দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে।তার চেয়েও দূরের খবর সাগরে নিম্নচাপ।সেই উপলক্ষই আকাশ মেঘলা।দূর থেকে বৃষ্টি ভেজা বাতাস ভেজা মাটির গন্ধ নিয়ে বয়ে আসছে।বর্ষা নীলিমার প্রিয় ঋতু।শরতের শেষবেলায় বৃষ্টির এমন আমেজ মাখা বিকালটা তাই আজ একান্তে উপভোগ করছে নীলিমা।
নীলিমা মেডিক্যাল কলেজের চতূর্থ বর্ষের ছাত্রী।পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপ সবসময়ই থাকে।আগামীকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন।তাই আজকের বিকালটায় সব চিন্তার ছুটি।শুধুই যেন নিজের জন্য ভাবতে বসা।বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় চোখ বুজে বসে আছে নীলিমা।বৃষ্টির হাওয়ায় ভর করে যেন স্মৃতির পানকৌড়িরাও একে একে নেমে আসছে নীলিমার চোখে।
এমনই এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার কথা।আকাশী রঙের শাড়ি পড়ে লা' গ্যালারীতে গিয়েছিলো শিল্পী তন্ময় চৌধুরীর আর্ট এক্সিবিশনে।তন্ময় চৌধুরী তরুণ আর্টিস্ট।আর্ট কলেজ থেকে বের হবার পর দু'বছর কানাডায় ছিলেন।সম্প্রতি দেশে ফিরে আর্ট এক্সিবিশনের আয়োজন করেন।নীলিমা তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।মেডিকেল এ পড়লেও আঁকাআঁকিতে তার ছোটোবেলা থেকেই ঝোক।খুব সাধ ছিল তার আর্ট কলেজে পড়ার।কিন্তু বাবা মায়ের ইচ্ছার কাছে তাকে নতি স্বীকার করতেই হলো।ভর্তি হলো মেডিক্যাল কলেজে।তবে যখনই আর্ট এক্সিবেশনের খবর পায়,ছুটে যায় সে।কোন পেইন্টিং ভালো লেগে গেলে কিনেও ফেলে।ছবি নিয়ে নীলিমার বাড়াবাড়িতে বাবা মা কিছুটা বিরক্ত হলেও মেনে নেন।
স্মৃতিপট যেন ছবি হয়ে নীলিমার চোখে নেমে আসে।নীলিমা ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখছে।ছবিগুলোতে একটু ভিন্নতা খেয়াল করে নীলিমা।উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার একদমই নেই।নিল আর সবুজের আধিক্যে এক একটা ক্যানভাস যেন এক একটা স্বপ্ন।ভালো লাগে নীলিমার।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পালা।ছবি দেখা তবুও যেন শেষ হ্য়না নীলিমার।এতো সুন্দর ছবিগুলোর স্রষ্টা যিনি,সেই শিল্পিকেও দেখেনি।এদিকে বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।বাড়িতে মা চিন্তা করবেন ভেবে নীলিমা বের হয়ে আসে।ভাবে পরদিন আবার আসা যাবে।বাইরে বের হয়ে রিক্সা খোজে নীলিমা।বৃষ্টির সন্ধ্যায় রাস্তাগুলোও ফাঁকা।
-এক্সকিউজ মি।
পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো নীলিমা।
-"জ্বি।"কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললো নীলিমা।
-অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি আপনি দাড়িয়ে আছেন।আকাশের অবস্থা ভালো না।যদি আপনার আপত্তি না থাকে তবে আমি আপনাকে ড্রপ করতে পারি।আমিও বাড়ি ফিরছি।
লোকটির কথা শুনে নীলিমার কিছুটা সন্দেহ হলো।অবশ্য লোকটিকে দেখতে ওয়েল এডুকেটেড মনে হচ্ছে।ভ্দ্র,সুদর্শন,তরুণ বয়সী।ভালো ঘরের সন্তানই হবে।অল্প দূরেই কালো একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে তার গাড়ি।তাই বলে কি চেনা নেই জানা নেই এমন একটি লোকের গাড়িতে যেতে হবে?প্রশ্নই উঠে না।বিরক্তি ভাব স্পষ্ট হলো নীলিমার মুখে।
-"প্রয়োজন নেই।থ্যাংক্স।" ঝাঁঝালোই শোনা গেলো নীলিমার কণ্ঠ।
-দেখুন,আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।অনেকক্ষণ ধরে একা দাড়িয়ে আছেন।আকাশের অবস্থাও ভালো না।যেকোন সময় ঝুম বৃষ্টি হতে পারে।ইতিমধ্যেই আপনি অনেকখানি ভিজে গেছেন।রাস্তাঘাটও ফাঁকা।তাই বলছিলাম আপনি আমার সাথে চলুন।
নীলিমার মেজাজ এবার সত্যি সত্যিই অনেক খারাপ হয়ে গেলো।কোনো রকমে নিজেকে সামলে বললো-
-আমি কিভাবে যাব-না যাবো সে ব্যাপারে আপনাকে চিন্তা না করলেও হবে।
বলেই গট গট করে হাটতে লাগলো নীলিমা।
বেশিদূর যেতে হলো না নীলিমার।সামনেই একটা খালি রিক্সা পেয়ে যায়।দ্বিগুণ ভাড়ায় রিক্সাওয়ালা রাজি হলো নীলিমাকে তার গন্তব্যে পৌছে দিতে।
বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপতেই মা দরজা খুলে দিলেন।
-এতো দেরী করলি যে?ভিজেওতো গিয়েছিস।কিযে করিস না!একটা ফোন করলেওতো পারতি।এদিকে আমি চিন্তায় অস্থির।ফোন করেছিলাম,সেটাও ধরিসনি।এই বয়সে এতো চিন্তা ভালো লাগেনা।
-সরি মা,এবার ঘরে ঢুকতে দাও।ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম।
বলেই নিজের ঘরে যায় নীলিমা।কাপড় বদলে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়।আগামীকাল একটা আইটেম আছে।মেডিক্যালে ছোট ছোট ভাইভা গুলোকে আইটেম বলে।তবে ছোট হলে কি হবে?এক একটা আইটেম যে কি বিভিষিকাময় তা শুধু যারা মেডিক্যালে পড়ে তারাই জানে।পড়তে বসে যায় নিলীমা।তবে মাথায় অসম্পুর্ণ দেখা এক্সিবিশনের কথাই ঘুরপাক খেতে লাগলো।ভাবে,আগামীকাল আবার যাবে।পরক্ষণেই সেই অদ্ভুত লোকটার কথা মনে পড়ে যায় নিলীমার।ভাবতেই মেজাজ খারাপ লাগে।পরীক্ষার কথা চিন্তা করে পড়ায় মন দেয়।একটু পড়তে না পড়তেই দেখে হাচি শুরু হয়ে গেলো।চিন্তায় পড়ে গেলো নিলীমা।এসময় যদি জ্বর এসে পরে তবে খুব সমস্যা হয়ে যাবে।ইম্পর্টেন্ট ক্লাস,পরীক্ষা,মিস করার উপায় নেই।
সেই রাতেই জ্বরে পরে নিলীমা।দু'দিন লাগে জ্বর থেকে সেরে উঠতে।এই দু'দিন ক্লাস,পরীক্ষা কিছুতেই অ্যাটেন্ড করা হয়নি।
তৃতীয় দিনের মাথায় কিছুটা সুস্থ্য বোধ করে।তবে দুর্বলতা কাটেনি পুরোপুরি।এভাবেই আবার ক্লাস শুরু করে।
ক্লাস শেষে নীলিমার মনে পরে যায় সেদিনের আর্ট এক্সিবিশনের কথা।আজ আর্ট এক্সিবিশনটার শেষ দিন।ক্লান্ত শরীরেই যায় সেখানে।
লা' গ্যালারিতে পৌছে নীলিমা দেখে আজ সেখানে খুব ভীড়।শেষ দিন বলেই হয়তো।তবে সকলের মুখে শোকের ছায়া।নীলিমার চোখে পড়ে যায় কালো ব্যানারে বড় করে লেখা সেই দুঃসংবাদটি,তন্ময় চৌধুরির মৃত্যুর কথা।বিস্বীত হয় নিলীমা।এক মূহুর্ত দেরী না করে কাউন্টারে যায়।
-"এক্সকিউজ মি।"নিলীমা সুধায়।
-স্যুয়র।
-তন্ময় চৌধুরীর খবরটাকি সত্যি?
-জ্বি।
-কখন?কিভাবে?
-গতকাল রাতে কার অ্যাক্সিডেন্টে...
বাকি কথা নিলীমার কানে পৌঁছায় না।মনটা বেদনাহত হয়।মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী।কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু বড় অসময়ে কেড়ে নেয় জীবন।কতটা নিরাপত্তাহীনতা,কতটা অনিশ্চয়তা আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে মানুষের জীবন! ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বুক চিরে।চোখ তুলে তাকাতেই অদুরে দেয়ালে একটা ছবিতে দৃষ্টি আটকায়।সন্ধ্যার আবছা আলোতে আসমানী শাড়ি পড়া একটি মেয়ে পথের ধারে দাড়ানো,যেন প্রতীক্ষারত।এটা কি তার ছবি?ভাবে নীলিমা।সত্যিই তো তাই।তারই মুখাবয়ব,স্পষ্ট।কি নিখুত অংকন!
এদৃশ্যতো সেদিনের সন্ধ্যার।তবে কি...?
এক মুহূর্ত দেরী হয়না বুঝতে নীলিমার।সেদিনের সেই ভদ্রলোক যিনি কিনা প্রতিকূল আবহাওয়ায় নীলিমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন,তিনিই তন্ময় চৌধুরী।অথচ তার প্রতিদান হিসেবে নীলিমা ফিরিয়ে দিয়েছিলো অপমান।অনুশোচনা আর বেদনার তীর যেন এসে বিধে নীলিমার বুকে।
বর্তমানে ফিরে আসে নীলিমা।বুজে থাকা চোখ দিয়ে দু'ফোটা জল গড়িয়ে পরে।চোখ খুলে তাকায় নীলিমা।বাইরে অঝোর বৃষ্টি।অনেক আগেই সন্ধ্যা বিদায় নিয়েছে।ইজি চেয়ারটাতে বসে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরের অন্ধকারে।বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।সেই সাথে বেড়ে চলে স্মৃতির যন্ত্রণা।
একটি বিষন্ন রাতের শুরু।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৩১