অভিনবত্ব কিংবা বাস্তবতা -- ছোটগল্পের উপজীব্য কোনটা হতে পারে এমন তর্কটা পুরনো। ঘটনা হয়তো এমন নয় যে, এই দুটো গুণ সাংঘর্ষিক। তবে তারপরেও যেটা সত্যি সেটা হলো বাস্তব জীবনে অভিনব ঘটনা কম ঘটে। আর গল্প যেহেতু বাস্তবের বিম্ব তার মাঝে অভিনবত্বের ছোঁয়া সবসময় আশা করাটাও অনুচিত- এই কথাটা যেমন ঠিক, তেমনি সমানভাবে একথাও সত্যি যে রোজকার খাওয়া দাওয়া ঘুম অফিস যৌনাচারের বৈচিত্র্যহীন ক্লিশের ক্রমাগত বয়ান পাঠকের জন্য ক্লান্তিকর। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করার মতো শোনালেও যখন প্রযত্নে হন্তার পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসছি এ কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে আসছে। বইয়ের দশটি গল্প তাই কখনো গিয়েছে ক্লিশের সমষ্টি আমাদের জীবনের ক্লান্তিকর বয়ানে, কখনো অভিনবত্বের ছোঁয়াতে ধাঁ ধাঁ জাগানো, কখনো আগ্রহ জাগানিয়া অথচ শুধু কাহিনী নির্ভরতা বিবর্জিত পরীক্ষায় কিংবা কখনো ফুটিয়ে তুলেছে লেখকের ভেতরকার জীবন বোধ কিংবা লালিত দর্শনকে। আর এই জায়গাতেই হ্যা বৈচিত্র্যের কারণেই পাঠক হিসাবে বইটি আমার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
অভিনবত্ব এবং বৈচিত্রের ব্যাপারে লেখক যে যত্নবান ছিলেন বইটির আদ্যোপান্তে তার ছাপ সুষ্পষ্ট। শুরু করা যাক বইয়ের ফ্ল্যাপ দিয়েই। বইয়ের ফ্ল্যাপটি পড়ে বিশেষভাবে ভালো লেগেছে। সাধারণভাবে বইয়ের ফ্ল্যাপ মূলত বইয়ের এবং লেখকের পরিচিতি তুলে ধরে পাঠকের কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে। ক্ষেত্র বিশেষে পাঠক টানতে বইয়ের চুম্বক অংশ উদ্ধৃত করে দেয়া হয়। এই বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক বহুল চর্চিত প্রথাগত পথে যান নি। নিজেকে মহীয়ান গরীয়ান করার কোন চেষ্টায় না গিয়ে সৎভাবেই নিজের কথা বলেছেন। লেখক নিজের অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ থেকেই যে সব কথা বলেছেন তা আলাদাভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। মার্কেটিং এর যুগে লেখক নির্মোহভাবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে শুদ্ধতার প্রতি দায়বদ্ধতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আরেকটি অভিনব প্রচেষ্টা বিশেষভাবে নজর কেড়েছে সেটা হলো প্রত্যেক গল্পের শেষেই গল্পের পিছনের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে। গল্প শেষ করার পরে যা পড়ে পাঠক হিসাবে আমি তাগিদ বোধ করেছি গল্পটিতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে গল্পের পিছনে লেখকের ভাবনা আর গল্পের মাঝে পাঠকের ভাবনার মাঝে তুলনামূলক বিচারে যাবার।
এত কিছু বলতে বলতে বইয়ের লেখকের ব্যাপারে বলতে ভুলে গিয়েছি। লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় আমার ভার্সিটির ছোটভাই কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে হলে আমার এক বন্ধুর রুমমেট। তবে মজার ব্যাপার হলো ছেলেটিকে আগে আমি সামনা সামনি হয়তো দেখেছি বা চিনতাম তবে তার সাথে পুণঃপরিচয়ের সুযোগ ঘটে ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পরে ২০০৮ সালের দিকে সামাহোয়ারে আমার এক পোস্টের কমেন্টের সূত্র ধরে। আমার পোস্টের যে কমেন্টের সূত্র ধরে তার সাথে আমার পরিচয় তা ছিলো তার ........র্দাপ গল্পের থেকে উদ্ধৃতাংশ। বলা যায় কমেন্ট পড়ার পড়েই উদ্ভট নামের ( আসলে পর্দা .......) গল্পটা পড়া হয়। সেই সূত্রেই ব্লগের একজন ভিন্ন ধারার লেখকের সাথে পরিচয়। প্রযত্নে হন্তা বইয়ের সবগুলো গল্পই ব্লগে লেখা একই নামে অথবা ভিন্ননামে রচিত গল্পের ছায়া গল্প হলেও গল্প গুলো বিভিন্ন সময়ে পরিমার্জিত ক্ষেত্রবিশেষে পুনর্লিখিত। লেখক প্রত্যেকটি গল্প নিয়েই কাঁটাছেড়া করেছেন যেটা নিঃসন্দেহে গল্পের মান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। ব্লগে পড়া গল্পগুলোর সাথে বইয়ের গল্পগুলোর তুলনায় গিয়ে পাঠক হিসাবে একথা বারবার মনে হয়েছে।
যা হোক শুরু করেছিলাম ........র্দাপ গল্পটি নিয়ে। মানুষের ভাবনা নিয়ে কাঁটাছেড়া আমার বরাবরই ভালো লাগে। এইজন্যই হয়তো এই গল্পটি আমাকে নিদারুণ আকর্ষণ করেছে। গল্পটির বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেই একে দেখেছি। ক্ষেত্রবিশেষে গণিত কিংবা সায়েন্সের কিছু শব্দ দ্বারা গল্পের গতি বাঁধা পেয়েছে বলে মনে হলেও গল্পের এগিয়ে যাওয়ার ধরণ, মানুষের ছায়া ভাবনা আর সবশেষে সম্ভাবনাময় সমাপ্তি গল্পটা আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আমার ব্যাক্তিগতভাবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে শেষের জায়গাতেই -- উল্টাভাবে বিকশিত হওয়া কেউ স্পেশাল না। পুরো গল্পটাই টানটান, এবসার্ডিটির ব্যাপারগুলো দারুণভাবে টেনেছে।সবগুলো গল্পের মাঝে এই গল্পটি আমার সবচেয়ে প্রিয়।
এরপরে আসবে ৭ দশ ১' একাত্তর, 41 এবং নাম গল্প প্রযত্নে হন্তা। তিনটি গল্পকে আমি একসাথে রাখলেও গল্প বিচারে তিনটাই ভিন্নধর্মী। ৭ দশ ১' একাত্তর নাম শুনলে পাঠকের মাথায় যে ভাবনা আসবে কাহিনীর উপজীব্য ঠিক তাই। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতো এতো গল্প লিখা হয়েছে , এতো এতো সিনেমা হয়েছে অথচ বেশিরভাগই নায়ক ভিলেন কিংবা যুদ্ধের দৃশ্য চিত্রায়ন সহ নানা রকম সাধারণ ঘটনার সমষ্টি। এই জায়গাতে এই গল্পটি এগিয়ে থাকবে। নাম কিংবা বিষয় বহুল চর্চিত ক্লিশে হবার পরেও গল্পের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বর্তমানের চোখে মুক্তিযুদ্ধকে দেখবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে গল্পের সীমাবদ্ধতার জায়গা ছিলো সম্ভবত পরিসর। গল্পটি এত বড় পরিসরে গড়ে উঠেছে সবগুলো জায়গা হয়তো সঠিকভাবে চিত্রায়নের অভাবে ভুগেছে। 41 গল্পটি প্রথম থেকে পড়লে কোন খেয়ালি মানুষের চরম হেঁয়ালি মনে হলেও গল্পটি খুব ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছে গভীর অর্থ নিয়ে।ইউটোপিয়া বিষয়ক যেসব আইডিয়ার উপস্থাপন ঘটেছে সেটাকে বলতে এক কথায় দারুণ। তবে এখানেও সংখ্যার ব্যবহারের আধিক্য ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। নাম গল্পটি খুব চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছে একটা এলাকার মানুষের সুখ দুঃখ যাপিত জীবনের চিত্রকে। গল্পটার শক্তিশালী দিক এর বাক্যগুলো। অনেকগুলোই কোট করার মতো অসাধারণ।গল্পটা পড়তে থাকলে গল্পের ভিতর একদম ঢুকে যাওয়া হয় - যেন সেই গ্রামের উপরে উড়ে যাওয়া কোন শকুন হয়েই পুরা ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করছি।
পঁচিশে অক্টোবর, @মনীষী সিনড্রোম গল্পদুটার ভালো লাগার দিক হচ্ছে বিচ্ছিন্ন দৃশ্য গল্পের গাঁথুনিতে গল্পের বেড়ে উঠা। পঁচিশে অক্টোবর গল্পটা মূলত তার প্যাটার্নের জন্য বিশেষভাবে ভালো লাগা দাবি করে। লেখক পাঠকের কাল্পনিক মিথস্ক্রিয়া বেশ ভালো লেগেছে। তবে গল্পটির অসমাপ্ত পরিণতি পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখে যায়। বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে জোড়া দেবার ক্ষেত্রে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেমন গল্পের শক্তির দিক তেমনি দুর্বলতার দিকও। @মনীষী সিনড্রোম গল্পটিকে ডায়েরির ঘূর্ণনে বেড়ে তোলার মুন্সিয়ানার জন্য লেখকের আলাদাভাবে প্রশংসা প্রাপ্য। তবে তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে মনে হয়েছে মহাপুরুষ বিষয়ক অসমতা -- অর্থাৎ যে থিমকে উপজীব্য করে গল্পটি বেড়ে উঠেছে।
পাঠক হিসাবে উপরের প্রথম চারটিকে বেশ ভালো লাগা আর পরের দুইটিকে ভালো লাগা গল্প হিসাবে চিহ্নিত করবো। উপরের ছয়টিকে আমার কাছে অনেক বেশি কমপ্লিট মনে হয়েছে। এরপরের ধাপে আসবে গ ল গ্র হ, তবুও গলগ্রহ। গল্পটি আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে। পড়ে মনে হয়েছে আরো ভালো হতে পারতো। মানে লেখকের কাছে হয়তো সুযোগ ছিলো। তবে লেখক এই গল্পে অভিনবত্ব কিংবা বাস্তবতা কোন পথকে উপজীব্য করার চেয়ে পরীক্ষাধর্মী কোন লেখার অবকাশ পেয়েছেন বলে মনে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু জায়গার দীর্ঘায়ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়। লিখি চলো , পাঠক সমীপেষু গল্প দুইটিই লেখালেখি নিয়ে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে মজার। এই দুইটি গল্পকে সঠিকভাবে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারছি না। তবে লেখালেখি বিষয়ক কাটাছেঁড়া বেশ মজা দিলেও গল্প দুটোর ইন্টিগ্রেশন নিয়ে আরো ভাবার সুযোগ আছে। পাঠক সমীপেষু চমৎকার একটা স্যাটায়ার ধর্মী লেখা। মূল ধারা জনপ্রিয় ধারার তর্কও খুবই উপভোগ্য। তবে লেখাটি ডাবল পেসড। মানে পুরো গল্প চমৎকার এগুচ্ছিলো। তারপরে শেষের দিকে এসে হঠাৎ করে গল্প পাগলা ঘোড়ার মতো লাগামহীনভাবে ছুটেছে। লিখি চলো গল্পটা তুলনা মূলকভাবে সাদামাটা মনে হয়েছে। তবে ভঙ্গির জন্য এটা বেশ ভালো লেগেছে। দুই চরিত্র একটি সরব আরেকটি নিরব,অথচ দুজনের ক্রিয়াতেই গল্প বেড়ে উঠছে, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং ।
শেষ করবো ঈশিতা একটি আমগাছ বুনেছিলো এই গল্পটি দিয়ে। খুব সম্ভবত এটাই একমাত্র লিখা যেটা আমি অনেকবার পড়িনি। গল্পটার প্রগ্রেস খুব ফ্ল্যাট মনে হয়েছে। তবে সবকিছুর শেষ কথা আমি শুরুতেই বলে নিয়েছি। বাস্তব ক্লিশে হয়। তাই বাস্তবতার ক্লিশেকে পরিত্যাগ করে শুধু অভিনবত্বে গল্প দিলেও হয়তো বইয়ের পূর্ণতা হতো না।
বই নিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম। এই বইয়ের সাথে নিজের সামান্য কথা বলে রাখি। লেখক পরিচিত হওয়ার সুবাদের বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে লেখকের সাথে হালকা পাতলা কাটাছেঁড়া মূলক কথাবার্তা বলবার সুযোগ হয়েছিলো সেই সূত্র ধরেই গল্প তথা সাহিত্যের প্রতি লেখকের যে দায়বদ্ধতা, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। লেখার মান হয়তো সাহিত্যের বিচারে শুদ্ধবাদীদের কাছে নাম্বার পাবে না, তবে তরুণ লেখকদের শুদ্ধবাদী চিন্তা এবং শিল্প অনুরাগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমার উপরের আলোচনা পাঠক হিসাবে নির্মোহ হলেও শেষ করবো তরুণ গল্পকার মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে। প্রযত্নে হন্তার পথ ধরে আসুক আরো অনেক গল্প। শুভকামনা।