ইদানিং খোমাখাতায় বিভিন্নজনের তথ্য দেখতে গেলে আমি বেশ মজা নিয়ে লক্ষ্য করি রাজনৈতিক দর্শনের জায়গাটাতে খুব গর্ব ভরে পূরণ করা আছে "আমি রাজনীতি ঘৃণা করি"।লেখাটার মধ্য দিয়ে নিজেকে ফ্রেশ প্রমাণের একটা উন্নাসিক ভাব খেয়াল করি বলেই হয়তো আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয় তা। কারণ রাজনীতি ঘৃণা করি বলে রাজনীতিকে নিজের বলয়ের বাইরে ডিফাইন করার প্রক্রিয়াটি আমি মনে করি একধরণের ভেজিটেশন প্রক্রিয়া। আর এর মাধ্যমে নোংরা রাজনীতিবিদদের নোংরামিকে প্রতিবাদ করার জায়গাটা থেকে আমরা সরে আসি। রাজনীতি অসুস্থ মানুষের কাজ ধরে নিয়ে আমরা সুস্থ থাকতে চাই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু আখেরে এই প্রক্রিয়ার সুবিধাভোগী কারা একটু খেয়াল করলেই আমরা তা বুঝতে পারি। রাজনীতি সচেতনতা থাকলেও রাজনীতির সাথে ইনভলব হওয়া হয়নি কখনও।তবে কাছ থেকে দেখেছি রাজনীতি কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে অল্প অল্প করে বিষাক্ত বীজ বপন করে।
খোমাখাতায় যারা পলিটিক্স হেট করে তাদের আমি দোষ দিতে পারি না চর্চিত রাজনীতিতে শিক্ষক ও ছাত্রদের কোন দলের কাছে মাথা বেঁচার নোংরা প্রদর্শনী দেখে। আমার এক ভাই যিনি কিনা ঢাকা ভার্সিটিতে ছাত্র রাজনীতি করতেন তার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি তার রাজনৈতিক বোধের দৈন্যতা। আরো পরিষ্কার করে বললে তার রাজনীতির আলোচনায় আমি দলগত আদর্শ কিংবা মানুষের জন্য রাজনীতির কোন ছোঁয়া খুঁজে পাই না। শুধু শুনতে থাকি মাস্তানির গল্প, হল দখলের গল্প, মারামারির গল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পেতে রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো আমার বন্ধুদের কাছে জানতে পারি কীভাবে নিজেদের প্রয়োজনে (হলের সিট) তারা বাধ্য হয় নোংরা রাজনীতির সাথে মিশে যেতে। এবার আমার ভার্সিটির কথায় আসি। সনি হত্যার পরে আমাদের ঢুকা বুয়েটে। সেই সময়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতা ম্রয়মান কিংবা বলা যায় সনি হত্যার জের ধরেই রাজনীতি নির্বাসনে গেছে। সেটা আবার পুনরুজ্জীবিত হয় একজন নোংরা মানসিকতার দলীয় ভিসির হাত ধরে। ২০০৪ সালে বুয়েটে পূজার ছুটি নিয়ে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন ভিসি। আমরা সাধারণ ছাত্ররা এর প্রতিবাদ জানাই। ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন বাঁধা দিতে আসে তৎকালীন ছাত্রদল। তার ফল হিসাবে সাধারণ ছাত্রদের খড়গ পড়ে তাদের উপর। এর প্রতিশোধ ছিলো নির্মম। সাধারণ ছাত্ররা বলি হয় নি, কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের সামনে থাকা লোকদের মাঝে যাদের দলীয় সংযুক্তি আছে তারা কিছু করুক বা না করুক প্রহৃত হয় তীব্রভাবে। আমার এক বন্ধু যে কিনা দল সমর্থন করে তাকে এ কথা বলতেই সে বলে উঠে, এটা রাজনীতির ধারা। ক্ষমতাসীন দলের উপর হাত তুললে তারা বিনিময়ে কিছু মেরে হলেও নিজেদের শক্তির জানান দিবে। হায় রে রাজনীতি !! শক্তির জানান দল দিতে থাকে। তবে পিটাপিটির চাইতে পরীক্ষা পেছানো কিংবা হলের মেস নিয়ে ছোট খাটো ঘাটাঘাটির মাঝেই ছিলো তাদএর সীমা। কিন্তু তখনকার ছাত্রদল আমাদের জামাতি ভিসিকে রক্ষাকারী গুণ্ডা বাহিনী হিসাবে বেড়ে উঠে ক্রমাগত।
বুয়েটের পরীক্ষা পিছানো, বিশ্বকাপ দেখা নিয়ে অনেক কথা বাজারে প্রচলিত আছে। সে বিষয়গুলোর ভেতরে না গিয়েও আমি বলতে পারি শিক্ষকদের বাসায় হামলার যে অনভিপ্রত ঘটনা ২০০৬ এ ঘটে তার মূলে ছিলো ভিসির পোষা গুণ্ডাবাহিনী। এই বাহিনী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে যখন শিক্ষকদের উপর যায় তখন প্রশাসনের খড়গ হস্ত নেমে আসে। সেই সময়কার একশন বেশ কাজে দেয়। অন্তত শাস্তি পাবার পরে গুণ্ডা বাহিনীর তৎপরতা কমে। ভিসি বদল হয়। তত্ত্বাবধায়ক আমলে শান্তির সাথে চলতে থাকে ক্যাম্পাস। এর মাঝে আমরা বের হয়ে যাই। তবে বের হবার পরেও বুয়েটের সাথে যোগাযোগ ছিলো। আর ছিলো বলেই খোঁজখবর পাওয়া কিংবা যাওয়া হতো নিয়মিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমাদের তথাকতিত রাজনীতির ধারা অনুযায়ী আবার দলীয় লোক বসেন প্রশাসনিক ক্ষমতায়। নতুন ভিসির নতুন গুণ্ডাবাহিনী বেড়ে উঠতে থাকে আগের চেয়ে অনেক তীব্রভাবেই।
বুয়েটে গিয়ে কিংবা বুয়েটের ছোট ভাইদের মুখে বুয়েটের অনেক পরিবর্তিত চিত্রগুলোই আমাদের কাছে আসে। আমরা জানতে পারি অনেক গল্প। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি পূর্ববতী গুণ্ডাবাহিনীর চেয়ে একটু ভিন্ন ধারায় এই বাহিনী পরিচালিত হয়। আর এবার তাদের প্রতিটি কাজের প্রত্যক্ষ মদদে নামেন বুয়েট প্রশাসন।বুয়েটের প্রচলিত সিনিয়র -জুনিয়র সম্পর্কের ট্রেডিশন ভেঙে পরে। সিনিয়রকে পিটানোই হয়ে যায় নেতা হবার অন্যতম যোগ্যতা। অনভিপ্রত ঘটনা ঘটতে থাকে ক্রমাগত। অথচ দলীয় প্রশাসন চোখ কান বুঁজে কিছুই হয়নি এমনভাবে সব কিছু অগ্রাহ্য করতে থাকেন। সব চিত্র বেরও হতে পারে না গুণ্ডাদের প্রতাপে। মজা হলো ব্লগে ফেসবুকে তাদের বিরুদ্ধ লেখা হলে তারা হলের রুমে রুমে গিয়ে খোঁজ চালায়। এ এক অচেনা বুয়েট !!!
আগের যুগে (আমার সময়ে) বুয়েটে মারামারি বলতে কিল চড় ঘুষিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে তা নৃশংস রূপ নিতে থাকে । প্রশাসনের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে তাদের সাহস অতিক্রম করতে থাকে সকল সীমা। গৌতম নামে ছাত্র ফ্রন্টের এক ছেলের উপর নৃশংস হামলাতেও দলের কাছে মাথা বেঁচা বুয়েট প্রশাসনের টনক নড়ে না। বরং ফ্রন্টের কর্মীর উপর হামলা বলে ব্যাপারটি রাজনৈতিক ধরে নিয়ে, নিজের দলকে বাঁচাতেই বেশি তৎপর দেখা যায়। ফল হিসাবে স্পষ্টতই ছাত্রলীগের সাহস বাড়ে। আর সেই ঘটনার শেষ কনসিকোয়েন্সে ঘটনো ঈষানের উপর হামলা। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই লেভেলে না হলেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও অনেকই ঘটেছে যা মিডিয়ার দ্বারা আলোর মুখ দেখেনি।
অস্বস্তির সাথে একই সময়ে ঘটে যাওয়া কুয়েটের ঘটনা দেখতে থাকি। গভীর উদ্বেগের সাথে আমি দেখতে পাই সেখানেও একই চিত্র। রাজনৈতিক মারপ্যাচ যদি না বুঝি তাহলে এই প্রশ্ন অবশ্যই বলতে হয়, পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ সাধারণ মানউষের উপর তাণ্ডব চালায় কীভাবে?? আমরা যারা রাজনীতি বুঝি না তাদের বুঝতে দেরি হয় যে সরকারী গুণ্ডাবাহিনী রক্ষা করাই পুলিশের কাজ। পুলিশ জনগণের জানমাল না, বরং সরকারী গুণ্ডাবাহিনীর জানমালের হেফাজত করে। একটা অনুষ্ঠানে দুর্নীতি হোক বা না হোক প্রতিবাদ করাই হয়েছিলো সাধারণ ছাত্রদের দোষ। তাদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারেন না ভিসি, কারণ তিনি মেরুদণ্ডহীন, দলের পা চাটা। ছাত্রলীগের তাণ্ডবে বাধা দিতে গিয়ে আহত হয়েছেন শিক্ষকও। সাধারণ ছাত্ররা অবশ্য শান্তির পথে থাকতে পারেনি। এ জাতীয় নৃশংসতায় মাথা ঠিক রাখা কঠিন।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কম বেশি সবারই জানা বলে আমি খুব বেশি ডিটেইলে গেলাম না। তারপরেও ঘটনাগুলো দেকে মনে হয় আমাদের সাধারণ মানুষরা এসব মেনে নিয়েছে। আমরা দলীয় প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারকে মেনে নিয়েছি, আমরা মেনে নিয়েছি সরকারী দলের হল দখল তাণ্ডব সন্ত্রাসকেও। স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছি শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাসের বৈধতা। আর নিজেরে যথেষ্ট পরিমাণ কুকুর শৃগালে রূপান্তরিত না করতে পারলে সাংবাদিক হওয়া যায় না। দেশের শীর্ষ পত্রিকা প্রথমালু তে আমরা তাই সাধারণ ছাত্রদের কুকীর্তি গুলোকে ফলাও করে দেখতে পাই। অথচ গুণ্ডাদের কীর্তি কিংবা দলীয় ভিসির স্বেচ্ছাচার খুব সুন্দর করে আড়াল করা হয় লেখার নিপুণতায়।
অথচ যে ছেলেগুলো এতটা নৃশংস হয়ে উঠেছে টাদের কয়েকজনকে দেখেছি অনেক নিরীহরূপে। ভালোমানুষি চেহারার আড়ালেই হয়তো তাদের পশুত্ব লুকিয়ে ছিলো। ক্ষমতা আর স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্সে এই মানুষগুলো কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে দেখে বিব্রত হই। পশুর বেরিয়ে আসাতে আমি তাদের দোষ দেই না। পশুত্বকে খুলে দেওয়া প্রশাসনকেই দায়ী করি। টলস্টয়ের একটা ছোট গল্প পড়েছিলাম। এক টুকরো রুটি। ওখানে দেখা যায় এক শয়তান একজন মানুষের মাঝথেকে শেয়াল শূকর নেকড়ে এই জাতীয় পশুত্বকে বের করে আনে। সেটা করতে শয়তানের সময় লেগেছিলো তিন বছর। বুয়েটের আওয়ামী পদলেহনকারী প্রশাসন মাত্র দুই বছরে অনেক সংখ্যক নিরীহ ছেলেদের মাঝ থেকে জন্তু জানোয়ার বের করে আনছেন। সাবাশ এই আধুনিক শয়তানদের। তোমাদের দেখলে টলস্টয়ের সেই শয়তান লজ্জায় আত্মহত্যা করতো!!!
এত এত হতাশার মাঝেও ফিনিক্সের মতো জেগে উঠে স্বপ্ন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা নেমেছে পথে অবশেষে। তিনদিন খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে তারা করেছে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট। ছয় ট্রাক দাঙ্গা পুলিশের রক্ত চক্ষুর সামনে তারা স্থির থেকেছে। প্রশাসন ও ছাত্রলীগের প্রলোভনের মাঝেও তারা কোন রকম ভায়োলেন্সে যায় নি। তাদের সেই অহিংস নীতির জয় হয়েছে। দুজনের শাস্তি হয়েছে। কালকে খোমাখাতায় যখন বহিস্কার ঘোষণা পরার ভিডিও দেখি, শান্ত গভীর জনতার সৌম্য ভাব দেখে হাজার মাইল দুরে বসেও আপ্লুত হই। স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করি অনেক অনেক ভালো কিছুর সূচনা এইখানে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে নামুক অহিংস নীতিতে অধিকার আদায়ে। স্বপ্ন দেখি নতুন করে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়া যাত্রীর তো খড়কুটো ধরেই বাঁচে উঠার স্বপ্ন থাকে।
মন ভালো করা ভিডিওটার লিংক দিলাম
http://www.youtube.com/watch?v=PvSgiHu68xc
অফটপিক একটা প্রস্তাব ও করছি, বুয়েটে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিজয়ের এই ছোট ঘটনাটা নিয়ে কি ডকুমেন্টারি হতে
পারে। ঘটনা যত ছোটই হোক হয়তো এর মধ্য থেকেই অনেক বড় কিছুর প্রেরণা আসবে সামনে।