গ্রামের মেঠো পথের আঁকা-বাঁকা রাস্তা দিয়ে রহিম ভাইয়ের মোটরসাইকেলের পিছনে বসে ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাচ্ছিলাম দু’'জন; উদ্দেশ্য ’মাটির বাড়ি’ দেখবো। দিনাজপুরবাসী হয়েও আমার সহকর্মী রহিম ভাই দোতলা ’মাটির বাড়ি’র নামই শুধু শুনেছেন, ওখানটায় যাননি কখনও। তাই যখন আমি যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলাম, তিনি সানন্দে রাজী হলেন তার মোটরবাইকে করে আমাকে নিয়ে যেতে।
১৫ অক্টোবর, ২০১১। বেলা পৌনে এগারোটায় আমরা মাটির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। অবাক বিস্ময়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দু'’জনের মুখ থেকেই কোন কথা বের হচ্ছিলনা। লোকমুখে অনেক শুনেছি এই অবিশ্বাস্য স্থাপত্য কীর্তির কথা। আজ নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো।
অ্যানা হেরিংগারের মাটির বাড়ি
বিখ্যাত স্থপতি অ্যানা হেরিংগারের পরিকল্পনায় তৈরি মাটির বাড়ি
কাজের প্রয়োজনেই বেশ কিছুদিন হলো দিনাজপুর শহরে ছিলাম। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত একটানা কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছি। ভাবছিলাম কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়া দরকার। এমন সময় ব্লগার
Veja_kak
ঢাকা থেকে ফোন করে জানালো, দিনাজপুর শহরের আশেপাশেই স্থাপত্যকলার এক অবিশ্বাস্য নিদর্শন ’মাটির দোতলা বাড়ি’ রয়েছে, ওটা যেন সময় করে দেখে আসি। তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত নিলাম, ঘুরতে যদি যেতে হয়, তাহলে মাটির বাড়ি-ই দেখতে যাবো।
স্থপতি অ্যানা হেরিংগারের পরিকল্পনায় তৈরি মাটির বাড়ি যা এখন দীপশিখা এনজিও-এর অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দিনাজপুর শহরের স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানলাম, ব্যাংকালী নামক একটি যায়গায় মাটির বাড়ি রয়েছে। রহিম ভাইকে নিয়ে রওনা দিলাম ব্যংকালীর জনৈক অজিত সরকারের সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওখানে পৌঁছানোর পর অজিত সরকারের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তার সাথে কথা বলে জানলাম, ’মাটির তৈরি’ দোতলা বাড়িটি আসলে দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলা থেকেও আরও ৬-৭ কিলোমিটার ভিতরে রুদ্রপুরে অবস্থিত। ওই স্থানটি বিরল উপজেলার মধ্যেই পড়ে। কিন্তু যেতে হবে কাহারোল উপজেলা হয়ে রুদ্রপুরে।
ব্যাংকালী থেকে দীর্ঘ প্রায় একঘন্টা মোটরসাইকেল জার্নি শেষে আমরা দীপশিখা এন.জি.ও এর অফিস ’মাটির সেই বিখ্যাত দোতলা বাড়ি’তে পৌঁছালাম। ওখানকার চীফ ইন্সট্রাকটর জনাব রোমান বিশ্বাস আমাদেরকে অভিবাদন জানালেন। তার সাহায্য নিয়েই ঘুরে দেখলাম মাটির তৈরি দু’'টি দোতলা বাড়ি। আর সেই সঙ্গে জেনে নিলাম এর ইতিহাস।
মাটির তৈরি দোতলা বাড়ির ইতিহাস:
সম্পূর্ণ বাঁশ এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাটির এই দোতলা বাড়ির সংখ্যা দুইটি। ২০০৬ সালে প্রথম যে বাড়িটি তৈরি হয়, সেই প্রোজেক্টটির নাম ছিল ’'রুদ্রপুরের METI – Handmade School'। দোতলা এই স্কুলটির নিচ তলায় তিনটি কক্ষ এবং উপরের তলায় দুইটি কক্ষ রয়েছে। অস্ট্রিয়া এবং জার্মানীর বিজ্ঞ ব্যাক্তি ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি এই প্রোজেক্টের সাথে তখন জড়িত ছিলেন।
এই বাড়ি দু'টি বানানো হয়েছে মূলত: দীপশিখা এনজিও-এর দু'’টি শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম - Education and Training Institute (METI) Ges Dipshikha Electrical Skill Improvement [DESI] project -–এর জন্যে। এই দু’টি প্রোগ্রামের মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সৃজনশীলতার চর্চা করাই ছিল প্রোগ্রাম দু'টির উদ্দেশ্য।
METI (Modern Education and Training Institute) Project:
স্থপতি: Anna Heringer, Eike Roswag
মূল পরিকল্পনাকারী: Anna Heringer
রুদ্রপুরের METI – Handmade School
টেকনিক্যাল পরিকল্পনাকারী: Eike Roswag
মেটি প্রোজেক্টের স্কুল
মেটি প্রোজেক্টের স্কুল-এর নিচতলা
একনজরে মেটি প্রোজেক্ট
যাদের জন্যে এই প্রোজেক্টটি করা হয়েছে: Dipshikha/METI
(Modern Education and Training Institute), Bangladesh
in cooperation with Partnerschaft Shanti – Bangladesch
and the Kindermissionswerk Aachen
মেটি স্কুলের দোতলায় যাবার সিঁড়ি
DESI Project
(Dipshikha Electrical Skill Improvement project):
মেটি প্রোজেক্টের দুইতলা বাড়ির মতোই বাঁশ এবং কাদামাটি দিয়ে দ্বিতীয় যে অবিশ্বাস্য স্থাপত্যকলার নিদর্শন স্বরূপ দ্বিতীয় বাড়িটি তৈরি হয়, তা প্রথম বাড়িটির একদম কাছেই, একই কম্পাউণ্ডের ভেতরে। ১৭ অক্টোবর, ২০০৮ এটি উদ্বোধন করা হয়। এই দোতলা বাড়িটি শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকলার জন্য ২০০৭ সালে 'ট্রাইনিয়াল আগাখান' পদকে ভূষিত হয়। এই বাড়িটি ’'দীপশিখা’' এনজিও-এর অফিস কার্যের জন্যে তৈরি করা হয়। পরিবেশ-বান্ধব এই বাড়িটিতে দীপশিখার ছাত্রদের বৈদ্যুতিক দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ দেশী উপাদানে তৈরি পুরো বাড়িটি সোলার পাওয়ার সিস্টেমে চলে। বাড়ির ভেতরে দু’টি পাওয়ার জেনারেটরও স্থাপন করা হয়েছে।
দীপশিখা অফিস
দীপশিখা অফিসের দ্বিতীয় তলা
দীপশিখা অফিসের দ্বিতীয় তলা থেকে তোলা ছবি
ক্লাস রুম
ক্লাসরুমের ভেতরে পাওয়ার সাপ্লাই কাজে ব্যবহৃত ব্যাটারী
দুইতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটির মূল নক্সা করেছেন বিখ্যাত স্থপতি Anna Heringer। এ বাড়িটির নিচ তলায় প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং-এর জন্যে একটি ক্লাসরুম, ২ টি অফিস রুম, স্যানিটারী ইউনিট, টেশনিক্যাল রুম এবং স্টোর রুম রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় ১ টি ক্লাসরুম, বারান্দা, শিক্ষকদের থাকার দু’টি রুম এবং ২ টি টয়লেট রয়েছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে শেষ হয়।
দোতলার ক্লাসরুম
দীপশিখা অফিসের দ্বিতীয়তলায়
চীফ ইন্সট্রাকটর রোমন বিশ্বাসের রুমের সামনে; তার রুমের ভেতরের দেয়ালে দেখলাম শীতলপাটি দিয়ে মোড়ানো রয়েছে।
ইলেকট্রিক্যাল ছাত্রদের জন্যে নিচতলায় রয়েছে একটি প্র্যাকটিকাল রুম
কে এই অ্যানা হেরিংগার?
১৯৭৭ সালের ১৩ অক্টোবর জার্মানীর রোসেনহেইম শহরে অ্যানা হেরিংগারের জন্ম। পরবর্তীতে লোফেন শহরে তিনি বেড়ে উঠেছেন। বর্তমানে অস্ট্রিয়ার সালসবুর্গ শহরে তিনি বসবাস করছেন। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকেই সোস্যাল সার্ভিস কাজে ভলান্টিয়ার হিসেবে তার বাংলাদেশে আগমন।
অ্যানা হেরিংগার
১৯৯৯-২০০৪ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার 'লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ে'র আর্কিটেকচারাল স্টাডিজ-এর উপর তিনি পড়াশুনা করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি প্রোফেসর রোনাল্ডের তত্ত্বাবধানে ““'School–handmade in Bangladesh””' নামক একটি ডিপ্লোমা প্রোজেক্ট পরিচালনা করেন।
অ্যানা হেরিংগার
২০০৫ সাল থেকে তিনি BASE habitat -এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ই তিনি METI-school project-এর জন্য ফাণ্ড রেইজ, প্ল্যানিং ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়েন। এই প্রোজেক্টটি মূলত: Eike Roswag এবং Shanti Partnerschaft–Bangladesh এর সহযোগীতায় ’'দীপশিখা’' নামক একটি এনজিও পরিচালনা করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি Shanti Partnerschaft–Bangladesh -এর ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লিন্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন।
মহিয়সী অ্যানা হেরিংগার
অ্যানা হেরিংগার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে এখানে ক্লিক করুন
দীপশিখা সম্পর্কে জানতে হলে যোগাযোগ করুন:
২৮২/৫, ১ম কলোনী, মাজার রোড, মিরপুর-১, ঢাকা ১২১৮, ফোন: ৯০০০৭৮২ (এক্সেনশন ১০৪)
না বলা কথা:
কিভাবে ঢাকা থেকে দিনাজপুর গিয়েছিলাম এবং ফিরে এসেছি?
এবার দিনাজপুর গিয়েছিলাম ট্রেনে, ফিরেছি বাসে। ট্রেন জার্নিটাই আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে (র্যাডিসন হোটেলের পাশে) '’নীলসাগর'’ ট্রেনের এসি কামরায় যখন উঠে বসলাম, তখন সকাল ৮.২৫ বাজে। ভাড়া ৪৪৩/= টাকা। বিকাল ৫ টায় দিনাজপুরের ’ফুলবাড়ি’ স্টেশনে নেমে পড়লাম। ওখান থেকে রিক্সা করে দিনাজপুরগামী মেইল বাসের কাউন্টারে নামলাম। মেইল বাস আমাকে ৫০ মিনিটে নামিয়ে দিলো দিনাজপুর শহরে।
ফেরার পথে ’নাবিল’ এসি বাসের চমৎকার সার্ভিস ভালো লাগলো। ভাড়া পড়লো ৮০০ টাকা। সকাল ১০ টায় রওনা দিয়ে ঢাকার গাবতলী নাবিল কাউন্টারে পৌঁছেছি রাত ৮ টায়।
দিনাজপুর শহরে কোথায় থেকেছি?
শুরুতে ভেবেছিলাম, হোটেল ডায়মণ্ডে উঠবো। অনেক পুরনো কিন্তু নামকরা হোটেল। কিন্তু নিমতলায় নতুন একটি ভালো হোটেলের সন্ধান পেলাম, নাম ’'ইউনিক'’। ইউনিকের রুমগুলো চমৎকার, সার্ভিসও দুর্দান্ত। হোটেল ইউনিকের ফোন নম্বর: ০৫৩১-৫২২০৩, ০১৭৩৬৩৩৫২৬৪।
দিনাজপুর শহরে খাবার ভালো হোটেল কোনটি?
দিনাজপুর শহর এবং এর আশেপাশে যেখানেই দুপুর কিংবা রাতের খাবার খেয়েছি, প্রতিটি আইটেমই ছিল অসম্ভব লবণ দেওয়া। প্রথম দু’একদিন শহরের মাইক্রোস্ট্যাণ্ডের কাছে হোটেল রুস্তমে খেয়েছি। কিন্তু পরের দিকে বালুবাড়ি শাহী মসজিদের কাছে '’ভিন্নতা ফুডসে'র’ ভিন্ন স্বাদের খাওয়া আসলেই ভালো লেগেছে।
দিনাজপুর শহরে গাড়ি ভাড়া করতে হলে যোগাযোগ করতে পারেন: জনাব হাবিব, ফোন: ০১৭১২৮৫৪৪১৫।