আমার একঠানা থাকিয়ে থাকাকে উপেক্ষা করে উনি বললেন," সরি।আমার করার কিছুই নাই। অফিসের কাজের চাপ সম্পর্কে তো জানই।"
বস এর রুম থেকে বের হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।আমার চেহারা দেখে এগিয়ে এল কলিগ শাহানা আপা।(একটা ব্যাপার আমি ছোট বেলা থেকেই লক্ষ্য করে আসছি যেসব মেয়ে বয়সে আমার বড় তারা আমার প্রতি সবসময়ই খুব সহানুভূতিশীল হয় আবার যারা ছোট তারা হয় উল্টো। যাদের সাথে টাংকি মারা চান্স আছে তারা কেন জানি আমাকে সহ্য করতে পারে না।)
উনি সব শুনে বলল, "ঠিক আছে মন খারাপ করো না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।"
অফিস সহকারী হাসান আংকেল কে নিয়ে আপা বসের রুমে ঢুকল।
আমি ফোন দিলাম আমার ভাইকে। "ছুটিটা দিচ্ছে না।"
"বল কি! এইজন্যই বলেছিলাম আগে ছুটি ম্যানেজ কর তারপর সব ঠিক কর। এখন তাহলে কি করবে?"ওর গলায় বেশ রাগ।
"কি আর করব,যাব।"
"অফিস থেকে ছুটি না নিয়েই যাবে?"
" হু।অফিস জাহান্নামে যাক আমি যাব।"
প্রায় দশ মিনিট পর বের হল শাহানা আপা আর হাসান আংকেল।চাপা হাসি তাদের মুখে।
বুধবার যাব। মঙ্গলবার বিকালে বস এর কাছ থেকে বলে আসার সময় বিরবির করে বুড়ো মনে হয় বদদোআ দিল আমায়।পরেরদিন বুঝলাম মজা।
আশুগন্জ থেকে ভৈরব স্টেশনে আসতে লাগে ২৫ মিনিট। আমি আবার বরাবরই খুব সতর্ক। তাই তিনটা বাজতেই স্টেশনে। কপাল আর কাকে বলে ঐদিন মহানগর গোধূলী ভৈরব স্টেশনে আসল ৬.৫০ এ।জানালা দিয়ে বাইরে আমাকে খুজছে আমার ফ্রেন্ড আর ছোটভাই। তারা দুজনই ঢাকা থেকে আসল একসাথে।ততক্ষন বসে আর হেটে মেজাজ বিলা আমার। অবশ্য একটা লাভ হয়েছিল বসে বসে ঝিমানোর ফাকে ফাকে এক ভদ্রলোককে দেখে দ্বিধা গল্পটার আইডিয়া পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।
চট্রগ্রাম পৌছালাম রাত সাড়ে বারটায়।রুমে ঢুকে ব্যাগ রেখেই ছুট লাগালাম খাওয়ার জন্য। কিছু খেয়ে ফ্রেশ হয়ে টিভিতে একটু নিউজ দেখে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত ৩টা। মাথাব্যাথা উপেক্ষা করেই সকাল ৭টায় বহাদ্দারহাট নতুন ব্রিজে আমরা।
যাচ্ছি কক্সবাজার।স্বপ্নের কক্সবাজার!
জাতি হিসাবে আমরা অত্যাধিক সৌন্দর্যপ্রিয়। দেশের বেশীরভাগ পিকনিক স্পটই এমন অগোছালো। নোংরা।তাই হিমছড়ির এ হাল দেখে অবাক হইনি মোটেও।
অতিসতর্ক থাকায় আগেই রুম বুক করে রেখেছিলাম প্রবাল এ। গিয়ে দেখি এই বোকামীটা না করলেও চলত।একে তো বহুপরানো প্রবাল এর সুযোগ সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে তারউপর এর চেয়ে অনেক উন্নত হোটেলই ঐসময় অনেক কমে রুম দিচ্ছিল।ফ্রেশ হয়ে গেলাম কক্সবাজার শহরে। ওখানেই লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম ইনানীর দিকে। আমাদের প্ল্যান ছিল সবার শেষে কলাতলী বিচে নামব।ভুল দিয়ে যে ভ্রমণ শুরু তার আরেকটা ভুল হল আমরা ইনানী যেতে ভাড়া করলাম অটোরিক্সা। হিমছড়ি একঘন্টা থামবে ইনানী আধঘন্টা আর আসাযাওয়া। সবমিলিয়ে ৫০০ টাকা। আমি মনে করেছিলাম অটোতে আস্তে আস্তে যাব সময় নিয়ে আরাম করে দেখতে দেখতে বিচের সৌন্দর্য।অটো গুলো যে এত স্লো চলে আর এত ঝাকি তা তো আমি জানতাম না। ইনানী গেলাম। মোটেও ভাল লাগেনি আমার। কেন ইনানী নিয়ে এত মাতামাতি তার কিছুই বুঝলাম না আমি।এর চেয়ে হিমছড়ি অনেক ভাল লেগেছিল আমার।
হিমছড়ি বিচে কাকড়ার তৈরী চিত্রকর্ম। পারবেন আপনি?
ইনানী থেকে রওনা দিতেই প্রায় সন্ধ্যা। কিছুক্ষন আসার পর গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার লাগাল দৌড়। আমরা কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন সে চেচিয়ে বলতে লাগল, ইনানীতে ব্যাটারি চার্জার নাকি ফেলে এসেছে বেটা।হায়রে কপাল।রাস্থাজুড়ে নানা ঝামেলা করে প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে সে আমাদের কলাতলী নিয়ে আসল।এসেই দৌড় লাগালাম সিন্দাবাদের অফিসে। পরদিন সেন্ট মার্টিনস যাব। সব ঠিক করে বের হয়ে হোটেলে পৌছে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে রাত নয়টা। তখন আমরা যাচ্ছি কলাতলী বিচে। এর নাম কপাল! আসলাম কক্সবাজার অথচ মূল বিচটাই দিনের আলোতে দেখা হল না আমাদের।ওখানে অল্পসময় বসে আমরা এলাম অ্যান্জেল ড্রপ এ।এটার ব্যাপারে আগেই ব্লগার পাকা ভাই আমাকে বলে রেখেছিল।অসাধারন এক পরিবেশ রেস্টুরেন্টটার। নীচে সমুদ্রের ভারী ঢেউ গর্জন করছে। যেন ভাসিয়ে নিবে আমাদের সহ। উপরে আমরা তখন নুডলস খাচ্ছি লবস্টার বারবিকিউ এর সাথে। কি যে মুহুর্ত তা বলে বুঝানো যাবে না। আমার কাছে এতদিন মনে হত নীলগিরির উপর মেঘের মাঝে বসে খিচুড়ি খাওয়াটাই আমার জীবনের সেরা খাওয়ার মুহুর্ত। কিন্তু বদলে গেল ঐদিন তা।
নাফ নদীর এ চর/দ্বীপটা জটিল। ওখানে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল আমাদের।
পরদিন নাফ নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বেলা বারটার দিকে আমরা সেন্ট মার্টিনস পৌছালাম। সিন্দাবাদের ভ্রমণটা ছিল বেশ উপভোগ্য। পাশের সিটে বসা এক রুপসীর সাথে অল্পসময়েই বেশ খাতির জমেছিল আমার।
নি:সঙ্গতা।
আগে থেকেই বুক করা ব্লু মেরিন এ উঠলাম।এটাও একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল আমার কারন পশ্চিম দিকে অনেক সুন্দর সুন্দর হোটেল ছিল সাথে বেশ নির্জনও ছিল ওগুলো। ব্লু মেরিন এর পরিবেশটা কেমন যেন বাজারের মত।রুম এ ব্যাগ রেখেই ছুটলাম উত্তরদিকে। বিচে।
পাশে কেউ থাকলে এখানে বসে থাকতে পারি আমি অনন্তকাল।
প্রবালের রাজ্যে ঢুকে মুগ্ধ আমরা।
পাথর হওয়ার অপেক্ষায়।
অবশেষে সমুদ্রে নামতে পারলাম আমরা।অনেকক্ষন লাফালাফি করে হোটেলে ফিরে আসলাম আমরা।সেন্ট মার্টিনস এর মাছভাজার স্বাদ ভুলার নয়। দারুন খাবার। রাতে অনেকক্ষন ছিলাম বিচে। পরদিন সকালে গেলাম ছেড়াদ্বীপে। ওখানে গিয়ে একটা কথাই বের হল মুখ থেকে। এত সুন্দর!চারদিকে নীল সমুদ্র। স্বচ্ছ পানির নীচে খেলা করছে বাহারী মাছ।
প্রাণী হিসাবে আমি সর্বভুক। ব্যাঙ,কাকড়া কিছুই আমি বাদ রাখি নাই। ২০ টাকা পিচ করে দুইটা কাকড়া ভাজি খেয়েছিলাম।
হাটতে লাগলাম আমরা বিচ ধরে। কেয়ার ঝোপে লুকাচুরি,পানিতে ঝাপাঝাপি আর বেসুরা গলায় গান গাওয়া সবমিলিয়ে যেন চলে গিয়েছিলাম হারানো শৈশবে। ঐ সকালটার কথা আমি ভুলবনা বহুদিন।
ঠিক এখানে দোলনা থাকলে বিকালটা না হেটে আমি কাটিয়ে দিতাম এই সোনালী রোদে।
ওখান থেকে ফিরে এসে মোটর সাইকেল ভাড়া নিলাম। ৫০০ টাকা এক ঘন্টা। পুরো দ্বিপটাই চক্কর দিলাম মটর সাইকেলে।মটর সাইকেল নিয়ে আমার আছে নানা সুখের স্মৃতি। বলতে গেলে আমার জীবনের তিনভাগের একভাগ সময় মটর সাইকেলের উপর কাটালেও ঐদিনের মত মজা কখনই পায়নি।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল দ্বীপে যারা বেড়াতে আসে তাদের অনেকেই জানে না এখানে মটর সাইকেল ভাড়া দেওয়া হয়।তাই আমি যখন বিচ ঘিরে মটর সাইকেল চালাচ্ছি তখন অনেকেই বেশ অবাক হয়ে থাকিয়ে রইল।দুই আপুকে আবার ছবি তুলতেও দেখলাম।তবে মটর সাইকেল নিয়ে ঘুরতে গিয়ে লাভ হল দ্বীপটা সুন্দর করে দেখতে পারলাম। বিশেষ করে দক্ষিন দিকের বিচ যেখানে সাধারনত পর্যটকরা যায় না।
সামনে নীল সমুদ্র।চারদিকে নির্জনতা। আমার মনের ডানা উড়ার জন্য আর কি চাই?
ওদিকের নির্জন পরিবেশটা দারুন সুন্দর। একদম নির্জন।
দক্ষিন দিকের নির্জন পরিবেশ।
আমি যতই বলি অফিস আমার ভাল লাগে না। কাজ ভাল লাগে না তবু বলতে গেলে অফিসের জন্যই ঐদিন রাতেই কক্সবাজার থেকে রওনা দিলাম ঢাকায়। সকালে আমার ছোট ভাই আর ফ্রেন্ড এর অনুরোধ না রেখেই বাসায় চলে আসলাম।কারন অফিসে অনেক ঝামেলা।বুড়োবস একা একা সব সামলাতে পারবে না।দিনদিন আমি মনে হয় রোবটই হয়ে যাচ্ছি সাথে দায়িত্ববানও।
সব তো শেষ এবার একটি মজার এড দেখুন। এটা দেখে আমরা যারা নিজেদের বানান ভুল নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকি তারা এই ভেবে সান্তনা পেতে পারি যে এর চেয়ে বেশী বানান ভুল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।