যাই হোক, সংক্ষেপে কিছু বলে নেই। আমরা সকলে মিলে ২-১১-২০১০ রাত এগারোটায় রওনা হয়েছিলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে, গন্তব্য ছিল থানছি-তিন্দু-রেমাক্রি-মদক হয়ে সাঙ্গু রিসার্ভ ফরেস্ট ও আন্ধার মানিক, এবং মাঝ খানে রেমাক্রিতে নাফাখুম এবং ব্যাটকেভ অভিযান।
তবে মাঝখানে যে পুরা জার্নি ডাইভার্ট হয়ে এর থেকেও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল তা কে জানত।
প্রথম দিন আমরা সাঙ্গু বেয়ে তিন্দু হয়ে বড় পাথরের পাশে ক্যাম্প করি। পরের দিন একদম সকাল সকাল রাজা পাথরের আশে পাশে একটু ঘুরা ফিরা করেই সোজা রেমাক্রি বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকালের একটু আগে রেমাক্রি পৌছাই এবং সেখানে গোসল টোসল করে ব্যাক প্যাক নিয়ে উঠি রেমাক্রি রেস্ট হাউজে। এখানে ট্যুরিস্টদের থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। পার নাইট পার পার্সন ৬০ টাকার মত চার্জ করে থাকে তারা, তবে এখন কি অবস্থা জানি না, যেই হারে ট্যুরিস্ট যাচ্ছে!!
থানছি বাজার থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত যদি ইঞ্জিন নৌকায় আসেন তবে ৪-৫ ঘন্টা লাগবে সর্বোচ্চ। কিন্তু আমরা হাতে বাওয়া নৌকায় এসেছিলাম, তাই সময় কিছু বেশি লাগে। পুরোটা নদীপথ একটা স্বপ্নের মত, দুই পাশে খাড়া পাহারের দেয়াল, চারিদিকে বড় বড় পাথর আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির সাঙ্গু নদী
আমার আগের পোস্টগুলির লিংক এখানে
Click This Link
Click This Link
Click This Link
পরদিন একদম ভোরবেলা রওনা করি আমরা রেমাক্রী খাল ধরে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে। টার্গেট ছিল সকাল সকাল নাফাখুম দেখে রেমাক্রী ফিরে এসে সেদিনই ব্যাট কেভের দিকে যাত্রা করা।
রেমাক্রি খাল
রেমাক্রি বাজার থেকে নাফাখুম যেতে লাগে মাত্র ২.৫ ঘন্টা। পথিমধ্যে একটা জায়গাতে পানি কিছুটা বেশি, তাই বাশের ভেলাতে করে খাল পাড় হতে হবে।
এই সেই নাফাখুম। যার ছবি দেখতে দেখতে আপনারা একদম বোরড হইয়া গেছেন গত ১ বছর ধরে
তো নাফাখুমে আমরা বেশ কিছু নাচন কুদন করে ফিরে যাবার জন্য হাটা দেই। থানছি বাজারে কিছু লোকজনের মুখে শুনেছিলাম এই নাফাখুমের মত কিন্তু এর থেকেও নাকি আরও সুন্দর একটা ঝরনা আছে যেটাতে যেতে নাফাখুম থেকে আরো ২ দিন লাগে। কিন্তু এই ব্যাপারে কেউ কোন সঠিক তথ্য দিতে পারে নি। কেউকেউ যায়গাটার নাম নাক্ষিয়ং বলে সম্বোধন করছিল। নামটা মাথায় ছিল কিন্তু অতটা সিরিয়াসলি কেউ নেই নাই
নাফাখুম থেকে ফেরার পথে এক লোক, নাম বদিচন্দ্র, সে জানালো সে এই নাক্ষিয়ং জায়গাটা চেনে। সে নাকি ৮ বছর আগে একবার গিয়েছিল।
আরও জানতে পারি এখানে নাকি মানুষজন খুব একটা যায় না, পথ একদমি ভালো না, এখন পর্যন্ত কোন বাঙ্গালী বা ট্যুরিস্ট সেখানে পা ফেলেনি।
ফেসবুকে আমাদের তোলা ছবি এবং টিংকু ভাইয়ের বাংলালিংক বাংলার পথে অনুষ্ঠান দেখে এখন অনেকেই নাক্ষিয়ং-আমিয়াখুম-সাতভাইখুম দেখতে আসছেন
এইডা আমি
যাই হোক,আমরা বেলা ১ টা নাগাত নাফাখুম থেকে যাত্রা করি। পথিমধ্যে বদিচন্দ্র গাইড আমাদেরকে তার পাড়ায় নিয়ে যায়, রাইদংছং পাড়া। সে পাড়ার কার্বারি আমাদের সে কি খাতির। মটরশুটির ঝোল তরকারী, শাক আর ডাল দিয়ে জব্বর এক লাঞ্ছ করলাম সবাই মিলে, খাওয়া শেষে কার্বারি কিছুতেই আমাদের কাছ থেকে বিল নিবে না ।রেমাক্রি বা তিন্দুতে এই ধরনের আতিথেয়তা পাবেন না, সেখানকার মানুষজন কিন্তু এখন কক্সবাজার হোটেল ব্যবসায়ীদের থেকেও প্রফেশনাল হয়ে গিয়েছে।
আমরা ২ টার দিকে আবার যাত্রা করি, এবারের ট্রেইল পুরাটাই রেমাক্রি খাল ধরে।
অদ্ভুত এই যায়গা রেমাক্রি খাল, বিশাল বিশাল পাথর, মাঝ খান দিয়ে বয়ে চলেছে নীল স্বচ্ছ পানি। এই খাল ধরে যতই এগোচ্ছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে এসে পড়েছি।
মাঝে মাঝেই পাহারের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে সূর্য। আধো আলো আধো আধারির মাঝে সেই পাথুরে স্বচ্ছ পানিতে কোমর ডুবিয়ে পার হতে হচ্ছে খাল একটু পর পর।
আসলে আমাদের বাংলাদেশ যে এতটাই সুন্দর তা বান্দরবানের ভিতরে না ঢুকলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না।
একদম সন্ধ্যার দিকে আমরা পৌছাই জিন্নাপারাতে ( জিন্না একটা ত্রিপুরা শব্দ)। এখানেই আমরা রাতে থাকব।জিন্নাপারার লোকজন আগে কখনো ট্যুরিস্ট দেখেনি, যদিও পাড়া থেকে কিছুটা উপরে একটা বিজিবি ক্যাম্পও আছে। পাড়ার হেডম্যান রাই বাহাদুর আমাদের অসম্ভব আদর যত্ন করলেন।
এর মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাপার। আমরা নভেম্বর এর শুরুর দিকে ঢাকা ছাড়ি, জিন্নাপারাতে এসে পৌছাই ৮ কি ৯ তারিখে। পথিমধ্যে
কখনো গরম কাপড় ব্যবহার করতে হয় নি। অথচ এই জিন্নাপারাতে রাতের বেলা যে সে কি শীত, ঢাকাতে ডিসেম্বরেও এত শীত পড়ে না।
সে রাতেই হেডম্যান জানালো আমাদের নাক্ষিয়ং যেতে হলে সকাল সকাল রওনা করতে হবে, কারন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এই নাক্ষিয়ং হচ্ছে রেমাক্রি খালের একটা প্রান্ত যেখানে আরো কিছু ঝিরি এক পয়েন্টে এসে মিসেছে।
আমরা পরদিন সকাল সকাল রওনা হই।
চারিদিকে মাথা খারাপ করা সবুজ, কোথাও কোথাও পাহাড়ের খাজে আটকে আছে মেঘ, এরি মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা কজন।
জিন্নাপারা থেকে নাক্ষিয়ং যেতে ঘন্টা চারেকের মত হাটতে হবে, ট্রেইল মোটামুটি পরিস্কার, ঘন ঝোপঝারে ঢাকা পাথুরে গুহার মত কিছু যায়গা পরবে পথে, যেখানে সূর্যের আলো ঢুকে না খুব একটা। এই পথগুলো বেশ থ্রিলিং, মনে হয় যে কোন সময় কোন বন্য প্রানী ঘাড় মটকে ধরবে।
ঘন্টাখানেক হাটার পর আমরা একটা বাঁশবাগানে এসে পৌছাই, বাস্তবিক এই জায়গাটিকে দেখে মনে হচ্ছিল ডেড এন্ড। কারণ সামনে আর কোন রাস্তা নেই। ঘন জঙ্গল পুরাটাই ৮০ ডীগ্রি এঙ্গেলে নেমে গেছে। আরো ভয়ের কথা হচ্ছে পুরাটা রাস্তাই আলগা মাটির এবং বেশ পিচ্ছিল। আমাদের গাইড সামনে এগিয়ে গিয়ে দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছিল, এদিকে আমরা সবাই জোকের কামরে অস্থির। আমি জোক বাছতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আছারও খেলাম, একবার তো প্রায় পাহারের কিনারায় চলে গিয়েছিলাম,হয়ত আর একটু সরে গেলেই হাজার ফুট নিচে পরে মরতাম।
পুরাটা জঙ্গল আমাদের নামতে হয়েছে ৭০০-৯০০ ফুটের মত, আমার জীবনে এতটা ভয়াবহ ট্রেইল আমি দেখিনি। জাদিপাই ঝরনার রাস্তা কিছুটা এইরকম, কিন্তু সেখানে মাটি ছিল অনেক শক্ত এবং নামতে হয় মাত্র ১৫০ ফিট। সে গল্প পরে করা যাবে
আমরা যে জায়গাটাতে নামি সে জায়গাটা হচ্ছে একটা ঢালু কুয়ার মত। চারিদিকে বিশাল পাহারের দেয়াল, মাঝখানে খরোস্রোতা রেমাক্রি খাল।
খালের পানিতে ধরা কালবাউশ মাছ
ছবিঃ নাক্ষিয়ং ( চন্দন ভাইয়ের ক্যামেরা থেকে তোলা)
কিছু সামনে গেলেই রেমাক্রি খাল খাড়া হয়ে নেমে গেল, এটাই আমিয়াখুম জলপ্রপাত।
আমিয়াখুম জলপ্রপাত। বলেন তো কোনটা বেশী সুন্দর নাফাখুম না আমিয়াখুম?
এদিকে আবার সন্ধ্যা হয়ে আসছে। গাইড ভাগ্যচন্দ্র জানালো এখানে নাকি রাতের বেলা মাঝে মাঝে ভালুক আসে মাছ খেতে। আমরা আর কথা বাড়াই না, মাছের থেকে তো আমরা আরো ভালো খাদ্য
আবার উঠে যেতে হবে সেই ভয়াবহ জঙ্গল বেয়ে, কিন্তু গাইড জানাল রাস্তা আরেকটা আছে, সেটা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। ব্যাটা আগে কবি না???কত্ত পাজি
সেই তুলনামূলক নিরাপদ রাস্তা দিয়ে আমরা উঠে আসি নাক্ষিয়ং ভ্যালী থেকে। এরপর শুধু ঘরে ফেরা। পুরা ১০ টা দিন ঘরবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেরালাম। এখন বাড়ি ফেরার পালা, সাথে সঙ্গী কিছু অদ্ভুত স্বর্গীয় স্মৃতি। এ এক এমনি জায়গা, একবার দেখলে মন ভরে না, বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই পাহারি ঝিরির শব্দ, বুনো পাতার গন্ধ, এই আকর্ষন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। একবার বান্দরবানের পাহারের প্রেমে পড়লে তা সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায় তাইতো নাওয়া নাই , খাওয়া নাই, ঘরবারি অফিস নাই, যখনি পাহাড় কু ডাক দেয়, সব ছেড়ে ছুড়ে বান্দরবানের দিকে ছুটে যাই।
অক্টোবর-ডিসেম্বর আমিয়াখুম দেখার উপযুক্ত সময়, এই সময়ে পানি থাকে একদম স্বচ্ছ, পানির ধারাও থাকে একদম কানায় কানায় পূর্ণ, ট্রেইলটাও কিছুটা সেফ। বর্ষায় যেতে চাইলে অবশ্যই লম্বা এবং শক্ত রশি নিয়ে যাবেন।
পরের পোস্টটি দেব জাদিপাই ঝরনা নিয়ে, সেইটা আরেক জিনিস রে ভাই।
বান্দরবান ট্রাজেডিতে নিহত তাশদীদ রেজোয়ান মুগ্ধ আর তরিকুল আলম সুজনের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানিয়ে লেখা শেষ করছি।আসলে আমরা যারা ভ্রমন পাগল, তারা সবাইই একটা পরিবার। সুজন ভাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও মুগ্ধ ভাইয়ের সাথে প্রায়ই অনেক গল্প হতো। এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে মানুষগুলো বেচে নাই। মহান আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে নসিব করুন এই দোয়াই করি।