শেষ বিকেলের ক্লান্ত রৌদ্রের চুম্বনে একটু একটু করে চোখ মেলার চেষ্টা করি। শীর্ণ গলির জীর্ণ দালান ঘেরা আমার কামরাটিতে সূর্যের আলো আসার এই একটাই সময়। উঁকি মেরে রবি সাহেবের চেহারা দেখে সময় বুঝার চেষ্টা করি। ক্লান্ত রবিবাবু তেজ কমিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণের আগে যে রাঙা হয়ে যান তার আভাস মেলেনি এখনও। মটকা মেরে পড়ে থাকার চেষ্টা করি ঘাড় ঘুরিয়ে। তারপরে বসে গাঢ় করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করি। অর্থহীনভাবে বসে অপেক্ষা করি সূর্য ডোবার। তিনতলা থেকে সোজা নিচে সরু পথটাতে দাড়িয়ে থাকা একটা টোকাইকে ফলো করার চেষ্টা করি। তার মাঝে কিছুই খুঁজে পাই না আমি। আমার বোধ গুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। তারপরে চোখ দিয়ে এগিয়ে যাই গলি ধরে। অপেক্ষার সময়টুকু দীর্ঘ আরো দীর্ঘ মনে হয়। চোখের দৃষ্টি থেমে যায় একটু দূরে গিয়ে। চোখের দৃষ্টিসীমার পরিধি কমছে একটু একটু করে। কমার গতি দ্রততর হয়। একসময় দৃষ্টির আবছা অন্ধকার যখন আমার জানালার পাশে দাঁড়ায় আমি অন্ধকার দর্শনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।
আমি যখন নিচে আমার ঘুপচি গলিটা মাথায় তখন দিনশেষের বিষণ্ণতা জড়িয়ে শেষ বিকেলের রাঙা আলোকচ্ছটায় দিবাকরের প্রস্থান ঘটেছে। আলোর বিদায়ী বার্তা ঘোষণা করে গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে আধাঁর তার গুণগুণে একঘেয়ে বার্তা নিয়ে। আমি এগিয়ে যাই সরু রাস্তা ধরে শহরকে পিছে ফেলে আমাদের জায়গায় যাওয়ার রাস্তাটিতে। হ্যা আমাদের সেই জায়গা - যে জায়গায় আমরা ফেলে গেছি বহু অলস আড্ডা অনেক ধূলোমাখা স্মৃতি। সেই সময়গুলো সেই স্মৃতিগুলো আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ল। এমনিতে তারা আসে না । আজ আসছে আসছে বড়ই চেনা সুরে পুরনো গন্ধ নিয়ে। সামনের কাদামাটির সরু রাস্তার পাশেই চায়ের দোকানটা। দোকানটাতে আমি একটু চেপে বসতেই ধূমায়িত চা চলে এল। এখন আর বলতে হয় না। বলতে হওয়ার কথাও না। আমরা আসতাম এখানে চা খেতে। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সংখ্যা কমে গেছে কিন্তু তবু এসেছি। এখন আর আমরা নই আমি আসি। সাথের মানুষগুলো শেষজন বিদায় নিয়েছে তাও বছর দুয়েক হবে। আমরা আসতাম কেটলির ঝনঝনানি বেজে উঠত সারা সন্ধ্যা জুড়ে। চলতে থাকত উনুনের ধোঁয়া উঠা অনেক সময়ের জন্য। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দোকানের কুপির আবছা আঁধারে আমি সেই সময়গুলোকে দেখতে থাকি। দেখতে থাকি তিমিরবিলাসী কিছু তরুণের আঁধার যাপনের সেই ধূসর দিনগুলিকে। ক্রমশ অচেনা হয়ে যাওয়া মুখগুলো বছর পাঁচেকের আগের কৈশোরিক চাপল্যমাখা সরল চেহারা নিয়ে আমার আশেপাশে তাদের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে। তাদের উপস্থিতি আমি টের পেতে থাকি আমার বোধের প্রতিটি স্পর্শে।
স্মৃতিগুলো সাদাকালো অথবা ধূসর কিন্তু খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পরে আমার কাছে। আমরা বসতাম এখানে। আড্ডার ঝড় উঠত জোরে সোরে ধূমায়িত চা আর সিগারেটের ধূমের মিশ্রতায়। সেই সময়ের সেই মানুষগুলো সেই কমল সেই তুষার সেই লাবিব সেই আমি--- আর সেই সময়। আমাদের মাঝেকার আড্ডাগুলো খুব অদ্ভুত হতো। আমাদের সত্তাগত পার্থক্য সেটাকে জানান দিত প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে। তুখোড় বক্তা কমলের কথাই শোনা যেত সব চেয়ে জোরে। তার কথাগুলো আমাদেরকে নিজেদের ক্ষদ্রতা সম্বন্ধে সচেতন করে দিত। আমরা ভাববাদী কিংবা ভোগবাদীরা যে কতটা সংকীর্ণ কতটা মূল্যহীন চিন্তায় জীবনপাত করছি তা সতর্ক দেয়া ঘোষণা থাকত তীব্র। আমি আর লাবিব কেবল শুনে যেতাম বিমুগ্ধ শ্রোতারূপে । তুষার অবশ্য এত সহজে থামার ছেলে না। থামার কথাও না। তুষারকে দেখে আমি যে মাঝে মাঝে ভয় করতাম না তাও কিন্তু না। সমাজের এক বিশেষ উচ্চতায় বাস করা পরিবারের ছেলেরা বুঝি বা এমনই হয়-- তর্ক প্রেম যুদ্ধ সবকিছুতে তাদের জয়টাকে নিয়তি ধরে নেয় বহুল অভ্যস্ততা জনিত কারণে। কিংবা না মনে হয় খুব বেশি জেনারালাইজ করে ফেলছি না তো?
আচমকা ধাক্কা খেয়ে আমার ঘোর ভাঙে। - এই মিয়া , দেইখ্যা পথ চলতে পারো না? হঠাৎ করে অপরিচিত কারো তুমি সম্বোধনে আমি হকচকিয়ে উঠি। তাকাই খুব ভালো করে। নাহ !! গাড়িতে বসা সান গ্লাস পড়া যুবকটিকে আমি চিনি না। কিংবা হয়তো কখনো দেখেছি কি? আমি ঘোর থেকে বাস্তবতায় ফেরার চেষ্টা করি। আমি যেন কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম? এই ব্যাটা চুপ করে আছস কেন? নেশা করেছস নাকি? তুমি থেকে তুইয়ে নেমে যাওয়ায় নিজের স্ট্যাটাস বাঁচানোর চিন্তা মাথায় আসে। নিজের পরিচয়টা ভাবলাম একবার দেই। পরে মনে হলো থাক। কি হবে আর। বরং যে জিততে চায় তাকে জিতিয়ে দেই।- দেখি নাই ভাই, মাফ কইরা দ্যান।কুৎসিত একটা গালি দিয়ে কোন এক আমলার দামি পাজেরোর গ্লাস বন্ধ করে যুবকটি যখন আমর দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃশ্য হয় আমার ভাবনার তুষার যেন চলে যেতে থাকে সেই গাড়ির সাথে সাথে অনেক দূরে।
নিজের ভাবনাগুলোকে সাজানোর চেষ্টা করি। আমি যেন কী জন্য বের হয়েছিলাম? ও হ্যা অন্ধকার দেখতে। অন্ধকার দেখতে থাকি। কথাটা নিজের কাছে খটমটে লাগে। কোন কিছু দেখা না গেলে অন্ধকার লাগে তাহলে অন্ধকার আবার কিভাবে দেখে? বেশিক্ষণ নিজের মাঝেকার এই কুতর্ক চালানো গেলো না। সামনে ভাসমান লোকদের মাঝে যখন আনমি হেঁটে চলেছি তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ বোধ করছি। নাহ!! নিজের কাছে নিজে এভাবে মিথ্যা বলে হিপোক্রেট হতে মন চাইছে না। আমি কি এই মানুষগুলোর হিতের জন্য তাগিদ বোধ করছি ? নাকি সমাজে নিজের
সুশীল মুখ বজায় রাখার জন্য অথবা নিজের কাছে নিজেকে উন্নত চিন্তার বাহক বলে বাহবা দেয়ার লোভে। কেন জানি হঠাৎ করেই কর্পোরেট চাকুর নিয়ে দেশত্যাগী কমলের কথা মনে আসতে চায়। থেমে যাই হঠাৎ করেই। সামনে একটা টংয়ের দোকান দেখে পেটের মাঝেকার ক্ষুধাটা বেশ চাগিয়ে উঠে। খাবার বলতে খুব বেশি কিছু না। ছো্ট ছোট কিছু বনরুটি টোস্ট বিস্কুট কেক আর চা, এই বাইরে মনে হয় না তেমন কিছু পাওয়া যায়। দোকান সংলগ্ন লোকগুলোর কথা তাদের জীবনের গল্পকে অনুভব করার চেষ্টা করি। একটু হলেও যেন উপলব্ধি করতএ পারছি কিংবা কে জানে হয়তো কখনোই পারবো না।
লাবিব ছেলেটার প্রতি আমার ভক্তি বোধটা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। যে জীবনকে দেখতে কিংবা বিলাসযাপন করতে একদিনের জন্য আমি বেরোই সেই জীবন থেকেই বেরিয়ে এসেছে ও। এই জীবনকে একদিন দুদিনের জন্য রোমান্টিক মনে হতে পারে কিন্তু দীর্ঘযাপনে সে হয় একঘেয়ে ক্লান্তিকর ও অসহনীয়। যেই জগত ঘোর অমানিশা দিয়ে ঢেকে আছে আমদের মত সুশীলদের লোকচক্ষুর আড়ালে।ওর প্রেমটার কথা ভেবে মন যেন কেমন করে উঠে।ছেলেটাকে দেখেছি নিজের মানবিক ভাবনাগুলোকে চেপে রাখতো তার নিজের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায়। তার বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ হতো খুব হিসাব করে। বাসার পাঠানো টাকা আর নিজের কামনো কিছু টাকা দিয়ে কখনো হয়তো বা একটু বেশিই কিপ্টে মনে হতো তাকে। কখনও যে তার রূঢ় রূপটাও দেখিনি তাও তো নয়। খুব বেশি সামাজিক না হয়তো ছেলেটা। কিন্তু অসম্ভব মনোবলের অধিকারী। চায়ের চুমুকে চুমুকে আমার মনে বন্ধুদের সমালোচনার ঝড় তুলে ফেলছি। এবং এমন সময়ই আমি হঠাৎ করেই ওদের তুলনা করতে থাকি বেশি রকম। লাবিব আর তুষারের ভালোবাসা দাড়িপাল্লায় বসে যাচ্ছে। একদিকে নিজের ভালোবাসাকে লোভে গ্রাস থেকে রক্ষাকারী অপরদিকে পরিপার্শ্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রেম ছিনতাইকারী।
ভাবনা জটিল হয়ে গেলেই আমার স্থবিরতা কেটে যায়। আমার পথ চলা শুরু হয় আবার । আমি হাঁটছি কোথায় বুঝতে পারি না। তবু হেঁটে যেতে থাকি। আবার এগিয়ে যাই। ফুটপাতের সোডিয়াম আলোতে আমার ছায়া অন্ধকারে তলিয়ে যায় না। বরং সে চলতে থাকে আমর আগে। ছায়ার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি -- দেখতে থাকি আমার অবয়বকে। আমার অবয়ব কী সুন্দরভাবে আমার মাঝেকার মানুষটিকে ঢেকে রেখেছে। তাকেও আমার অচেনা মনে হতে থাকে। আমি অনুভব করতে থাকি আমার অবচেতন মন আমাকে টেনে নিয়ে যায় শুধুই এক বাড়ির দিকে। লোডশেডিং চলছে। আশেপাশের সবদিকে অন্ধকার। আজ অমবস্যা অতএব চাঁদও উঠবে না। আমি খুব সন্তর্পনে দাড়িয়ে থাকি আমার চিরপরিচিত জায়গায়। এখান থেকেই আমি দেখতে পাই শুভ্রার মলিন অপেক্ষমান দুটি চোখ-- একদিন যে আমার জন্য অপেক্ষা করত, আমি একদিন যার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেই চোখ সেই বিষণ্ণতা সেই কষ্টচাপা হাসিমুখ। নিজের মাঝেকার মানবিক অনুভূতিগুলো নাড়া দিতে থাকে কিংবা নিজেকে মহান ভাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না আমার প্রতারক সত্তা। সময়ের ব্যবধানটা খুব বেশি না। মিনিট পাঁচেকেই আমার অন্ধকার দর্শন শেষ হয়ে যায় যেন। কোন এক শিশুর কান্নায় কারো এক হাত ধরে শুভ্রার ঘরের ভিতরে চলে যাওয়া সমাপ্তি ঘোষণা করে যেন তার।
তারপরে--- তারপরে আমি টলতে থাকি পথ ধরে। লোডশেডিং চলছে এখনও। না চললেও খুব যে লাভ হতো এমন না। অন্ধকারে পথ হাতড়ানোর মাঝেই পুলিশ এসে দাড়ায়। তাদেরকে আমার পরিচয় দিতেই তারা আমাকে উঠিয়ে নেয় গাড়িতে আমার ঠিকানায় পৌছে দিতে। গাড়ি এগিয়ে চলে। গাড়ির অন্ধকারে আমার ছায়ার অবয়ব হারিয়ে গেছে। তার চেয়ে বড় শূন্যতাবোধে ভুগতে থাকি আমি --- সেই কমল সেই লাবিব সেই তুষার--- তাদের মাঝেকার অন্ধকারগুলোকে আমি গ্রাস করে নিতে থাকি।
গাড়ি থেকে নামার পর তীব্র আলোর মাঝেও যাপিত অন্ধকারে ডুবে গিয়ে নিজের ছায়া নিজের কাছে অচেনা মনে হতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১:০০