ফরাসি উদ্ভাবক জোসেফ নিসেফোর নীপ্স (১৭৬৫–১৮৩৩)-কে বলা হয় ফটোগ্রাফির জনক এবং বিশ্বের প্রথম সফল ফটোগ্রাফার। তিনি বিশ্বের প্রথম ফটোগ্রাফটি তৈরি করেন ১৮২২ সালে। এটি ছিল পোপ সপ্তম পিউসের একটি প্রতিকৃতির ফটোগ্রাফ। কিন্তু এর একটি কপি তৈরি করতে গিয়ে এটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই একই পদ্ধতিতে তৈরি উপরের ফটোগ্রাফটিকেই বিশ্বে ফটোগ্রাফির প্রথম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। সতের শতকের একটি খোদাই করা ফ্লেমিশ চিত্রকর্মের উপর ভিত্তি করে নীপ্স এটি তৈরি করেছিলেন ১৮২৫ সালে। তবে ২০০২ সালে এই ফটোগ্রাফটি আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত নীপ্সের তোলা নিচের ছবিটিকেই বিশ্বের প্রথম ফটোগ্রাফ বলে ভাবা হত।
‘View from the Window at Le Gras’ নামক উপরের এই ছবিটি নীপ্স তুলেছিলেন ১৮২৬ সালে। ফটোগ্রাফির ইতিহাসে খুবই বিখ্যাত এই ছবিটিকে বলা হয় প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রথম সফল স্থায়ী ফটোগ্রাফ। ছবিটি ডেভেলপ হতে আট ঘন্টা সময় লেগেছিল বলে এটি ঝাপসা এবং এই সময়ের মধ্যে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ায় ছবিতে অট্টালিকার উভয় পাশই আলোকিত। একই দৃশ্যের ফটোগ্রাফ যদি আজকের দিনে তোলা হত, তবে তা দেখাত অনেকটা নিচের ছবিটির মত।
১৮৩৫ সাল: প্রথম নেগেটিভ থেকে পজিটিভ ছবি
প্রথম দিকের ফটোগ্রাফিতে নেগেটিভের কোন বালাই ছিল না, বরং ছবির সরাসরি পজিটিভ তৈরি করা হত। ফলে একই ফটোগ্রাফ থেকে বারবার কপি তৈরি করা যেত না। ১৮৩৫ সালে হেনরি ফক্স ট্যালবট নামের একজন ব্রিটিশ উদ্ভাবক সর্বপ্রথম নেগেটিভ থেকে পজিটিভ করে ছবি তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং নিচের ছবিটি হল এই পদ্ধতিতে তোলা বিশ্বের প্রথম ছবি। এতে নেটের পর্দা লাগানো একটি জানালার নেগেটিভ ও পজিটিভ ছবি পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে।
১৮৩৮ সাল: প্রথম ছবি যাতে মানুষ রয়েছে
লুই দাগ্যায়ার নামের একজন ফরাসি উদ্ভাবক ১৮৩৮ সালে প্যারিসের একটি রাস্তার এই ছবিটি তোলেন, যাতে প্রথমবারের মত একজন সত্যিকারের মানুষ দৃশ্যমান। ছবিটি ডেভেলপ হতে দশ মিনিট সময় লেগেছিল বলে রাস্তার অন্যান্য চলমান লোকজন ও গাড়িঘোড়া দৃশ্যটি থেকে মুছে গেছে। ছবিতে রয়ে গেছে শুধু রাস্তার মোড়ে সেই দশ মিনিট ধরে স্থিরভাবে দাঁড়ানো নিচের মানুষটি, যিনি সম্ভবত জুতা পালিশ করাচ্ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে, তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। আর দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁর পরিচয় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।
১৮৩৯ সাল: প্রথম পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফ
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় বসবাসরত রবার্ট কর্নেলিয়াস নামের একজন ডাচ রসায়নবিদ ১৮৩৯ সালে নিজের এই ছবিটি তোলেন। এটি হল বিশ্বের প্রথম পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফ।
১৮৬০ সাল: আকাশ থেকে তোলা প্রথম ছবি
আকাশ থেকে বিশ্বের প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন ফরাসী ফটোগ্রাফার ও বেলুনবিদ ফেলিক্স নাদার ১৮৫৮ সালে। উড়ন্ত বেলুন থেকে তোলা ছবিটি ছিল একটি ফরাসি গ্রামের। কিন্তু সেই ছবিটির এখন আর কোন অস্তিত্ত্ব নেই। বরং আকাশ থেকে তোলা সবচেয়ে প্রাচীন এবং এখন পর্যন্ত টিকে থাকা নিচের ফটোগ্রাফটি তোলা হয়েছিল এর দু’বছর পর, ১৮৬০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরের এই ছবিটি তুলেছিলেন জেম্স ওয়ালেস ব্ল্যাক।
১৮৬১ সাল: প্রথম রঙিন ছবি
বিশ্বখ্যাত স্কটিশ বিজ্ঞানী জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৫৫ সালে সর্বপ্রথম তিন রঙা ফিল্টার ব্যবহার করে ত্রিবর্ণ পদ্ধতিতে (three color process) রঙিন ছবি তোলার ধারণা প্রদান করেন। এর উপর ভিত্তি করে তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৮৬১ সালে টমাস সাটন বিশ্বের প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফটি তোলেন। এটি ছিল একটি রঙিন চেকযুক্ত ফিতার ছবি।
১৮৭৭ সাল: প্রথম রঙিন ল্যাণ্ডস্কেপ ফটোগ্রাফ
উপরের ছবিটি দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি শহরের এবং এটি বিশ্বের প্রথম রঙিন ল্যাণ্ডস্কেপ ফটোগ্রাফ। লুই দুকো দ্যু হারো নামের একজন ফরাসি উদ্ভাবক তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত ‘বর্ণ বিয়োজন’ (subtractive color) পদ্ধতিতে এই ছবিটি তোলেন। রঙিন ছবি তোলার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এটিই হচ্ছে মৌলিক পদ্ধতি। তবে পদ্ধতিটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী হতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছিল।
১৮৭৮ সাল: প্রথম চলমান বস্তুর ছবি
ছুটন্ত ঘোড়ার চারটি পা কি একসাথে কখনও মাটি ছেড়ে শুণ্যে উঠে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে ১৮৭৮ সালে এডওয়ার্ড মব্রিজ নামে একজন ইংরেজ চিত্রগ্রাহক সর্বপ্রথম পর পর কয়েকটি ক্যামেরা বসিয়ে দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার ছবি তোলেন। বিশ্বের প্রথম চলমান বস্তুর ছবি তোলার এই পদ্ধতি থেকেই পরে জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের ধারণা। একই সাথে সৃষ্টি হয় ফটোগ্রাফির একটি নতুন শাখা, যার নাম হাই স্পীড ফটোগ্রাফি। হাই স্পীড ফটোগ্রাফির অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য জগত নিয়ে আমার একটি পোস্ট দেখতে পাবেন এই লিংকে।
১৮৯৩ সাল: পানির নিচে তোলা প্রথম ছবি
পানির নিচে প্রথম ছবি তোলেন উইলিয়াম থম্পসন ১৮৫৬ সালে। দক্ষিণ পশ্চিম ইংল্যাণ্ডের ডরসেট উপকূলে পানির নিচে সাধারণ ক্যামেরা নামিয়ে সেই ছবিটি তোলা হয়েছিল, যার কোন অস্তিত্ত্ব এখন আর নেই। পানির নিচে ছবি তোলার উপযোগী সত্যিকারের ক্যামেরা তৈরি করেছিলেন ফরাসি উদ্ভাবক লুই বুটান এবং তা দিয়ে তিনি ১৮৯৩ সালে পানির নিচের প্রথম সফল ছবিটি তুলেছিলেন, যা এখনও টিকে আছে।
১৮৯৬ সাল: প্রথম এক্সরে ছবি
বিয়ের আংটি পরা এই এক্সরে হাতটি অ্যানা বার্থা নামের একজন মহিলার। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম কনরাড রান্টজেনের স্ত্রী। ১৮৯৫ সালের শেষদিকে এই বিজ্ঞানী পরীক্ষাগারে গবেষণা করার সময় দেখতে পেলেন, ব্যারিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ নতুন এক ধরণের রশ্মি বিকিরণ করছে। তারপর এই রশ্মির সাহায্যে তিনি বিশ্বের প্রথম এক্সরে ছবিটি তুললেন। এর ফলে প্রথমবারের মত কাটাছেঁড়া ছাড়াই মানবদেহের অভ্যন্তরের দৃশ্য দেখা সম্ভব হল। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯২৬ সাল: পানির নিচে তোলা প্রথম রঙিন ছবি
উপরের ছবিটি পানির নিচে তোলা প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফের। মেক্সিকো উপসাগরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফার চার্ল্স মার্টিন ও ডঃ উইলিয়াম লংলি ১৯২৬ সালে আরো কয়েকটি ছবিসহ হগ মাছের এই ছবিটি তুলেছিলেন। পানিরোধক বিশেষ ক্যামেরা ধারক ব্যবহার করে এবং শক্তিশালী বিস্ফোরণের ঝলকানির সাহায্যে সাগরতল আলোকিত করে এই ছবি তোলা হয়েছিল, যা পরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল।
১৯৪৬ সাল: মহাকাশ থেকে তোলা প্রথম ছবি
এই ছবিটি কোন মানুষের তোলা নয়। বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী সোভিয়েত রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে গিয়েছিলেন ১৯৬১ সালে, অথচ এটি তোলা হয়েছে ১৯৪৬ সালে! আসলে এটি মহাকাশে প্রেরিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানুষবিহীন ভি-২ রকেট থেকে তোলা, যাতে একটি ৩৫ মিলিমিটার মোশন ক্যামেরা সংযুক্ত ছিল। ১৯৪৬ সালের ২৪ অক্টোবর তারিখে নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জ থেকে এই রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। ছবিটি পৃথিবীর বায়ূমণ্ডলের বাইরে ভূমি থেকে ৬৫ মাইল উচ্চতায় রকেট থেকে ধারণ করা।
১৯৫৭ সাল: প্রথম ডিজিটাল ছবি
বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল ছবিটি কোন ডিজিটাল ক্যামেরার সাহায্যে তোলা হয়নি, কারণ তখন ডিজিটাল ক্যামেরাই আবিষ্কৃত হয়নি! রাসেল কার্শ নামের এক আমেরিকান বিজ্ঞানী ১৯৫৭ সালে বিশ্বের প্রথম স্ক্যানারের সাহায্যে তাঁর তিন মাস বয়সী সন্তানের ফটোগ্রাফ স্ক্যান করে নিচের ডিজিটাল প্রতিচ্ছবিটি তৈরি করেন।
১৯৬৬ সাল: চাঁদ থেকে তোলা পৃথিবীর প্রথম ছবি
১৯৬৬ সালের ২৩ আগস্ট তারিখে চাঁদ থেকে তোলা পৃথিবীর এই প্রথম ছবিটি তুলেছিল লুনার অরবিটার-১ নামের নভোযান। ২ লক্ষ ৩৬ হাজার মাইল দূর থেকে তোলা এই ছবিতে নাকি রাতের আঁধারে ঢাকা তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের পূর্বাংশে অবস্থিত অর্ধেক পৃথিবী দৃশ্যমান।
১৯৬৮ সাল: চাঁদ থেকে তোলা পৃথিবীর প্রথম রঙিন ছবি
এই ছবিটির নাম পৃথিবীর উদয় (Earthrise)। অ্যাপোলো-৮ নভোযানের নভোচারীরা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবীর এই রঙিন ছবিটি তুলেছিলেন। তারা তখন চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ৩৫০ মাইল উপরে অবস্থান করছিলেন। পৃথিবী থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল দূর থেকে তারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন চাঁদের দিগন্তে পৃথিবীর উদয় হওয়ার এই অপার্থিব দৃশ্যটি।
১৯৭২ সাল: মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর প্রথম রঙিন পূর্ণ অবয়ব বিশিষ্ট ছবি
এই বিখ্যাত ছবিটির নাম ‘নীল মার্বেল’ (Blue Marble)। এটি আমাদের পৃথিবী নামের গ্রহটির প্রথম রঙিন পূর্ণ অবয়ব বিশিষ্ট ছবি। ১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে অ্যাপোলো-১৭ নভোযানের নভোচারীগণ পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদের পানে যাওয়ার সময় এই ছবিটি তোলেন। সূর্য তাঁদের পেছনে থাকায় উজ্জ্বলভাবে আলোকিত নীল গ্রহটির অসাধারণ প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছিল তাঁদের ক্যামেরায়।
১৯৭৫ সাল: ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা প্রথম ছবি
উপরের ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কোডাক ল্যাবরেটরিতে ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা বিশ্বের প্রথম ছবি। এর এক বছর আগে, ১৯৭৪ সালে কোডাকের অ্যাপ্লাইড ইলেকট্রনিক্স রিসার্চ সেন্টারের প্রকৌশলী স্টিভেন স্যাসনকে একটি ইলেক্ট্রনিক স্টিল ক্যামেরা উদ্ভাবনের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরের বছর তিনি সাড়ে আট পাউন্ড ওজনের বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরাটি তৈরি করেন, যা চালাতে ১৬টি ব্যাটারি লাগত। মজার ব্যাপার হল, এই ক্যামেরাটি ক্যাসেটের ফিতায় ছবি ধারণ করত। আর তখনও আবিষ্কৃত হয়নি কমপ্যাক্ট ডিস্ক, পার্সোনাল কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট।
১৯৯২ সাল: ইন্টারনেটে প্রকাশিত প্রথম ছবি
সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভায় অবস্থিত ইউরোপীয় আণবিক গবেষণা সংস্থা (CERN)-এ কর্মরত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার টিম বার্নার্স লি ১৯৯২ সালে ইন্টারনেটভিত্তিক ‘World Wide Web’ উদ্ভাবন করেন। সার্নে কর্মরত মেয়েদের একটি প্যারোডি গানের দল হচ্ছে ‘Les Horribles Cernettes’ বা ‘The Horrible CERN Girls’। ১৯৯২ সালে স্যার টিম বার্নার্স লি এই গানের দলের সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁর এক সহকর্মীকে দলটির কয়েকটি ছবি স্ক্যান করে দিতে বলেন। নিচের ছবিটি হল সেই গানের দলের একটি ছবি, যা প্রথম ছবি হিসেবে ইন্টারনেটে বিশ্বের প্রথম ওয়েব সাইট ‘info.cern.ch’-এ আপলোড করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র:
১। উইকিপিডিয়া: হিস্ট্রি অব ফটোগ্রাফি।
২। উইকিপিডিয়া: টাইমলাইন অব ফটোগ্রাফি টেকনোলজি।
৩। দ্য ওয়াণ্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব আর্লি ফটোগ্রাফি ও অন্যান্য।
৪। আমার লেখা ব্লগ