আগের খন্ড দেখতে ক্লিক মারেন।
নিঝুম দ্বীপে আমাদের ২য় রাতে ভয়ঙ্কর ঝর হলো, তাঁবু উড়ে যায় আরকি, ভেজার ভয় ভুলে তাবুর সব দরজা জানালা খুলে দিলাম, যাতে প্রচন্ড বাতাসে ঘুড়ির মতো উড়ে না যায়, ঝরো বাতাস দরজা দিয়ে ঢুকে জানালা এবং ছাঁদ দিয়ে বের হয়ে যায়।
প্রচন্ড ঝরের পরে ৭টার মধ্যেই সব ম্যাজিকের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। কোন রকমে তাবু-টাবু সাইজ করে সব সাইক্লোন সেন্টারে রেখে আমরা বেরুলাম জঙ্গল ঘুরতে। দলটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেল শুরুতেই। আমাদের দলে দশ-বারোজন।
দ্বীপের আদ্ধেকটা ঘুরে একটা জলার কাছে এসে দেখি দলের সঙ্খ্যা কমে গেছে। জঙ্গলে ঢোকার আগেই একদল হরীনকে দেখলাম লেজ উচিয়ে দৌড় মারতে। প্যাচ প্যাচে কাদায় প্রায় আধাঘন্টা হাটার পরে বিরক্ত হয়ে লোক কমতে থাকে। প্রতিবারই হরীনের পাল দেখা দিয়েই দৌড়ায়। বন্য-প্রানী দেখতে হলে নিরবে পথ চলতে হবে, বাতাসের উলটো দিকে হাঁটতে হবে, বড় দলে এত নিয়ম মানা সম্ভব না। শেষে দেখি শুধু আমি আর কামরুল। একটু পর পরেই হরীনের দল। নিঃশব্দে কাছে যেতেই কিভাবে যেন টের পেয়ে বার বার ছুট লাগায়া। আমরা দুজন বেশ প্রায় কোয়ার্টার মেইল দুরত্ব রেখে দুটো গাছে উঠে বসে রইলাম। খালের কাছে। হরীনের দল এবারে ওগুলোর ধারে কাছেও আসেনা। বসে বসে কাঠ পিপড়ার কামড় খাওয়াই সারা।
পিপড়ের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গাছ থেকে নেমে হাটু কাদা ভেঙ্গে উদ্দ্যেশহীন ভাবে ঘুরছি। তিলা ঘুঘু, কুড়া, তিলা বাজ।
কামরুল এক্সপার্ট ফটোগ্রাফার। তার দেখা দেখি আমিও ভাব নিলাম, হরীনের ছবি তুলতে আসছি, না পেলে আর কিছু তুলবো না, মনে মনে আহা উহু করছি। খিদেয় পেট চো চো করছে তখন বেরুলাম জঙ্গল থেকে। একটা বড় রাস্তা পেয়ে সেটা ধরে সোজা হাটতেই একটা দোকান পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা হলো দুজনের পকেট থেকে বেরুলো মাত্র ১২টাকা। এটা দিয়ে দুজনের লাঞ্চ করা সম্ভব না। তাই দু কাপ চা, আর কয়েকটা বিস্কিট মুখে দিয়ে পেটে কিল মেরে বসে থাকতে হলো। দলের বাকীরা ক্যাম্পে ফিরে ভুরীভোজন করছে ভাবতেই খিদেটা যেন লাফিয়ে বাড়লো।
আধাঘন্টা রেস্ট নিতে নিতে বিকেল হয়ে যায়। এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে সারাদিনের জন্যে টেবিল আটকে রাখা যায়না। তাই আবার ঢুকলাম জঙ্গলে। ঢুকতে না ঢুকতেই খালের পাশ থেকে একটা হরীণের পাল দৌড় লাগালো কষে। প্রথমে ভাবলাম আমরাই একমাত্র ভয়ের কারন। কিন্তু দেখলাম বনের শিকারী কুকুর গুলো বের হয়েছে।
নিঝুম দ্বীপে যখন মানুষ বসতী করলো, সাথে করে আনলো মানুষের আদিবন্ধু কুকুর। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা তখন নিষ্ঠুর প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জেতার চেষ্টা করছে। পুরো দ্বীপ ভর্তি জঙ্গল। জঙ্গলে অজগর এবং বনমোষের দল, দুটোই বন বিভাগের ছাড়া। এছাড়া দ্বীপে পানির উৎস নেই। কুপ খুড়লেও ওঠে নোনা পানি। আর প্রমত্ত মেঘনার একদম মোহনায় হওয়ায় রুদ্রবঙ্গোপসাগরের উত্তাল আক্রমন লেগেই আছে। খাবারের অভাব দেখে কুকুরের দল বনে ঢুকে মহাখুশি।
গ্রামের কৃষক নিজেই খেতে পারেনা, আর কুকুরকে কি খাওয়াবে। আর বনের ভেতরে ছড়িয়ে আছে বড় বড় লোভনীয় নধর চিত্রা হরীনের পাল। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে শিকার করলেই হলো। কুকুরের মাঝে সহজাত শিকার প্রবনতা আছে, হাজার বছরের প্রভুভক্তিতে সেটাতে মরচে পড়লেও ডিএনএ’তে সুপ্ত দল বেধে শিকার করার সহজাত কৌশলটা রপ্ত করতে এক প্রজন্মের বেশী লাগলো না। এখন এই কুকুরগুলোই নিঝুম দ্বীপের একমাত্র হিংস্র প্রানী। মানুষকে আক্রমনের কোন ঘটনা হয়নি, সম্ভবত দ্বীপটা অনেক ছোট বলেই মানুষের উপস্থিতি এড়ানোর সুযোগ নেই, আর কুকুরগুলোও পুরোপুরি বন্য হয়নি। কিন্তু জঙ্গলী কুকুরের মতো দল বেধে শিকার করাটাও চলছে। শুনেছি ক্যাপ্টেন কুকের সদ্য আবিষ্কৃত অস্ট্রেলিয়া মহাদেশী ব্রিটিশরা যখন কলোনী করতে আসে সেখানে কোন হিংস্র স্থলচর ছিলনা। কিন্তু সেটলারদের সঙ্গি পোষা কুকুরগুলো বনে পালিয়ে বিবর্তিত হয়ে ভয়ঙ্কর হিংস্র ডিংগো’তে পরিনত হয়েছে।
বিকেল বেলা আবার ঢুকলাম অরন্যের গভীরে। ঢোকার মধ্যেই দেখি আরেকদল টুরিস্ট গ্রুপ এসেছে। সাথে এলাকার গাইড নিয়ে। গাইড’রা গাছ কেটে পাতা ছড়িয়ে রাখবে আর পাতার লোভে হরীন আসবে। কিন্তু এদের উপরে ভরসা করতে পারি না। দলের সবাই হৈ চৈ করে গল্প গুজব করছে, শব্দ করে জঙ্গল ভেঙ্গে হাঁটা-চলা করছে, ভুস ভুস করে সিগারেট টানছে, গন্ধে হরীনতো হরীন বোকা পাঁঠাও দৌড় লাগাবে।
ওরা অবশ্য বেশী ভেতরে গেল না। আমরা সাবধানে খাল গুলো পেরিয়ে গভীরে ঢুকে গেলাম। জঙ্গলে ইতিমধ্যে কুকুরের দল বেড়িয়ে এসেছে। খালের ওপার দিয়েই ৩টে কুকুর সারী বেধে দুলকি চালে চলছিলো, খুব সাধারন দেশী কুকুর, ভালো খাওয়ার জন্যে হয়তো স্বাস্থ্যটা ভালো, ছোট বেলায় আমার পোষা কুকুর ‘বাঘেরা’র সাথে চেহারায় কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু চোখের দৃষ্টিটাই কেমন যেন ক্রুর। একটু পর পর জঙ্গলের ভেতর থেকে পৈশাচিক কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সাধারনত মানুষ দেখলে কুকুর হয় ঘেউ ঘেউ করে, অথবা আদুরে কুঁ কুঁ জাতীয় আহ্লাদি দেখায়। এর বাইরে এই ভয়ঙ্কর শিকারী গর্জন সত্যি কেমন করে। কি মনে করে হাতে মোটা দেখে একটা লাঠি নিলাম। আমার কান্ড দেখে কামরুল হাসে, শেষমেষ কুকুরের ভয়ে হাতে লাঠি!
চুপচাপ জঙ্গল ভেঙ্গে গভীরের দিকে যাচ্ছি। গ্রাম এখান থেকে এখনো বেশ কাছে... তাই কামরুল যখন হাত চেপে খালের ওপারে ইঙ্গিত করলো প্রথমটায় বুঝতে পারলাম না। পাতার ফাঁক দিয়ে হরীনের দল। চোখে অপার বিস্ময়। হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ১০/১২টার ছোট পাল। সবাই যেন স্থবির হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, ঠিক এদিকেই। ভালো ছবি পাওয়ার জন্যে দুরত্ব এখনো অনেক। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যেও প্রায় খোলা অংশে দাঁড়ানো হরীনের পাল দেখে মনে হচ্ছে যেন পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলার জন্যে পোজ দিচ্ছে।
আরেকটু গভীরে যাওয়ার সময় খালের ওপারে কুকুরের প্রচন্ড হুঙ্কার, আর পরিচিত একটা মানুষের দেহাবয়ব দেখা গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি সেটা আমাদের মনা ভাই। ৩/৪টে কুকুর বিপদজনক দুরত্বে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে তাকে উদ্দ্যেশ্য করে। যদিও দেশী পোষাকুকুর, কিন্তু জঙ্গলে যেন তারাই বাঘ। কুকুর তাড়ানোর জন্যে যেই মোটা লাঠিটা নিয়েছিলাম, সেটা বাড়িয়ে দিতেই গভীর খালটা হাইজাম্পের রেকর্ড ভেঙ্গে এক লাফে মনা ভাই এদিকে। কিন্তু অবাক কান্ড, সে বেড়িয়েছিল ১০/১২ জনের দল নিয়ে এখন মোটে ১জন, আর কুকুরগুলো নধর নধর হরীন ফেলে তাকেই বা তাড়া দিল কেন? জানলাম, দুপুরের দিকে সবাই লাঞ্চের জন্যে ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে কেউ আর বেড়ুতে চায়নি। একা একা জঙ্গলে নিঃশব্দে ঘুরলে ভালো ছবি পাওয়া যাবে ভেবে মনা ভাই একাই ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখে সদ্য শিকার করা এক প্রকান্ড শিঙ্গি হরীনের দেহখন্ড একপাল কুকুর ছিড়ে খুড়ে খাচ্ছে, কি মনে করে পৈশাচিক সেই দৃশ্যের ছবি তুলতে গেলে কুকুরের পাল তাদের ফিস্টে অনাহুত অতিথীকে ধাওয়া লাগায়... কি করতো বা করতে পারতো জানিনা, কিন্তু কুকুরগুলোর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই কেমন জানি বন্য।
আমরা এবার ৩জনে বেরুলাম। আগের প্ল্যান মতো জঙ্গলের বেশ গভীরে, একটা ছোট মাচা, গাছ লতা পাতার ন্যাচারাল ক্যামোফ্লেজে প্রায় অদৃশ্য। পাশেই দুট খালের সঙ্গম, প্রচুর হরীনের খুড়ের দাগ, আর লাদা পড়ে আছে। জোয়ারের সময় মিষ্টি পানির লোভে হরীনের দল এখানে আসতে বাধ্য। ব্যাপারটাকে আরো জোড়ালো করতে পকেটের সুইস নাইফ দিয়েই কেওড়ার রসালো পাতা আর ডাল কাটতে লেগে গেলাম। হরীনের জন্যে সুবিধাজনক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে ৩ জনে সেই মাচার ভেতরে ঘাপটি মেরে রইলাম।
বাতাসের উলটো দিকে, শুধু মনা ভাইয়ের দৈত্যাকার নিকর ৩০০মিমি লেন্স ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। বসে বসে ম্যাদা মেরে গেলাম, কিন্তু হরীনের দেখা নেই। আলোও কমে আসছে দ্রুত। চুপচাপ কোন কথা না বলে, নড়াচড়া না করে বসে থাকা যে কি বিচ্ছিরি ব্যাপার, জিম করবেট বা পচাব্দিগাজীর গল্প পড়তেই ভালো লাগে, কিন্তু জঙ্গলে লতাপাতায় লুকিয়ে অপেক্ষা করা যে কত নিরস হতে পারে... বসে বসে মাছি মারতেও পারি না, পাছে হরীনের দল শুনে ফেলে। একটা দুটো হরীন যে আসে নাই, তা না, দেখা যায় ঠিকই। কিন্তু সন্ধ্যার ম্লান আলোতে ওরা এত বেশী দুরত্ব বজায় রাখলো যে ঝাপসা ছবি তোলাও অসম্ভব। মনা ভাই অবশ্য তার শক্তিশালী লেন্সের পুরো সুবিধাই নিলো। উচু উচু গাছের মগডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখিগুলোও বাদ রইলো না, ধমাধম শ্যুট। না গুলি না, বন্দুকের মত লেন্স লাগিয়ে ফ্রেম বন্দি করে আর প্রিভিউ গুলো আমাদের দেখিয়ে হিংসায় জ্বালিয়ে মারে। দুর্দান্ত রাজকীয় ভঙ্গিমায় কুড়া, ধবধবে বুনো সৌন্দর্যের স্পটেড বাজ পাখি, পানির কাছে ডালে ঝিমাতে থাকা সাবলিল পানকৌড়ি। আমি অনেক চেষ্টা তদবির করে নিভু নিভু আলোতে কয়েকটা তিলা ঘুঘু (যতোটা জানি বাংলাদেশ ৪ কি ৫প্রজাতির ঘুঘু পাওয়া যায়। মাংস সুস্বাদু হওয়ায় এবং আচরনে প্রজাতির অন্য তালাতো মামাতো ভাইবোনদের চেয়ে বোকা হওয়ায় অসম্ভব সুন্দর তিলা ঘুঘু শিকার করা সহজ আর এরাও নির্বংশ হতে চলেছে।)
রাতের আধার ঘনিয়ে আসতেই কুকুর গুলো যেন পাল্লা দিয়ে হিংস্র হতে থাকলো। নিস্তরঙ্গ ঝি ঝি ডাকে একটু পর পরেই ছেদ পড়ে তাদের গগন বিদারী হুঙ্কার আর শিকার পাওয়ার পৈশাচিক উল্লাসে। মাঝে মাঝে কানে আসে দুর্ভাগা হরীনের আর্তনাদ।
দলের কাউকে না বললেও মনে মনে প্রস্তুতী নিয়েছিলাম জঙ্গলে ঢুকলে সহজে বের হবো না। যথেষ্ট পানি, সুইস নাইফ, আর টর্চ ছিল। তাই জঙ্গল থেকে বের হতে সমস্যা হলো না। আগামী কাল সকালে ঢাকার উদ্দ্যেশে রওনা হবো খুব ভোড়ে, ভাটা শুরুর আগেই। ক্যাম্পে একবারও ফিরি নাই। শুধু আমরা দুজনই লাঞ্চ করতেও যাইনি। টুটু ভাই মনে হয় ছিলা ফেলবে। কিন্তু সারাদিন বনে সত্যিকারের ট্রেকারদের মতো করে কাটানোর সুন্দর অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা আকাশ ভরা তারার আলোয় পথ চলতে লাগলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দূরে আমাদের তাঁবু গুলোর আলো দেখা যেতে লাগলো।
(শেষ!)-----------------------------------------------
দি লোনলী ছাগু। : P