আমেরিকাতে কেউ এক বাসায় সারাজীবন কাটিয়েছে- এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। নানা প্রয়োজন, চাকুরীর নীয়োগস্থল, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ইত্যাদি কারনে সবাই বেশ বাসা বাড়ী বদলায়। আমার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে--এই ২৫ বছর প্রবাস জীবনে বেশ কয়েকবার বাসা বদল হয়েছে--এখন যেখানে আছি, সেটা কিনেছিলাম এগারো বছর আগে, ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে পড়ানো জন্য (এ দেশে এলাকা ভিত্তিক স্কুল-School District)। যে এলাকার স্কুল যত ভালো, ট্যাক্সও তত বেশী! ওদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেশী দাম, বেশী ট্যাক্স, উপরন্ত কাজ থেকে ৩০ মাইল দূরে এই বাসা কিনেছিলাম ২০১০ এ। আমাদের যাতায়াতে কস্ট হত,... কিন্তু বাচ্চারা ভাল স্কুলে যেত, পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ, ছিমছাম এলাকায় থাকত- এটাই দেখে সব কস্ট, পরিশ্রম পানি হয়ে যেত! ওরা এই ভাল School District এর সুযোগ কাজে লাগিয়েছে..দুজনেই আলহামদুলিল্লাহ ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, ...এখন আমাদের বিদায়ের পালা এই বাসা থেকে। কারন, এত ট্যাক্স দিয়ে এখানে থাকার কোন মানে হয়না! আমরা দুজন শুধু এই বাড়ীতে পড়ে আছি, বাসা থেকেই অফিস করছি..তাই ভাবছি এটা বিক্রী করে কম ট্যাক্সের আর আত্মীয়স্বজনের কাছাকাছি এলাকায় চলে যাব। এই বয়সে লোকজনের কাছে থাকতে ভাল লাগে, কারন কোভিডের জন্য সবার মাঝেই একটা ডিপ্রেশন চলে এসেছে! আমাদের বর্তমান বাসার কাছে আত্মীয়স্বজন কেউ থাকেনা। যদিও সেই শহরে গেলে কাজ থেকে আরও ২০ মাইল (টোটাল্ = ৫০ মাইল) দুরে চলে যেতে হবে, তবুও ভাল! একটা পর্যায়ে মানুষ অন্য মানুষের সংগ ছাড়া থাকতে পারেনা!
..এই বাসা আগে কত মুখরিত ছিল বাচ্চদের কেলাহলে, ছুটাছুটিতে, পড়াশোনায়, খেলনাপাতি..কত কিছুতে! একটু করে করে বাসার জিনিসপত্র গোছাচ্ছি, পুরোনো জিনিসপত্র ফেলে দিচ্ছি---আর সেই সাথে বের হয়ে আসছে কত স্মৃতি, কত আবেগ! ছেলেমেয়েদের ছোটবেলার খেলনাপাতি, স্কুলের বইখাতা, গল্পের বই, হারানো পুতুল কতকিছু!..অনেক যত্ন নিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে বাসাটা সাজিয়েছিলাম..দিনের সাথে সেগুলোও আস্তে আস্তে পুরনো, ফিকে হয়ে আসছে! মায়া বড় বাজে জিনিস! অথচ কত বছর আগে আমার প্রিয় মাতৃভুমি, প্রিয় বাসা, আমার সেই হোস্টেলের গোছানো রুম নং ১২৩ ছেড়ে এসেছিলাম! কিভাবে সেগুলোর জন্য দিনের পর দিন কেঁদেছি..একসময় কেমন করে যেন সেই স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে এলো এখানকার নতুন জীবন গোছানোর উত্তেজনায় আর সংসার বড় করার আনন্দে! এখন হৈচৈ, ভরাট সংসার টাও ছোট হয়ে আসছে, ...আবার বাসা বদল, আবার নতুন করে সংসার দুজনের! আর বিকেলের শান্ত রোদের আলোয় মাখা ডেকে বসে আমাদের বাচ্চাদের ছুটিতে বাসায় আসার অপেক্ষা!.... ঠিক যেভাবে আমার বাবা মাও আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেন হাজার হাজার মাইল দূরের সেই ছায়া মাখা, হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে ভরা আমাদের বাড়ীর দক্ষিনের বারান্দায়!
বার্কলি লেনের আমাদের প্রিয় বাসাটি..
কত যত্নেই না সাজিয়েছিলাম বাসাটি
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১:০২