কবিতা আমার সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেছে। সুক্ষ্মানুভূতিগুলো যেদিক থেকে উঠে আসার কথা সে-পথে অকস্মাৎ বন্ধাত্বের আকাল চলছে। কিন্তু অনুভূতির উৎসমুখ ভুলতে দিচ্ছে না─আমি একদা কবিতা লিখতাম। বন্ধুরা প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। যাদের ভালো লেগেছে তারা কবিতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। প্রত্যাখ্যানও করেছেন অনেকে। গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের পর্বগুলো অতিক্রমকালে কবিতার সত্যানুসত্য জেনেছি─কবিতার সংসারকাল এভাবেই অগ্রসর হয়, হতে বাধ্য।
ব্লগে যারা কবিতা লেখেন তাদের অনেকের কবিতাই আমাকে ভাবায় এবং ভেতরে তাদের কাব্যিক অবস্থান জানার তাগিদ অনুভব করি। সেই দিক থেকে কবি আন্দালীবের কবিতা যে স্তর অতিক্রম করেছে আমি সেই জায়গাটিতে যাবার বহুকসরৎ করেছি (স্তর বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা দরকার ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই এর ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারিনি, আগামীর জন্য তুলে রাখলাম)। তবে কবি আন্দালীবের উচ্চারণ সুবলিত।
এক পর্যায়ে বুঝেছি, প্রত্যেক মানুষের বেড়ে উঠার গঠনক্রিয়া ভেতরে যেভাবে সংগঠিত হয়, সময়কালেও সেটা তেমন বদলায় না, চর্চার মাধ্যমে নতুন কিছু উপাত্তের সংযোগ ঘটে মাত্র। এটি অনেকেরই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আমার বেলা তো বটেই।
কিছু কবিতা পাঠের শেষে বিমূর্ত বার্তা পৌঁছে দেয়। কখনও তা ভিন্ন আবার অভিন্নও। সেটাই বলছি। একটি চরণ বেশ শুদ্ধভাবে শুরু হলো (এই শুদ্ধতারও একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন ছিল)। এক সময় এসে দেখা গেলো, লেখক খেই হারিয়ে ফেলেছেন। ভাবের তুঙ্গে নিজে দার্শনিক হবার অপচেষ্টা করছেন। তিনি অবগত হতে অক্ষম, কবিতা কোনো অর্থেই দর্শন নয়। দর্শনমনস্ক হওয়া আর দর্শন এক বিষয় নয়─এই রোদেলাও এটা বুঝে। এ পর্যায়ে এদের কবিতার কী হাল হয়? গুরুন্ডালী। শুরু হয়ে যায় গুরুমারাবিদ্যার কসরৎ। ধাম করে একটি শব্দ বা বাক্যের মাঝখানে কিছু শূন্যতা তৈরি করে দিলাম─নিজের হেয়ালিপনাকে জায়েজ করতে কিছু শব্দ ও বাক্যের ফেনায়িত তুড়ে চেচাতে লাগলাম, দেখো উত্তরাধুনিক, অধিবাস্তবাদ, সমকালের স্পেইস-মার্জিন ধারায় চরম-শুদ্ধ ধারাটি নিয়ে এসেছি। এই যে চিৎকার, এর ভেতর একটি কথাই উপলক্ষ্য─নিজেকে জাহির করা (এটি কখনই প্রকাশ করা অর্থে হবে না, নিজেকে প্রকাশ করার কোনো অন্যায় নয়)। এসব স্থূল-মানস থেকে যাদের কবিতা অনেক দূরে অবস্থান করছে তাদের মধ্যে অন্যতম কবি হচ্ছেন ফকির ইলিয়াস, আন্দালীব, আশরাফ মাহমুদ, পয়েট ট্রি. মুক্তি মন্ডল, অমিত চক্রবর্তী, প্রনব আচার্য্য, শামীম সিদ্দিকী, হানিফ রাশেদীন, ফাহাদ চৌধুরী, কাফি কামাল, (ব্লগে আমার সীমিত পাঠ থেকে)।
এখানে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই কালপুরুষকে। কালপুরুষের মতো কিছু কবি ব্লগে আছেন যারা খুবই নিষ্পাপ ধরনের কবিতা রচনা করেন। সব কালেই এমন একটি ধারা সচল ছিল, থাকে। এই নিরহঙ্কার কবিদের মাধ্যমে মূলত কাব্য পরিবেশকে সুন্দর ও প্রাচুর্যপূর্ণ একটি মাত্রা এনে দেয়। পৃথিবীর কোথাও ঝড় উঠেছে কিংব চৈত্রের রৌদ্র ফেটে পড়েছে। গরমে মানুষের মগজ গলে যাবার উপক্রম। এই প্রকৃতির কবিরা ছায়া ও মায়া নিয়ে আগলে দাঁড়ান।
এই ধারায় আমি যাদের কবিতা ব্লগে পাঠ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : আবু মকসুদ, কাজল রশীদ, শাহ শামীম আহমেদ, কাইয়ূম আবদুল্লাহ প্রমুখ। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্নজনের ব্লগে গিয়ে কবিতা পাঠ ও তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে গিয়ে বেশ তেঁতো-অভিজ্ঞতা অর্জন কেরিছ। এর ভিত্তিতে কবির আচরণ, সমালোচনার সহনক্ষমতা ইত্যাদি পর্যালোচনা হতে পারতো। এটি খুবই স্পর্শকাতর দিক বলেই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলাম।
বিনীতভাবে বলছি, অনেকেরই কবিতা পাঠ করা হয়নি। ভবিষ্যতে পাঠের বাসনা রইলো।
কবিতার সবচে দুর্বল দিক, গুরুচন্ডালী-ধারা। এই ধারায় অনেকেই রয়েছেন। আবার কখনো মনে হয় এরা সবাই একজনই। অর্থাৎ একটি ‘নিক’ কিংবা ‘নামে’র কবিতা থেকে অন্য কবিতাকে আলাগা করা যায় না। সমান্তরাল একই হাত কিংবা একই মানুষ এই কবিতার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সেরকমই তাদের কবিতা ইঙ্গিতবহন করে। এর দুর্বল দিক হলো, জোর করে জাহির করা। নিরন্তর প্রমাণহীনভাবে চাউর করেন, ‘আমি যেসব লিখছি এগুলোই আসল এবং সহি-কবিতা।’ এমন একটি ভুল ধারণাকে প্রতিষ্ঠার জন্যই অসংখ্য নিকের আশ্রয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়া গুরুচ-ালী ধারার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যেনতেনভাবে নিজের কবিতাকে অপ্রচলিত শব্দ-বাক্য-ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকট করে তুলেন। কৃত্রিম এই প্রচেষ্টা খুবই হাস্যকর। বুদ্ধি করে যারা এই কাজটি করেন তাদের বড় দুর্বলতাই হলো অশ্লীলভাবে নিজেকে চাউর করা। গুরুচ-ালদের কৃত্রিম পা-িত্যের কারণ হলো, তারা প্রচ-ভাবে অসহায়ত্বে ভোগেন। অন্যের ধার করা চিন্তা-ভাবনা গুলিয়ে ফেলেন নিজের ভাবনার সাথে। অন্যের ভাবনাকে নিজের মতো ভাবসম্প্রসারণ করাকেই চুড়ান্ত ভাবেন। তাদের এই অসহায়ত্ব কবিতার শরীর ছাপিয়ে উঠে বলেই একটি সম্ভাবনাময় কবিতার অপমৃত্যু ঘটে। এই ধারায় যাদের কবিতা আমি পাঠ করেছি তাদের নাম উল্লেখ করবো না। তবে ভবিষ্যতে যে করবো না সে-খবর আগাম বলতেও চাই না।
নিরহপ্রকৃতির কিছু কবিতা রয়েছে। নিরহ বলতে বুঝাতে চেয়েছি ‘করে নাকো ফুস-ফাস, মারে নাকো ঢুসঢাস’ ধরণের। না নিজের ব্যাখ্যায় নিজেই সন্তুষ্ট নই। তাহলে একটু ব্যাখ্যায় আসা যাক। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ কিছু কবিতা রচনা করেন। সেসব কবিতাকে আমি নাম দিয়েছি কবিতার মতো করে বলা। ক্ষুধা পেলে মানুষ আহার করে, সেটা আহারের উপযোগী যেকোনো কিছু হতে পারে। স্বাদ নিয়ে দেখার প্রবণতা থেকে নতুন নতুন খাদ্যতালিকায় মানুষ অভ্যস্ত হয়। ধরুন একজন নিরিহপ্রকৃতির বাঙালি ক্ষুধা পেলে কেবল ভাতই গলদঃকরণ করেন। তিনি জন্ম থেকেই জেনেছেন এটিই আহারের বস্তু। এ ধরণের অভ্যাসের মধ্যে যেসব কবিতা আমরা চোখে দেখি ও পড়তে বাধ্য হই সেগুলোই নিরহপ্রকৃতির কবিতা বলে গণ্য হয়। সৈয়দ মবনু, আহমদ ময়েজ, এস সুলতানা, সৈয়দ আফসার, ইমন সরওয়া, মুহিত চৌধুরী গঙরা এ প্রজাতীর কবিদের অন্তর্ভূক্ত বলে আমার ধারণা। তবে সময়ে পূণর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে রোদেলা খাতুনের কবিতাকে বাজারী বলে উল্লেখ করলে কোনো দোষের মধ্যে পড়ে না। বক্তব্যধর্মী কবিতাই রোদেলা খাতুনের মূল বিষয়। এতে কবিতার সারকথা বা অবকাঠামো রোদেলাকে ভাবায় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বক্তব্য যখন প্রধান্য পায় কবিতাও এক ধরণের রাজনৈতিক শ্লোগানে রূপ নেয়। যদিও রোদেলা খাতুন কোনো রাজনৈতিক কবিতা এ পর্যন্ত লিখেননি। তবে তার দৃষ্টিক্ষমতাকে কেউ ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
লেখকের সীমিত পাঠের ভিত্তিতে সাময়িক পর্যবেক্ষণে যে কবিতাটি সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে কবি আন্দালীবের নক্ষত্রপাঠ কবিতাটি অন্যতম। আসুন কবিতাটি পূণর্বার পাঠ করি।
উল্লেখ্য, প্রত্যেকের অন্তত একটি করে কবিতা পূণর্পাঠে সংযোজন করলে তৃতীয়ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যেতো। কিন্তু ঘরে ঘরে সবার অনুমতি চেয়ে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনুমতি পেলে সংযোজন করো─এ ধরণের অপেক্ষা আমার একদম সয়নি। এক আন্দালীবই আমাকে দুই সাপ্তাহ অপেক্ষায় রেখেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতায় ক্লান্তিবোধ করছি। এর জন্য সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সময় সকলের সহায় হোক।
নক্ষত্রপাঠ
যিনি আমায় নক্ষত্র চেনালেন, আমি তার নাম ভুলে গেলে
আমাদের চারপাশে এক অপ্রস্তুত রাত নামে, দেয়ালের পাশে
পড়ে থাকে বিদীর্ণ প্রজাপতি! আমি তো চিনেছি সব
বর্ধণশীল ফাটলের দাগ, নিমগ্ন অর্কিড প্রজাতি।
আমি চিনতে শিখেছি মানবিক স্পর্শের ট্যাবু, বাতাসের সুর,
নক্ষত্রপাঠের ব্রেইল পদ্ধতি।