হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য ও অভিযোগ : ১১ মার্চ, দুপুর ২:৩০-এ, এনসিপির অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে এবং আরও কয়েকজনকে ডেকে 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ' গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, ভারতীয় প্রভাবের কারণে এই পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং এতে সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন ও তাপসের নাম উঠে এসেছে।
হাসনাতের ভাষ্যমতে, সেনাবাহিনী এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অপরাধ স্বীকার করানোর মাধ্যমে নতুনভাবে দলকে পুনর্বাসিত করতে চাচ্ছে। তার মতে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে পুনর্বাসনের যে কোনো পরিকল্পনাই জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল হবে। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের লাশের ওপর দিয়েই তা করতে হবে।
হাসনাত আরও অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, এবং তারা রাজি না হওয়ার কারণে তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
সেনাবাহিনীর পাল্টা প্রতিক্রিয়া : হাসনাত আব্দুল্লাহর এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী সদর দপ্তর তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজকে দেওয়া এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় যে হাসনাতের বক্তব্য "সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি"। সেনাসদর এই অভিযোগকেও 'অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার' বলে আখ্যা দেয়।
তবে, নেত্র নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেনাসদর স্বীকার করেছে যে ১১ মার্চ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে হাসনাত ও সারজিসের বৈঠক হয়েছিল। তবে এই বৈঠকটি তাদের আমন্ত্রণে নয় বরং হাসনাত ও সারজিসের আগ্রহেই হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মতে, কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি, বরং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
সারজিস আলমের সংশোধিত বিবৃতি : এনসিপির আরেক শীর্ষ নেতা সারজিস আলম ২৩ মার্চ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে হাসনাতের বক্তব্যের কিছু অংশ সংশোধন করেন। তিনি বলেন, ১১ মার্চের বৈঠকটি সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে নয়, বরং তাদের নিজস্ব আগ্রহেই হয়েছিল। তিনি সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে 'প্রস্তাব' হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে 'অভিমত প্রকাশ' বলে ব্যাখ্যা করেন।
সারজিসের মতে, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বৈঠকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে 'এনাফ ইজ এনাফ' এর মানে হলো, দেশের রাজনীতিতে একটি স্থিতিশীলতা দরকার এবং সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো একপক্ষীয় অবস্থান নিতে চায় না। তবে সারজিস স্বীকার করেন যে বৈঠকে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেনাপ্রধান আওয়ামী লীগের অপরাধ স্বীকার ও নেতৃত্বের পরিবর্তনের ধারণার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
মাসুদ ও পাটোয়ারীর প্রতিক্রিয়া : এনসিপির অন্যতম মুখপাত্র মাসুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "আমাদের দল কোনো চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো দলকে পুনর্বাসন করা হলে তা প্রতিরোধ করা হবে।" তিনি সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাভাবিক বিকাশে কোনো বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
অন্যদিকে, পাটোয়ারী বলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক নতুন মোড়ে রয়েছে, যেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমরা চাই দেশ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হোক এবং জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য পাক।" তিনি আরও বলেন, "সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ থাকা উচিত এবং কোনো দল বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত নয়।"
পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের প্রভাব : হাসনাত, সারজিস, মাসুদ, পাটোয়ারী ও সেনাবাহিনীর বক্তব্য পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে বিবৃতিগুলো একে অপরের সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে না। হাসনাত বলছেন যে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেনাবাহিনী বলছে এটি একটি রাজনৈতিক চাল এবং সারজিস বলছেন এটি মূলত একটি আলোচনা ছিল। মাসুদ ও পাটোয়ারী এই পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে ? : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান ও রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত পদক্ষেপ দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
দেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা একাধিকবার আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। অতীতে সামরিক হস্তক্ষেপের উদাহরণ রয়েছে, যা রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করেছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় আসবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এনসিপির দাবি অনুযায়ী, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক পুনর্বাসনের একটি রূপরেখা তৈরি করছে, কিন্তু সেনাসদর এটি অস্বীকার করছে।
অন্যদিকে, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তারা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য পুনর্বাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। জনগণের আস্থার সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াও এই পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আগামী কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহের ওপর। সেনাবাহিনী যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে, তবে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যথায়, নতুন সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলতে পারি : বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নতুন মোড়ে পৌঁছেছে যেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য, সেনাবাহিনীর পাল্টা বিবৃতি, সারজিস আলমের সংশোধিত বক্তব্য, মাসুদ ও পাটোয়ারীর প্রতিক্রিয়া এক জটিল চিত্র উপস্থাপন করে। আগামী দিনগুলোতে এই বিতর্কের সমাধান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
শাহাবুদ্দিন শুভ
ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক
ahmedshuvo@gmail.com
** দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত, ২৫/০৩/২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:০৯