আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি!’
হ্যাঁ, সত্যিই তাই। রক্ত রাঙা এ মহান দিনকে আমরা কি ভুলতে পারি? ভাষা নিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পিচঢালা রাজপথে বুকের তাজা খুন ঢেলে দেয়ার এমন ঘটনা আর কোনো জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। -
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ - পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।
২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।
অমর একুশেঃ-
অমর একুশে ভাস্কর্য
শিল্পীঃ জাহানার পারভীন
বছরঃ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি
অবস্থানঃ ঢাকা
অমর একুশে ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতর্পণমূলক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী জাহানার পারভীন।
আমাদের ‘বেদখল’ ভাষা-সংস্কৃতঃ-
ভূমি নয় শুধু, বেদখল হতে পারে একটি জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতিও। আমরা তো এমনিতেই মাতৃভাষা বাংলাকে মাতৃভূমি বলতে বেশি ভালোবাসি। তার পেছনে ইতিহাস-করুণ এক বিশাল প্রেক্ষাপট আছে বলেই। কারণ আমরা মাতৃভাষা দখল করার রণক্ষেত্র জয় করেই অগ্রসর হয়েছিলাম মাতৃভূমি জয়ের মহারণের দিকে। সে যুদ্ধেও আমরা জয়ী হলাম। পেলাম স্বাধীন দেশ ও পতাকা। ভাষা পেলাম, যা আমরা চেয়েছিলাম। সে হিসেবে বাংলা ভাষার বিরাজমান দৈন্য পরিস্থিতিকে বেদখল সম্পত্তির সঙ্গে তুলনা করা কিছুতেই অসঙ্গত হবে বলে মনে করি না। জমিজমা কিংবা বস্তু সম্পত্তি বেদখল হলে কখনও পুনর্দখল করা যায় ছলে-বলে-কৌশলে। কিন্তু মানুষের আত্মা ও সংস্কৃতি বেদখল হয়ে পড়লে, তা পুনর্দখল করা কিয়ামত-কঠিন এক কর্মসাধনা হয়ে পড়ে। মানুষের সবকিছু তার আত্মা থেকে উত্সারিত হয়ে বিকশিত হয়, যে যার মতো করে। আত্মাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। কোনো জিনিসের মূল নিয়ন্ত্রক শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে তা আর বিকশিত হতে পারে না কখনও। ভাষা ও সংস্কৃতি—দুটোই মানুষের আত্মার আলপনা। এ আলপনাকে ধ্বংস করা কিংবা উল্টো দিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা যুগ যুগ ধরে মেধা ও মনন ব্যয় করে আসছে এবং তাতে তারা বহুলাংশে সফলও হয়েছে। সফল হয়েছে—এ কথাটা পরিষ্কার হওয়ার পরও দেখা যায়, স্বাধীনতাকামী ও নিজ ঐতিহ্য রক্ষণশীলতার দাবিদাররাও তাদের পাতা ফাঁদে পা ফেলে। আত্মঘাতী কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে আমরা যেন আজ বেহুঁশ। এ আত্মা দখলের কারণেই আজ ভারত উপমহাদেশভুক্ত দেশগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতির লেজেগোবরে অবস্থা।
সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক আক্রমণ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে দাস করে রাখেনি, বরং এসব দেশের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ওপরও চালিয়েছে মহাহত্যাযজ্ঞ। এতে আজ বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষা অনেক হারে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিংবা ধ্বংসের পথে দ্রুত ধাবমান। আর এসবের স্থলে সহজে ঘর করে নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা ভাষা ও সংস্কৃতি। অথচ যে কোনো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিই তাদের বহু শতাব্দীবিস্তৃত সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য। ভাষা এবং সংস্কৃতিই জাতির পরিচয়পত্র ও জীবনপ্রবাহ। কোনো জাতি থেকে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কেড়ে নেয়া মানে তাদের গলা কেটে হত্যা করা। অবশ্য এ কথাও তর্কসম্ভব যে, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্রভাবে একটি পবিত্র ও ইজ্জতযোগ্য জিনিস, নাকি সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সেগুলো নিত্যপরিবর্তনশীল কিছু উপাদান?
রাজনীতি যেখানে অর্থনীতির নটবর, সেখানে এ কথা স্বীকৃত যে, পয়সা যার হাতে, অর্থ কাজ করে যার অঙ্গুলিনির্দেশে, বাজারে তাদেরই ভাষা ও সংস্কৃতির কাটতি। বিশ্বময় বিদ্যমান বাণিজ্যালয়ে আমেরিকা, জার্মান, ফ্রান্স এবং চীনই—বলতে গেলে নমস্য গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত। আমেরিকা একাই অন্যদের গুরুগিরির মহাদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে নিজের বাণিজ্যবৈভব ও অস্ত্রশক্তির জোরে ও হুঙ্কারে। এতে আমেরিকানদের ভাষা ও সংস্কৃতি ‘টিয়াবুলি’র মতো সর্বত্রই অর্চিত ও চর্চিত। আজ, বলতে গেলে, পৃথিবীতে চীনই হলো রফতানিরাজ্যের সম্রাট এবং অর্থনীতির কলনায়ক। তা সত্ত্বেও ইংরেজি ও জার্মান ভাষার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। কারণ চীনের বড় সেলসেন্টার হলো আমেরিকা এবং এটাই চীনের অর্থনীতির প্রাণবায়ু। চীনের অর্থনীতি জার্মানির অপ্রতিরোধ্য শিল্পবাণিজ্যের মোকাবিলা করতে পারে না বলেই চীনের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যাগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি জার্মান ভাষাকেও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে জার্মানিতেও চীনা ও ইংরেজি ভাষা পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকাও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। আমেরিকাতেও জার্মান ও চীনা ভাষার পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এখানে সংস্কৃতিবান ও সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তিদের জন্য চিন্তার বিষয় হলো, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মতো শুচিশুভ্র জিনিস কেন অর্থনীতির নাগপাশে বন্দী হয়ে জীবন কাটাবে? ভাষার এ দৈন্য ও কারুণ্য যতদিন দূর না হবে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে, ততদিন আমাদের দেশে, এমনকি পৃথিবীর কোনো দেশে সুস্থ সংস্কৃতির মুক্তি সূচিত হবে না। ভাষা আন্দোলনের ৬০টি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা কি নিজেদের ভাষা, সাহিত্য ও গ্রন্থনীতির কোনো সুস্থির মোহনায় পৌঁছতে পারলাম?
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমাজবহির্ভূত কোনো পদার্থ নয়। কারণ এগুলোর মূল প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে সমাজ এবং সমাজের সবকিছুকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য এবং নতুন আঙ্গিকে নির্মাণ করার জন্য। অথচ আজকের সাহিত্যব্যক্তি ও দার্শনিকরা সমাজবিচ্ছিন্ন সাহিত্যরচনার জন্য ওত পেতে বসে আছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়ে মোড়ে। আর এটাকেই কেউ কেউ বলছেন অজ্ঞতা ও অধঃপতনের সর্বনিম্ন প্রয়াস। মাতৃভাষা ছেড়ে মানুষ আজ ভিনদেশি ভাষা (বিশেষ করে ইংরেজি) শিখছে অর্থনীতির চাপে পড়ে; চাকরির জন্য। অর্থনীতির ব্যাপারটি যখন মানুষের মরা-বাঁচার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ, সেখানে আমরা কেনইবা আমাদের ভাষাটাকে এমন একটা পর্যায়ে নিতে প্রস্তুত নই, যেখানে মানুষ নিজের ভাষাটাকে বুকে আগলে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। আজ যদি বিদ্যালয়ের বৃত্তাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে ভাষাটাকে নিয়ে যাওয়া না হয় অফিসে-আদালতে, রাজ্যসভায় কিংবা সংসদে, তা হলে ভাষা বা ভাষাসংগ্রাম নিয়ে গর্ব করার অধিকার যে আমাদের থাকবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। সাহিত্যাঙ্গনের গুরুব্যক্তিরা গলা ফাটিয়ে যতই বক্তৃতা করুন, স্লোগান দিন, দিবস পালন করুন, সাহিত্য ও কবিতার সন্ধ্যা উদযাপিত হোক—কোনো কিছুতেই কিছু হবে না, যতক্ষণ না ভাষার অগ্রগতিটা ভাষাবিজ্ঞানের মান্য নিয়মে না হয়। ভাষার গতি, অগ্রগতি ও চলত্শক্তি ভাষার স্বভাবনিয়মের মধ্যেই হয়। মানুষের নিজস্বায়িত নিয়মের লেজুড়বৃত্তি করা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বভাবধর্মে ‘অতি নাজায়েজ’ বলেই গণ্য।
অনেকে এমন জঘন্য ধারণাও পোষণ করে যে, কোনো কোনো সংস্কৃতি বা ভাষা নতুনত্ব বৈরী। কিন্তু চিন্তা করা দরকার, সামনে এগিয়ে চলার পথে কোনো জিনিস যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ জগতে, সেটা হতে পারে একমাত্র এবং একমাত্র চরিত্রের অপবিত্রতা ও অনৈতিক মানসপ্রবণতা, একই সঙ্গে মানুষের অপবিত্র হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা হিংসা-বিদ্বেষও অনতিক্রম্য পাহাড়বত্ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আধুনিকতা ও নতুনত্ব গ্রহণ করার সবুজাভ পথে। তখন নিজের মুখের ভাষার মতো একটি অবিচ্ছেদ্য জীবনাঙ্গের সঙ্গেও শত্রুসুলভ আচরণ করতে বিবেক বাধে না কারও। এতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সাহিত্যের প্রাচীন উপাদানের বহু কিছু আরবি থেকে ধারকৃত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাহিত্যের পরবর্তী পণ্ডিতরা সে ভাষাটিকে নিজেদের সাহিত্যকর্মে যথোপযুক্ত স্থান দিতে রাজি হননি। এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি যে কেউ বোঝেননি তা নয়; বরং আমাদের ভাষার ও সাহিত্যের সর্বজনমান্য গুরুব্যক্তি সৈয়দ আলী আহসান আজীবন কবি-সাহিত্যিকদের আরবিচর্চার প্রতি দরদঝরা আহ্বান জানিয়ে গেছেন।
পৃথিবীতে যত প্রকার প্রেম ও ভালোবাসা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভাষাপ্রেমের স্থান শীর্ষচূড়ায়। মাতৃভাষার ক্ষেত্রে কথাটা অতিমাত্রায় সত্য ও বাস্তব। ভাষাকে ভালোবাসা মানে নিজেকে ভালোবাসা, নিজের আলপনাকে ভালোবাসা, পরিবেশকে ভালোবাসা, সমাজকে ভালোবাসা। নিজের ভাষার প্রতি প্রেম মানে নিজের স্বভাবের সঙ্গে ন্যায়বিচার করার অদম্য প্রয়াস ও আগ্রহ। কারণ যে কোনো ভাষা সমাজ ও দেশের জন্য সুগন্ধিতে ভরা আতরখনি, যা সমাজের মন-মস্তিষ্ককে মুখর করে তোলে নিজের সুবাসে। একটি নতুন চিন্তা, একটি অভিনব ভাবনা এবং একটি অনন্যমধুর কল্পনা উপহার দেয়ার পাশাপাশি ভাষা-সংস্কৃতি সমাজ বিনির্মাণের কাজও চালিয়ে যায় তলে তলে। ভাষার স্বর্ণসুন্দর প্রান্তর মাড়িয়ে আসে সাহিত্যের স্তর। সাহিত্য মানুষের দিল-দেমাগকে শাণিত করে অমিততেজে। সাহিত্য সমাজতত্ত্ব ছাড়াও চিন্তানৈতিক তরঙ্গে উত্তাল একটি সাগরের মতো সতত প্রবহমান। সে প্রবাহের স্রোতোধারাকে উপমায়িত করা যায় আন্দোলনের সঙ্গে। আন্দোলন মানে ডাল-ভাতের আন্দোলন নয়, শিল্পসুন্দর চিন্তানৈতিক আন্দোলন। সাহিত্য হলো মানবজীবনের ভাষা ও বর্ণনার নাম এবং জীবনপদ্ধতির সোনালি শিরোনাম।
বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যাতে বহু জাতি ও জনগোষ্ঠীর বসবাস। বহু সংস্কৃতির মিশ্রিত সংস্কৃতিমোহনা গড়ে উঠেছে এ দেশে। এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চলিষ্ণু পরিস্থিতিজনিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের ঘেরাটোপ, যার ফলে বাংলা একটি জাতীয় ভাষা হওয়া সত্ত্বেও প্রায়োগিকভাবে জাতীয় ভাষা হতে পারেনি। ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারটাও এখানে দলীয় বা গোষ্ঠীগত বিষয়ে পরিণত হতে চলছে। দেখা যাচ্ছে, শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ইংরেজি এবং তাদের সংস্কৃতি ইউরোপীয় সংস্কৃতির বাঙলায়িত রূপমাত্র। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকদের জন্য তো বলতে গেলে ইংলিশ মিডিয়াম ‘অভিজাত’ বিদ্যালয়গুলোতে প্রবেশাধিকারই নেই। ওদের তো বাংলাটাও ভালো করে শেখার সামর্থ্য নেই। কেমন হীনম্মন্যতা আমাদের শাসকশ্রেণীর! তারা যখন বিদেশে যান, তখন কথা বলেন ইংরেজিতে—হোক তা খুব নিচু মানের ভাঙাচোরা ‘বাংলিশ’। আবার অন্যদেশের শাসক শ্রেণী যখন বাংলাদেশে আসেন, তখনও তারা কথা বলেন ইংরেজিতেই। বলতে না জানলে অনুবাদটা করিয়ে নিতে হয় অন্যকে দিয়ে। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি কার্যালয়গুলোতে কথা চলে ইংরেজিতে। বেচারা জনসাধারণ তা দেখে নিজেদের ভাষার কর্মক্ষমতার ওপর সন্দিহান হয়ে বসে। এতকিছু সত্ত্বেও বাংলাকে আমাদের জাতীয় ভাষা বলাটা কেমন এক ‘উজ্জ্বল’ মিথ্যা এবং আত্মপ্রবঞ্চনাই মনে হয়। ভাষা সম্পর্কে সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রক্ষণশীল মানসিকতা ভাষাকেই গলা কেটে হত্যা করার নামান্তর। ভাষার ওপর সব মানুষেরই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকা চাই। ভাষার ওপর পুঁজিবাদী অর্থনীতির আধিপত্য কিছুতেই বরদাস্ত করার মতো নয়। অর্থ কখনোই ছড়ি ঘোরাতে পারে না ভাষা ও সাহিত্যের ওপর।
সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামপ্রদায়িক ‘দাঙ্গাবাদ’— এসব বাদ-মতবাদই মূলত সুস্থ ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার চরম শত্রু। এশিয়ার পরমুখাপেক্ষী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব ভাষা এবং বিশেষ করে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এ কথাটা বিশেষভাবে সত্য। এসব বাদই গরিব দেশের জনগণের সবকিছু কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে দেয়। এসব শত্রু যুগে যুগে ভোল পাল্টায়। চেহারায় রঙ মাখে ভিন্ন ধারায়। বড়দের লেখা ও বক্তৃতায় এসব বাদের বিরুদ্ধে কখনও কখনও কিছু কপট স্লোগানও শোনা যায়।
কিন্তু এসব স্লোগান সেসব বাদের মনে দূরের কথা কানেও পশে না। ভাষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনের ‘মান্যবর’রাও, আজকাল দেখা যাচ্ছে, পত্রপত্রিকায় এসব নিয়ে লিখছেন। এই আমার লেখাটা যখন তৈরি করছি, তখন দৈনিক আমার দেশে ছাপা হলো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রবন্ধ ‘বাংলা ভাষার বড় শত্রু পুঁজিবাদ’। বড় সত্য কথা উচ্চারণ করেছেন তিনি। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো, এ সর্বনাশা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তারা কার্যকর কি পদক্ষেপ নিয়েছেন; বরং তাদের অনেককে দেখা যায়, পুঁজিবাদের মূল নায়কদের কোলঘেঁষে বসে সর্বদা জিভ বের করে ঝিমোন। অন্যসব বাদ দিয়ে শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির কথাই যদি বলি, তাহলে বলব, এঁরা কি বুকে সত্ সাহস নিয়ে পুঁজিবাদীদের একটি অনুষ্ঠান কিংবা একটি আমন্ত্রণপত্রও বর্জন করতে পেরেছেন? এসব প্রশ্ন আজ খাঁটি বাংলাপ্রেমিকদের দিল-দরিয়ায় বইয়ে দিচ্ছে উত্তাল তরঙ্গ। এখন সবার এক আওয়াজ : আমাদের বেদখল ভাষা-সংস্কৃতি উদ্ধার হবে কখন এবং কীভাবে?
তথ্যসুত্র :-
১। ইউকিপিডিয়া
২। মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ হাসসান কলামিস্ট
৩। নেট।