প্রাণ হারায় মোট ১১০৪ জন এবং এর ফলাফল হিসাবে রোমানিয়ায় সমাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।
গুজরাট ভায়োল্যান্স-
২০০২ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের গুজরাট রাজ্যের গোধরায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহন করা এক ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শিশু ও মহিলা সহ এতে করে মারা যায় ৫৭ জন। ঘটনার পরপরই এজন্য মুসলমানদের দায়ী করে শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা।যদিও বর্তমানে নিরপেক্ষ তগন্তে জানা গেছে এ ঘটনার জন্য আসলে দায়ী ছিল ঐ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ মোদী। মুসলমান নিধন করতে সে এই ঘূণ্য কাজ করায়। যাই হোক এতে সৃষ্ট দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলমান ও ২৫৪ জন হিন্দু মারা যায়। নিখোঁজ রয়ে যায় আরও ২৩৩ জন।হাজার হাজার মুসলমানকে ছাড়তে হয় ঘরবাড়ি।
ব্লাডি সানডে-
কলকারখানাতে কর্মরত শ্রমিকদের নানা সমস্যা ও এর সমাধানের উপায় খুঁজার জন্য ফাদার গাপন এর নেতৃত্বে লক্ষাধিক মানুষ রুশ সম্রাট দ্বিতীয় সিজার নিকোলাস কে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য উইন্টার প্যালেস এর দিকে রওনা দেয়। শান্তিপূর্ণ এ মিছিল প্রসাদের সামনে আসার আগেই প্রসাদের নিরাপত্তার জন্য থামার নির্দেশ দেয় প্রহরীরা। কিন্তু মিছিল এগিয়ে যেতে চাইলে গুলি শুরু করে পুলিশ। এত সৃষ্ট দাঙ্গা ও ভিড়ের মধ্যে পালাতে গিয়ে পায়ের চাপে পড়ে প্রায় ১০০০ জন মারা যায়। তবে এই দাঙ্গার জন্য সম্রাটকে ঠিক দায়ী করা যায় না। সেই সন্ধ্যাতেই সম্রাট তার ব্যক্তিগত ডাইরিতে এই ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং এত হতাহতে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন যা পরে প্রকাশ পায়।
মুম্বাই রায়ট-
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ইতিহাসের আলোচিত রায়টের মাঝে তিনটিই ঘটেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। উগ্র শিব সেনা কৃর্তক বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর এই জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। ১৯৯২ সালে ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই দাঙ্গা শেষ হয় ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে। প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোক এই দাঙ্গায় জড়িয়ে পরে।আনুমানিক ৯০০ লোক মারা যায় এবং আহত হয় হাজার হাজার।
ইজিপ্টিয়ান ব্রেড রায়ট-
১৯৭৪ সালের দিকে মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত দেশটিতে অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ এর দিকে ঝুঁকেন।বিশ্বব্যাংক এর পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য খাত থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি বাতিল করার ঘোষণা দেন। এসব এর ফলে গণ অসন্তোষ সৃষ্ট হয়। সরকার পুলিশ লেলিয়ে বিক্ষোভ দমন করতে চাইলে শুরু হয় দাঙ্গা যা ১৯৭৭ সালের ১৮-১৯ জানুয়ারি ক্রমান্বয়ে মিশরের সকল প্রধান শহরে ছড়িয়ে পরে। শেষ পর্যন্ত সরকার সংস্কার কার্যক্রম থেকে সরে আসার ঘোষণা দিলে দাঙ্গা বন্ধ হয় তবে ততদিনে মারা যায় ৮০০ জন।
সুয়েটো আপরাইজিং-
১৯৭৬ সালের ১৬ই জুন দক্ষিণ আফ্রিকার সুয়েটোতে শুরু হয় এই দাঙ্গা।তখনকার দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার জাতিবিদ্বেষ ও জাতিগত পৃথকীকরণ নীতির জন্য কুখ্যাত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসাবসরত ককেশিয়ানরা সকল ক্ষেত্রেই নাগরিক সুবিধা পেত কম। কালোরা শিক্ষা ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্যের শিকার হত। এসব কারণে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকে সৃষ্ট হয় এই দাঙ্গার যার ফলাফল প্রায় ৬০০ জনের মৃত্যু।