জনসচেতনতা নিয়ে গল্প করতে গিয়ে বিটিভি প্রসঙ্গ আনলেও আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হিসাবে জনসচেতনতার চাইতে স্মৃতিচারণই অনেক বেশি প্রাধান্য পাবে। ব্যাক্তিগত জীবনে আমি কতটুকু অচেতন সেটা জানলেই অবশ্য আমার সচেতন করার চেষ্টার নিরর্থকতা ধরা পড়বে। সেসব প্যাচাল দূরে রেখে বিটিভির প্রতি ভালোবাসা এবং বিভিন্ন সময়ে ভালোলাগা আমার উপর প্রভাবগুলোই বেশি করে মনে পড়ে। আশির দশকের শেষের দিকে টেলিভিশনের আগমন ঘটে আমাদের বাসায়। আর সেইসময় থেকেই বিনোদনের একটা বড় অংশ জুড়ে টেলিভিশন জায়গা করে নিয়েছিলো। দলবেঁধে পরিবারের সাথে নাটক দেখতে বসে কিছু না বুঝে ঘুমিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও মূলত সুর আর ছন্দের আবেদনে বিজ্ঞাপন অনেক বেশি টানতো। তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে বিটিভি প্রথম ভয়ের কারণ নিয়ে আমার কাছে হাজির হয় এক বিশেষ সাক্ষাতকার দেখে। এসো গান শিখির মিঠু মন্টির আদলের ছয় পাপেটের বসে থাকা দিয়ে শুরু । আর তাদের পরিচয়ে যক্ষ্মা পোলিও হাম ডিপথেরিয়া হুপিংকাশি এবং সবশেষে নিজের কর্কশ কন্ঠে পরিচয় দেওয়া ধনুষ্টংকার এর পরিচয় আমি পেয়ে যাই।
" হগলে যেই হারে টিকা লইবার শুরু করছে তাতে আমরা চোখে আন্ধার দেখতেছি।"
"অনেক মা-ই ধনুষ্টংকারের কোর্স পুরা করে নাই।একডোজ লইয়া আর দ্বিতীয় ডোজ লইতে টিকাদান কেন্দ্রে যায় নাই।"
এই জাতীয় কথার পরে শিকারের খোঁজে তারা বেরিয়ে পড়ে। তার কিছুদিন পরে স্কুলে আমার এক সহপাঠীনি যখন হুপিংকাশিতে আক্রান্ত হয়ে স্কুল ছাড়ে ভয় প্রবল হয় আমার মাঝে। তারও কিছু দিন পরে যখন আমার শরীরে হামের দানা দেখি, আমার টিকা দেয়া হয়েছে কিনা মনে করবার চেষ্টা করি। টিকার কোন স্মৃতি মানসপটে না থাকায় ভাবিত হয়ে উঠি তুমুল মৃত্যু ভয়ে। কোন এক ভয়ার্ত মুহূর্তে মা-কে বলার পরে আমার শরীরে টিকার দাগের চিহ্ন দেখিয়ে সেই যাত্রায় আমার মা ভয় দূর করে।
ভয় দিয়ে শুরু হলেও ভয় পিছু ছাড়ে না। এবারে অবশ্য মৃত্যু ভয় না।রাতকানা রোগের কোপে অন্ধ হবার ভয়। শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারার (সংকর শাওজাল) একজনকে ঢোল হাতে দেখতে পাই আমি। পাশে তার ছেলে। সেই ছেলেকে নিয়ে গান ধরেন তিনি
শোনেন শোনেন বন্ধুগণ, শোনেন দিয়া মন
অভাগী এক দুঃখীর কথা করিব বর্ণন
একটা মাত্র ছেলে আমার এমন কপাল মন্দ
চক্ষু লইয়া জন্ম নিয়াও আমার দোষে অন্ধ
ভাইরে আমার দোষেই অন্ধ।
আমি জানতাম না। সবুজ শাক সবজি না খাইলে রাতকানা রোগ হয় । মাসুম শিশু অন্ধ হইয়া যাইতে পারে। (এমন সময় একজন চিন্তা কিষ্ট মাকে বাচ্চাকোলে আতকে উঠতে দেখা যায়। )আবার গান শুরু হয়। ভিড়ের এক ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়
কোন কোন মা বোনেরা কয় শাকসবজি খাইলে নাকি পেটের ব্যারাম হয়।
ডাক্তার: একদম বাজে কথা, সবুজ শাক ভালো করে তেল দিয়ে রেধে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেটর অসুখ হয় না।
শেষ দৃশ্যে দেখা যায় অন্ধ ছেলেটি করুণ ভাবে বলে
রোগবালাইতো আছে দুনিয়ায়, ভালো থাকার আছে যে উপায়
ভালো থাকার আছে যে উপায়।
এইটা দেখার পর থেকে রাতকানা রোগের ভয়েই হোক কিংবা সেই ছেলেটির করুণ চোখের দিকে তাকিয়েই হোক আমার খাদ্যতালিকায় শাকসবজি ছোট মাছের সমাগম হয় বিপুল। আমার তাগিদেই মলা ঢেলা মাছের সমাগম ও ঘটতে থাকে আমাদের বাড়িতে প্রবলভাবে। শাকসবজি বিষয়ক আরেকটি গানও ছিলো। গর্ভবতী মায়েদের জন্য খাবারের পাথেয় হিসাবে। একতারার সুরে তোলা গানটি ছিলো এমন
চারপাশেতে রইছে কত সবুজ লতা পাতা / আমরা কি ভাই জানি এদের সকল গুণের কথা
কচু শাক আর ধইন্যা পাতা পুঁইয়ের পাতার মাঝে/ কত যে গুণ থাকে
ফুল কপির পাতায় আর ছোলার শাকে ভাই/ আমরা কত পুষ্টি পাই
শরীরটাকে সুস্থ রাখতে এর তুলনা নাই।
আমার মনে হয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ছোট ছোট গান কিংবা নাটিকার বেশ ভালোই ইমপ্যাক্ট ছিলো। সেইসময়ের আরেকটা সাধারণ প্র্যাকটিস ছিলো সাড়া জাগানো নাটক সিনেমা চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে সামাজিক সচেতনতার কথা বলা। সেইসময়ের কিছু আগে হয়ে যাওয়া 'এসব দিন রাত্রি'র চরিত্রগুলোকে নিয়ে খাবার স্যালাইন বানানোর ডেমো দেয়া হতো। সেই নাটিকা গুলো হতোও খুব মজার। খাবার স্যালাইনের সেই নাটিকাতে আসাদুজ্জামান নুর আর তার মা দিলারা জামানের কথার শুরু ছিলো এমন
--আবার ডায়রিয়া বাধিয়েছিস। আশ্চর্য।
--আরে ওটা কি আমি ইচ্ছা করে বাঁধিয়েছি।
--কত করে বলি খাবার আগে ভালো করে হাত দুতে।
--আরে আমি কি হাত না ধুয়ে ভাত খাই।
-- নিশ্চয়ই খোলা খাবার খেয়েছিস। অথবা পঁচা বাসি খাবার খেয়েসিস।
--মা, কানের কাছে কটকট না করে খাবার স্যালাইন বানিয়ে নিয়ে এসো তো।
--তুই আবার যাচ্ছিস কোথায়?
--আবার যাবো কোথায় বাথরুমে যাচ্ছি!! ঐটাই ত আমার স্থায়ী ঠিকানা।
এই নাটিকার পরের ভাগে সাদেক আলী সাহেব ওরফে সুজা খন্দকারের আগমন ঘটে। তিনি যেভাবে নুরের সামনে খাবার স্যালাইন বানানোর ডেমো দেন আর শেষে ঘুটাআ ঘুটাআআ ঘুটাআআ করতে থাকেন সেটা একদিকে যেমন সরেস তেমনি অন্যদিকে দর্শকদের মাথায় গেঁথে যাওয়ার মতো। সুজা খন্দকার অকাল প্রয়াত একজন মেধাবী অভিনেতা । এইসব শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান গুলোতে তার ছিলো ব্যাপক পদচারণা। ইলিশ ঝাটকা সংক্রান্ত তার করা নাটিকাটি সকল মহলে খুবই আলোচিত হয়েছিলো। সেখানে তার সাথে সালেহ আহমেদ অভিনয় করেছিলেন। সেখানে সুজার ছান্দিক ডায়লগ থ্রোয়িং যেকোন শ্রোতা দর্শকের মাথায় গেঁথে যাওয়ার মতো। ঝাটকা নিধন বন্ধে ব্যবহৃত এই চমৎকার নাটিকার ডায়লগ গুলি ছিলো এমন
--মাছের গুষ্ঠি দেখাও ফাল/ লগে আনছি কারেন্ট জাল
কপালের ফের কী আর করা/ আন্দা বাচ্চা সহ পড়বা ধরা।
ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকা/ কারেন্ট জালে আটকা
ইলিশ মাছের পোনারে/ টাকার খবর সোনারে।
(এমন সময় পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত সালেহ আহমেদ-এর আগমন )
-- আরে সাদেক আলী। তুমি কারেন্ট জালে মাছ ধরতাসো। তুমি জান না কারেন্ট জালে মাছ ধরা নিষেধ। মৎস্য আইনে তোমার পাঁচশত টাকা জরিমানা অথবা ছমাসের জেল হয়ে যাবে। জাটকা মাছ ধরা আইনত নিষেধ আছে।
--মাছ ধরমু তাতেও আইন/ যা শুনাইলেন স্যার সত্যিই ফাইন।
ঐ বোকারাম বৎস /নিশ্চিন্তে শিকার কর মৎস্য/মৎস্য মারিব খাইবো সুখে/ কী আনন্দ লাগছে বুকে।
-- (বেশ ঝাঝালো স্বরে) সাদেক আলী । তুমি দেশের ক্ষতি করতাসো।
-- মাছ ধরলে দেশের ক্ষতি /ঠিক আছে তো মতিগতি।
-- তুমি কি জানো জাটকা মাছ বড় হয়ে ইলিশ হয়।
(পরের দৃশ্য সালেহ আহমেদ একজনকে ডাকেন। বড় ইলিশ দেখিয়ে বুঝান যখন তা ছোট ছিলো তখন জাটকা। এখন ইলিশ। বড় হইছে।)
-- জানি, আমি স্যার মোটামুটি জ্ঞানী/ এইটা জানি।
--জাইনা শুইনা তুমি এমন কাজ করো। তোমার মতো লোভী মানুষদের জন্য বাংলাদেশ প্রতিবছর সোয়া এক লাখ টনেরও বেশি মাছ থেকে বঞ্চিত হয়।
-- এত ইলিশ , সোয়া এক লাখ টন// কী কন?
-- শোন মিয়া, মৎস্য আইনে পোনা মাছ ধরা নিষেধ ডিম ওয়লা মাছ ধরা নিষেধ জাটকা মাছ ধরা নিষেধ। একটা কথা মনে রাইখো। মাছের পোনা দেশের সোনা।
--বাহ বাহ বাহ। কী সুন্দর কথা শুনাইলেন স্যার।
মাছের পোনা দেশের সোনা/ আজ যে পোনা / কাল সে বড়/ ঐইই মিয়ারা সবুর করো।
মাছের পোনা মারুম না/ জেল খাটতে পারুম না। ধরুম না আর জাটকা/ইলিশ খামু টাটকা।
যেই ব্যাটারা জাটকা ধরে আটকা ওদের আটকা।
এইটার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিলো আমাদের মাঝে। আমরা এটা দেখে সবাই সুরে সুরে সাদেক আলী হবার চেষ্টা করতাম। সুজা খন্দকারের গাছ নিয়াও আরেকটা ছিলো , যেটায় সে বলে 'কাটো গাছ খাও মাছ'। পরে ভুল বুঝতে পেরে সে আবার জানায় লাগাও গাছ খাও মাছ। গাছ বিষয়ে প্রয়াত আবুল খায়েরের আরেকটা জনপ্রিয় নাটিকা ছিলো। যেটায় সে কবিরাজ ছিলো। এবং গাছ থেকে ঔষধ বানায়। সেটার প্রতিটা ডায়লগ মন ছোঁয়া। এমনি একটি ডায়লগ ছিলো ' লাকড়ী বানায়া চুলায় দিছি, খাট পালং বানায়া শুইয়া রইছি টাকার দরকার পড়ছে গাছ কাটছি। যা কাটছি, তা কি পূরণ করছি। বাপ দাদার লাগানো গাছ কাটছি। নিজেদের সন্তানদের জন্য কী রাখছি। অক্সিজেন ফ্যাক্টরী ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসতেসে।' গাছ নিয়ে আরেকটা মজার নাটিকাও ছিলো। যাতে গাছের উপর কোপ পড়ায় মা কেঁদে উঠেন। পরে দেখা যায় তার শ্বশুর তাকে বলে যান ব্যাকসিনে, 'তোমার পোলা বড় হবে গাছও বড় হবে'-- এই জাতীয় ডায়লগ। শেষ কথা ছিলো একটা কাটলে তিনটা গাছ লাগানো লাগবে।
মধ্য নব্বইয়ে হঠাৎ করেই বাংলাদেশে এইডস নিয়ে একটা তোলপাড় শুরু হয়। আর এরই ক্রম ধারাবাহিকতায় এইডস নিয়ে নানা রকম সচেততা মূলক অনুষ্ঠান প্রচার হতে থেকে। তখন এইডসের চিকিৎসা নেই এটা বলে বলা থাকতো এইডস প্রতিরোধের উপার 'ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন।' এর প্রভাব এমন যে আমাদের ছোটদের মাঝেও এইডস নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। টিভির সূত্র ধরে এক বয়স্কা আত্মীয়ার কাছে এইডস হবার কারণ জানতে চাই। এর সাথে প্রতিরোধের ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারটাও জানতে চাই। ফলাফল ছিলো তুমুল এক রাম ঝাড়ি। সেই সাথে আমাকে বলা হয়েছিলো এইডসের কিছু প্রচার হলেই আমি যাতে টিভির সামনে থেকে উঠে যাই। নিষিদ্ধ আগ্রহ থেকেই এইডস বিষয়ক সবকিছুই দেখা হতো। সেইসময়ে এইডস নিয়ে প্রচারিত হতো দুর্দান্ত এক গান। যার ভিডিওতে অংশ নেন দেশের সকল নাট্য সিনেমা ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব। এই গানের দুর্ভোগ বলার সময় আনোয়ার হুসেন এর অভিব্যাক্তি দেখে তাকেই আমি সম্ভাব্য এইডস ব্যাক্তি বলে ধরে নেই। একইভাবে হাত তুলে গুলি করার ভঙ্গি করা ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি কেমন যেন শ্রদ্ধা জন্মে যায়। নিষিদ্ধ আনন্দ থেকেই হোক কিংবা তারকা প্রীতি থেকেই হোক সেই গানটি এক দম মাথায় গেঁথে যায়। গানটি ছিলো এমন
শোনো মানুষ / শোনো মানুষ/ শোনো মানুষ/ শোনো মানুষ/
এসেছে এসেছে পৃথিবীতে / এক মহারোগ / এক মহারোগ /এক মহারোগ
সাবধান,সাবধান/এইডস হতে সাবধান/মৃত্যুই যার পরিণাম
মনে রেখো এইডস এমন কঠিন রোগ/ চিকিৎসা নেই নেই নেই / আছে আমৃত্যু দুর্ভোগ।
আসছে ধেয়ে আসছে ধেয়ে সেই সে মহারোগ।
অসাবধানে অসৎ সঙ্গে পায় তারে প্রথমে/
ঠেকাও ঠেকাও ঠেকাও/ তুমি মানুষ তোমার শক্তি শিক্ষা দিয়ে তারে ঠেকাও/ তুমি ঠেকাও/ তারে ঠেকাও।
সৃষ্টির সেরা তুমি রাখিও স্মরণ/ তুমি যেন না হও তোমার মরণের কারণ/তুমি যেনো না হও তোমার/ মরণের কারণ।
নব্বইয়ের দশকে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হবার পরে তার প্রচারণা লেগে যায় জোরে সোরে।বিটিভিতে এর প্রথমিক ধাপ ছিলো গণশিক্ষার আসর নামে একটা অনুষ্ঠানে। দিলারা হাফিজের উপস্থাপনায় সেই অনুষ্ঠানটি আমার কাছে বেশ লাগতো। বিশেষভাবে আসরের শেষে একটা শিক্ষামূলক নাটিকা দেখানো হতো। সেটা দেখার জন্য আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে থাকতাম। তাছাড়া শিক্ষার আসরে থাকা বয়স্ক লোকজনের মাঝে খুনসুটিও বেশ উপভোগ্য ছিলো। নাটিকার মাধ্যমে মূলত সামাজিক অসংগতি তুলে ধরা হতো। গ্রামের মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কীভাবে ঠকায় এবং শেষে সেই ঠগ লোক কীভাবে ধরা খায় এমনই ছিলো মোটামুটি থিম। ঈশপ ঘরনার হলেও ভালোই লাগতো দেখতে। প্রাথমিক শিক্ষার গুণাগুণ বলতে তখনকার জনপ্রিয় নাটকে অয়োময়ের মির্জার পোশাক নিয়ে হাজির হন আসাদুজ্জামান নুর সাথে তার পেয়াদা হানিফ ওরফে মোজাম্মেল হক। তবে এটা প্রচারের অনেক আগেই কুদ্দুস বয়াতির 'এই দিন দিন না আরো দিন আছে' এই গানটি সচিত্র প্রকাশ হয়। সেই গানের মাঝে একজায়গায় 'আহারে কী মজার স্কুল' নামে একটা লাইন ছিলো। যেটা আমাকে চরমভাবে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। কারণ তখন স্কুলে স্যারদের গুতানি প্যাদানি খেয়ে মূলত অসহ্য লাগতো যেতে। এই গানে স্কুলের মজার কথা অনেক চিন্তা করেও কিছুতেই খুঁজে পাই না। তবে গানটা বেশ মন কাড়া ছিলো। বিটিভিতে প্রচারিত গানটা না পাওয়া গেলেও কোন এক অনুষ্ঠানে কুদ্দুস বয়াতির গাওয়া গানটির একটা ভিডিও পেলাম ইউটিউব
http://www.youtube.com/watch?v=3MrIhM-T1tw
কুদ্দুস বয়াতি এই গান গিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জ ন করেছিলেন। পরবর্তীতে বাল্যবিবাহ বিরোধী আরেকটি প্রচারণাতেও তিনি অংশ নেন। যার গানের কথা ছিলো অনেকটা এমন
আম খাইয়ো জাম খাইয়ো তেঁতুল খাইয়ো না
অল্প বয়সে বিয়া কইরা প্রাণে মইরো না।
যা হোক বলছিলাম শিক্ষা বিষয়ক প্রচারণা নিয়ে। মাসুদ আলী খান মামুনুর রশীদ শিলা আহমেদ ও নাজমা আনোয়ার অভিনীত আরেকটা নাটিকা ছিলো। যেটায় ক্ষেতের কাজে সাহায্যের জন্য বাপ মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে নেয়। পরে অন্ধ দাদী ক্ষেতে খাবার নেবার কথা বলে পুনরায় নাতনীকে স্কুলে পাঠায়। সেটার মজার কিছু ডায়লগ এমন
-- মাইয়াটারে নিয়া যাবা কুদ্দুস । মাইয়া টা এতো ভালো ছিলো। এই দেখো কী সুন্দর তার হাতের লেখা।
-- হাতের নেহা। ঐ হাতের নেহা দিয়া আমি করবাম। ধুয়া পানি খাইবান।
কিংবা
-- লেহাপড়াতো শিখছে। আর কত শিখবো। লেহা পড়া শিখা তো জজ ব্যারিস্টার হইতো না।
--হইতেও তো পারে মানুষইতো জজ ব্যরিষ্টার হয়, গরু ছাগলে হয় না।
এই নাটিকা নিয়া একটা মজার কাহিনী আছে। আমরা এই নাটিকা দেখে এত মজা পেলাম আমাদের ক্লাশের বোর্ডে একজন লিখে রাখলো আরে ব্যাটারে আমি আন্ধা হইয়াও তর চেয়ে বেশি চোখে দেখি। স্যার হঠাৎ ঢুলেন। ফলে ঐ লেখা মুছা হলো না। স্যারের মোটা চশমা থাকায় তিনি ধরেই নিলেন তাকে খোঁচা মেরেই কথাটা লেখা। ফল হিসাবে লেখককে খুঁজে বেশ করে মৃদু ভর্ৎসনা।
মাঝখানে সাইবেরিয়া থেকে আগত অতিথি পাখিদের মেরে ফেলার একটা চল শুরু হয়েছিলো। বাজারে বাজারে অতিথি বেশ উঠে। আর অতিথি পাখি নিধন বিরোধী সামাজিক প্রচারণা মূলক নাটিকায় অংশ নেন জনপ্রিয় অভিনেতা আজিজুল হাকিম, উৎপল ডলি জহুর এবং একজন শিশু শিল্পী। সেখানে বাজার থেকে অতিথি পাখি নিয়ে এসে আজিজুল হাকিমকে খুব উচ্ছসিত দেখা যায়। কিন্তু বোন দুলাভাইয়ের তীব্র ঝাড়ির মুখে চুপসে যান। শেষে কাচুমাচু ভাবে বলেন, নিয়েই যখন এসেছি আজকের মতো তো খাই। তখন তার ছোট ভাগ্নে বলে উঠে, সবাই খেলেও আমি খাবো না অতিথি পাখি। দাও পাখিগুলোকে আমার কাছে। তারপরে সেই পাখিকে মুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মজুরি বিষয়ক আরেকটি শিক্ষামূলক নাটিকা ছিলো। মেয়েদের কম মজুরি দেয়া নিয়ে। কাঙালিনী সুফিয়ার গান ইউস হইছিলো। গান "পরানের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে/ কত কষ্ট কইরা আমি , কামাই রোজগার করে আনি/ মাথার ঘাম পায়ে ফেলি/তবু দুঃখ গেলো না রে/বুড়ি হইলাম তোর কারণে।/ কোদালে কাটিয়া মাটি/ হাতুর দিয়া পাথর ভাঙি/মাথার ঘাম পায়ে ফেলি/ তবু তোর মন পাইলাম নারে / বুড়ি হইলাম তোর কারণে।"
তার পরের দৃশ্য দেখা যায় মালিক বসে আছে। লাইনে শ্রমিকরা ডাঁড়িয়ে । ডাকে আবুল হোসেন ( নামগুলো ঠিক খেয়াল নাই)। "তোমার তিনদিন ৩ পঞ্চাশে একশত পঞ্চাশ।
আইচ্ছা।
তারপরে আরেকজনকে ডাকে ।বলে,
তোমার তিনদিন । তিন পঞ্চাশে দেড়শো।
তারপরে একটা মেয়েকে দাকে ডাকে। বলে "আসছো। তোমার তিনদিন । তিন তিরিশে নব্বই।"
সবাই সমান সমান কাম করলাম আমার ষাইট টাকা কম কেন?
মাইনা মাইনষের মজুরির কমই হয়।
তারপরে মেয়েটা টাকা হাতে নেয় আর নিয়ে বলে এইটা আবার কোন বিচার ??
তালাক বিষয়ে সামাজিক সচেতনতার একটা নাটিকা ছিলো। মাথা গরম স্বামী রাগের মাথায় তিনবার তালাক বলে ফেলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বলা হয় তিনবার তালাক বললেই তালাক হয় না। এর পিছনে রয়েছে আইনগত প্রক্রিয়া। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার, স্যানিটেশন বিষয়ক আরো অনেক ভালো ভালো সচেতনতা মূলক নাটিকা প্রচার হতো। এসিড সন্ত্রাস নিয়ে হৃদয় স্পর্শী একটা নাটিকা ছিলো। এসিড সন্ত্রাসকারী ছেলের বাবাকে বলতে শোনা যায়, তার ছেলের ছবি দেখিয়ে। "এই ছবিটা ছিলো ওর ভার্সিটির শুরুতে। তখনো সে মানুষ ছিলো।" তারপরে তার বর্তমান ছবি দেখানো হলে চিৎকার করে উঠেন, অমানুষ, আমি ভাবতে পারি না আমার ছেলে কারো গায়ে এসিড ছুড়েছে। পিছনে ছেলেটির বোনকে কাঁদতে শোনা যায়। বাবা বলেন এই কাঁদবি না। অমানুষের জন্য কান্না কিসের!! তখন মেয়েটি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, মা!! কেউ যদি আমার গায়ে এসিড ছুড়ে !!!!
শেষ করবো নিজের ভালো লাগা একটি নাটিকার কথা বলে। মরণোত্তর চক্ষুদানকে উৎসাহিত করে দেয়া এই নাটিকায় বেশ একটা রাশ গম্ভীর শুরু। তারপরে একটা হাসপাতালের বেড দেখা যায়। সেখানে শায়িত রোগী শীলা আহমেদের চোখের উপর থেকে ব্যান্ডেজ খোলা হয়। আশেপাশে মেয়েটির বাবা মা সবার মুখে উৎকণ্ঠা। খোলার পরেও মেয়েটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সবাই চিন্তিত হয়। বাবা বলেন দেখতে পাচ্ছিস। মেয়েটি কিছু বলে না। তার মা কান্না করতে থাকে। হঠাৎ করে মেয়েটি অদ্ভুতভাবে বলে উঠে , আমি দেখতে পাচ্ছি। আমি সব দেখতে পাচ্ছি। মা আমি দেখতি পাচ্ছি । আমি সঅঅব দেখতে পাচ্ছি। সেই সময়ের অনুভূতির কথা ভেবে নিজেই আলোড়িত হই। মরণোত্তর আরেকজনের চোখে দুনিয়া দেখবার সুপ্ত বাসনা জেগে উঠে।
[ ডিসক্লেইমার : বন্ধু মেহরাব শাহরিয়ার ও রেজাউল করিম রানার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা তথ্য উপাত্তের জন্য। ধন্যবাদ মেহরাব শাহরিয়ার ও জলরঙ যাদের উৎসাহ এই লেখাটার অনুপ্রেরণা। রিলেটেড ভিডিও খুঁজে পাই নি। কেউ পেলে মন্তব্যের ঘরে জানিয়ে দিলে পোস্টে আপডেট করা হবে। ধন্যবাদ। ]
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:১৩