ক্রেতা সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বিক্রেতা সবুর করিতে চাহিলেন না । তিনি দেখিলেন ল্যাপির বয়স অবৈধভাবে বাড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু আর কিছুদিন
গেলে সেটাকে লাভ তো দূরের কথা লোকসান দিয়াও কাউকে গছানো যাবে না । ল্যাপির বয়স
বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু বিক্রয়মূল্যের আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিত উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া ।
আমি ছিলাম ক্রেতা । টিউশনির টাকা মারিয়া, বাজারের টাকা হইতে এপাশ ওপাশ করিয়া যে তেরটি হাজার টাকা জমাইয়াছিলাম তাহাতে আমার মতের কোন গুরুত্ব ছিল না । আমার কাজ আমি করিয়াছি, দুইনম্বর উপায়ে কিছু টাকা সরাইয়া নিয়াছি । তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, ক্রেতাপক্ষ ও বিক্রেতাপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত
হইয়া উঠিল ।
ছাত্র সমাজের যার একটি ল্যাপি আছে, তাহার মনে সে নিয়া আর কোন উদবেগ থাকে না । অবস্থা যেমনি, যতই পড়ার চাপ থাকুক, ল্যাপির অভাব ঘুচিবামাত্র
পড়া ভুলিয়া তা নিয়া ঝাপাইয়া পরে ।
আমার এই লেখায় ল্যাপির নাম লুকাইবার কোন স্বার্থকতা নাই । কেননা তাহার বর্তমান অবস্থান
জানিবার পরে আপনারা কেউ আর তাহার কথা স্বরণ করিতে চাহিবেন না । তা হইলে বলিয়াই দেই, ল্যাপির নাম ছিল ডেল ।
সেই ২০০৫ সালের পুরোনো একখান ল্যাপির কাহিনীই আজ আমি আপনাদের শোনাইব । তাহার পূর্ব মালিক ছিল আতিমাত্রায় ডিজুস এবং বডিবিল্ডার । আমরা পারতপক্ষে তাহাকে ঘাটাইতাম না । আর
পাঁচটা ডিজুস পোলাপানের মত সে ও ল্যাপি পাইয়া তাহার উপর ধ্যান জ্ঞান সর্বস্ব করিয়া ঝাপাইয়া পড়িয়াছিল । লেটেষ্ট যত গেমস,
মুভি, গান ও পর্নোষ্টারদের যত স্ক্যান্ডাল সব ল্যাপির ভিতর জমা করিয়াছিল । কিন্তু এত বছরের
অত্যাচার সহিতে না পারিয়া ল্যাপিটি তাহার ব্যাটারির সর্বশেষ শক্তিটুকু দিয়া বাচিয়া থাকার
চেষ্টা চালাইতেছিল । অতএব ল্যাপির এ করুণ অবস্থা আমলে নিয়া সে তাহা বেচিয়া দেওয়াই উত্তম জ্ঞান করিল ।
ল্যাপি কিনার অরুণোদয় হইল বন্ধুদের আড্ডায় । তাহারা টম ক্রজ, এঞ্জেলিনা জোলি লইয়া আড্ডা গরম করিত আর প্রভাময়তায় বুঁদ হইয়া দিনাতিপাত করিত । নাদান আমি কেবল তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া আফসুস করিতাম । অতঃপর একদিন সাহস করিয়া স্থির করিলাম, এইভাবে আর চলিতে দেওয়া যায় না, আমারও একটা ল্যাপি চাই-ই চাই ।
ল্যাপির সাথে আমার প্রথম পরিচয় পাড়ার ডিজুস অর্ক ভাইয়ের রুমে । অযত্ম অবহেলায় তাহার গায়ের রং মলিন হইয়া গিয়াছিল, কীবোর্ডের ছাল উঠিয়া গিয়াছিল । কিন্তু সমস্তটি লইয়া যে মহিমা উপলদ্ধি করিলাম সে আমি বলিতে পারিব না ।
আপনজনের চোখ রাঙানি আর শুভাকাঙ্খীদের নিষেধাজ্ঞা স্বত্তেও আমি তাহাকে হস্তগত করিব বলিয়া মনস্থির করিলাম । কোন এক বিকেল বেলা আমার সর্বশেষ সম্বল তের হাজার টাকার বিনিময়ে সে আমার হাতে আসিয়া পড়িল । এমন আশ্চর্য আর কী আছে, আমার মন বারবার
করিয়া বলিতে লাগিল, 'আমি পাইলাম, আমি উহাকে পাইলাম ।' এ যে দুর্লভ, এ যে ল্যাপি,
ইহার প্রোগ্রামের কি অন্ত আছে ।
অর্ক ভাই চোখ রাঙাইয়া বলিয়া দিল, 'যা দেখার এহনই দেইক্খা ল, পরে আমার কাছে আইলে কইলাম হাড্ডিওয়ালা কাবাব বানাইয়া দিমু ।' আমিও মিনমিন
করিয়া বলিলাম, 'আইতাম না আপ্নের কাছে, সব ঠিকই আছে ।' অতঃপর আমার টাকায় চিকেন
বিরিয়ানি আর এক লিটার কোক খাইয়া তাহার ল্যাপিকে আমার হাতে তুলিয়া দিলেন । বিদায় বেলায় তাহার হাসিমুখে আমি যেন অন্যকিছুর ইঙ্গিত পাইলাম ।
ল্যাপি বগলে করিয়া গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র বাবা আমার কান টানিয়া হুঙ্কার দিলেন, 'হারামজাদা, ৩ বিষয়ে ফেল কৈরা আবার ল্যাপটপ কিনছ, নবাবের পুত তোমার বাবুগিরি আমি যদি না ছুটাইছি ।' মা আসিয়া কহিলেন, 'শখ কত, পড়ালেখার নাম নাই, সারাদিন আড্ডা মারে আবার তুই ল্যাপটপ কিনসছ কোন সাহসে ? টাকা পাইসছ কই ?' আমি দেখিলাম সেখানে দাড়াইলে আমার কৃতকর্মের কথা ফাঁস
হইয়া যায় তাই কোনমতে তাহাদের হাত হইতে ছুটিয়া ঘরে ঢুকিয়া গেলাম ।
ল্যাপিকে পাইয়া আমি যেন
নাওয়া খাওয়া ভুলিয়া গেলাম । সারাদিন উহাতে জমাকৃত মুভি আর রাতের বেলা দরজা আটকাইয়া প্রভাময় স্ক্যান্ডালে মনোনিবেশ করিলাম । লেখাপড়া শিকেয় উঠিল । এদিকে প্রথমদিন হইতে তাহার প্রতি পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুপ মনোভাব
আর আমার ছোট ভাইয়ের লেটেষ্ট গেমসের চাহিদা মিটাইতে যাইয়া ল্যাপির অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিল । উপূর্যপরি বিদ্যুতের আকালের কারণে তাহার ব্যাটারিও শক্তি সঞ্চয় করিতে পারিল না । ফলাফলে তাহার বিবর্ণ কালো রং আরো বিবর্ণরুপ ধারণ করল । কীবোর্ড এর জৌলুশ কমিয়া গেল । শক্তিহীনতায়
ভুগিতে লাগিল । উহার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আমার পকেটও হালকা হইতে লাগিল ।
তিনমাস পর আমার পড়ালেখার অবনতি অবলোকন করিয়া একদিন বাবা আমার ল্যাপিকে কষিয়া একটা আছাড় মারিলেন । জীর্ণ শরীরে সে আঘাত সইতে না পারিয়া ল্যাপি আমার দ্বিখন্ডিত হইয়া গেল । অতঃপর তাহার ঠাই হল বাড়ির ভাগাড়ে । একদিন বাজার করিয়া ফিরিবার পথে তাহার উপর চোখ পড়িয়া গেল । দুষ্ট কাকের দল উহাকে তাহাদের মলত্যাগের আধার বানাইয়া লইয়াছে । তাহার কাজল কালো রং আর চিনিবার উপায় নাই ।
শুনিতেছি ল্যাপিকে লোহা লক্করের
দোকানে বিক্রি করিয়া দেওয়া হইবে । বাড়ির কর্তাদের আদেশ আমি অমান্য করিতে পারিব না ।
কারণ- থাক আর কাজ কী ।