হারিয়েছি অনেক কিছু....
আমি প্রতিদিন নিয়ম করে বেশ কয়েক কিলোমিটার হাটি। তবে ইদানিং হাটাহাটিতে অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন হচ্ছে! এই যেমন, হাটাহাটির টার্গেট মিসিং! যে পথে হাটার কথা, সে পথে না গিয়ে মনের অজান্তেই অন্যকোথাও হেটে যাই। বাড়ির সামনে দিয়ে কয়েকশত মিটার দূরে হেটে চলে যাই।
আমি ৫/৬ তলায় উঠতে সাধারণত লিফটে উঠি না। হেটেই উঠে যাই। কখনো কখনো এমনও হয়েছে- হেটে হেটে নিজের ফ্ল্যাট পেরিয়ে আরও কয়েক তলা উপরে উঠে গিয়েছি। একবার আমার ফ্ল্যাট পেরিয়ে আরও দুই তলা উপরে উঠে দরজা কলবেল বাজিয়েছি। দরজা খুলে দেওয়ার পর যথা নিয়মে ঘরের ভেতর জুতা-মোজা খুলে ভেতরে চলে যেতে যেতে শার্টের বোতাম খুলে ফেলছি- "আংকেল, আপনি কেমন আছেন?"- জিজ্ঞেস করার পর হুশ ফিরে দেখতে পাই- আমি অন্য ঘরে চলে এসেছি!
বার্ধক্যে পৌঁছে অনুভব করি- আমার, আমাদের একটা শৈশব কৈশোর ছিলো। বৈশ্বিক যন্ত্রায়ণ আর বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিতে বর্তমান পৃথিবীতে শিশুরা তাদের শৈশব হারায়, কিশোররা হারায় তাদের কৈশোর। পৌড়রা হারিয়ে তাদের অতীত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী খেটেখুটে খাওয়া মানুষের ঘরের যে শিশুদের হাতে বই ধরার কথা, সে হাত যখন হাতুড়ি ধরে, তখন তারা তাদের শৈশব হারায়। তেমনিভাবে যে কিশোর পড়ার ভারে নুয়ে পড়ে, পরিবারের চাপের কাছে সময় হারায়, তারাও তো তাদের কৈশোর হারায়। উচ্চবিত্ত পরিবারের যে শিশুরা সর্বাধুনিক ইলেট্রনিক্স গ্যাজেটস নিয়ে সময় কাটায়- তারাও হারায় সমাজ আর জগৎ সংসারের কঠিন বাস্তবতা।
কত রকমের হারিয়ে যাওয়া যে আছে জীবনে। কতকিছু যে হারাই- চাবি থেকে চশমা, কলম থেকে বইপত্র, চিঠি থেকে সেলফোন। হারাবার বস্তুর কমতি নেই জীবনে। জিনিস হারাই পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, বাড়ীতে- অফিসে। ঠিকানা হারাই- অনেক বন্ধু স্বজনের বাড়ীর নম্বর হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি ফোন নম্বর!
স্মৃতিও তো হারাই আমরা। ভুলে যাই প্রিয়জনের নাম। ছেলেবেলার বন্ধুরা যখন পড়ন্ত বেলায় সামনে এসে দাঁড়ায়, হাতড়ে বেড়াই কি যে ছিল নামটা- এটা কি বেলাল, না কি রমেন, জোসেফ ও তো হতে পারে। ভুলে যাই দিনক্ষন - জন্মদিন ভুলি, বার্ষিকী বিস্মৃত হই। কত ঘটনার স্মৃতি হারিয়ে যায়!
নিজেকে তো হারিয়ে ফেলি নানান সময়ে- চিন্তায় ডুবে যাই পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে গিয়ে। হারিয়ে ফেলি সত্যিকারের আমিকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই আমিটি কে। আমার নিজের মাঝে শত শত আমিকে দেখি - নিযেকে জানা আমার ফুরোয় না।
অন্যের মাঝেও তো হারায় মানুষ- প্রেমে, মায়ায়, মমতায়। এ হারানোর সুখ আর আনন্দের কি তুলনা চলে? এ হারানো মানুষকে রিক্ত করে না, সিক্ত করে, শূন্য করে না, পূর্ণ করে। এ হারানো মানুষ অনেক সময়ে টের পায় না- হঠাৎই তা হয়ে যায়।
কখনো কখনো বিশ্বাস হারাই মানুষের ওপরে। কখনো হয়তো কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে- সম্পর্কের ক্ষেত্রে, প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে। আর বিশ্বাস ফিরে আসে না- হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। আস্হা হারাই নিয়মে, মূল্যবোধে। আস্হা হারাই রাষ্ট্রের ওপরে, নেতৃত্বের ওপরে। ভাবি রাষ্ট্রে সমতার প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, ন্যায় লঙ্ঘিত হবে না, মানবিকতা রক্ষিত হবে। যখন এর কিছুই হয় না, আমাদের আস্হার জায়গাটি থাকে না!
আবার অনেক মানুষকে অন্যভাবেও হারিয়েছি। বহু মানুষকে যে ভাবে দেখেছি, পরে তাঁরা সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। বহু সম্মানিত মানুষের চারিত্রিক পদস্খলন দেখেছি- তাঁরা আমাদের শ্রদ্ধা আর আস্হা হারিয়েছেন। বহু বান্ধব তাঁদের মত ও পথ বদলেছেন, নানান মোহের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যা তাঁরা হতে পারতেন, তা তাঁরা হন নি, যা তাঁরা করতে পারতেন, তা তাঁরা করেন নি। সুতরাং তাঁদেরও তো আমরা হারিয়েছি, সর্ব অর্থেই। নেতা নৈতিকতা হারায়, জাতি পথ হারায়, দেশ লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে।
অনেক সময়ে হারিয়ে ফেলি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মূল্যবোধ। পরিবর্তনের নাম করে বদলে ফেলি সনাতন মূল্যবোধ। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অস্বীকার করি ঐতিহ্য। নানান স্বার্থ প্রনোদিত হয়ে বদলে ফেলি ইতিহাস। আমাদের দেশের সংস্কৃতি, স্বকীয়তা আর মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এ হারানো বড় কষ্টদায়ক। আমরা বিস্মৃত হই যে, এগুলো হারালে আমাদের আর কিছুই থাকে না।
আমরা তো মানবতাও হারাই। আমাদের ক্রিয়া-কর্মে আমরা প্রায়শ:ই মানবতা বলি দেই - ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে, শুদ্ধির নামে, ক্ষমতার দম্ভে, বিত্তের দাপটে। যখন সমাজে, রাষ্ট্রে যে কোন সংখ্যালঘুরা দলিত হয়, যখন সংখ্যাগুরুদের দ্বারা পিষ্ট হয়, তখন মানবতাকেই হারাই। দীর্ঘ বছর যাবত প্যালেস্টাইনে যা ঘটছে, ভারতে, চীনের উইঘুরে যা ঘটছে তাতো মানবতা হারানোর নিকৃষ্টতম উদাহরণ। চূড়ান্ত বিচারে মানুষ হিসেবে মানবতাকে যখন আমরা হারাই, তখন আমরা যে আর মানুষ থাকি না, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
অনেক কিছু হারানোর পরে এবার নিজেকে হারানোর পালা- যেখানে হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৫৪