রাফি সাহেবের পড়ে যাওয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। সকালের মিষ্টি রোদ গাজীপুরের এই ছোট্ট গ্রামে যখন পড়ছে, তখনই কাজের লোক রহিমা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ির নিচে রাফি সাহেব পড়ে আছেন, হাতে রিয়াদের সেই প্লাস্টিকের ঘোড়াটা শক্ত করে ধরা। রহিমা চিৎকার করে উঠল, “ও বুড়ো মানুষ, এ কী হইল!” পড়শিরা ছুটে এল। কেউ কেউ ফোন করল রাসেলকে, কেউ গ্রামের ডাক্তার হারুন সাহেবকে খবর দিল।
রাসেল ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে ছুটে এল। সকাল দশটার মধ্যে সে গ্রামে পৌঁছে গেল। বাড়ির সামনে ভিড়। রাফি সাহেবকে ততক্ষণে সিঁড়ি থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। হারুন সাহেব এসে দেখলেন, “স্ট্রোক হইছে মনে হয়। তবে বড় কিছু না। হাত-পা না নড়লে বুঝতাম বড় ক্ষতি। এখনও শ্বাস চলতেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।” রাসেলের বুকটা ধক করে উঠল। বাবাকে এভাবে দেখে তার চোখে জল এল। সে রিয়াদের ঘোড়াটা হাতে নিয়ে দেখল। মনে হলো, এটা কি সত্যিই খেলনা, না অন্য কিছু? কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নয়।
গ্রামের কয়েকজন যুবক মিলে রাফি সাহেবকে গাড়িতে তুলল। রাসেল গাড়ি চালিয়ে গাজীপুর শহরের কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল। পথে তার মনে পড়ল তানিয়ার কথা। মা যখন মারা গেলেন, তখন বাবা কত শক্ত ছিলেন। ছেলেমেয়েদের জন্য নিজের দুঃখ লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখন বাবার এই অবস্থা দেখে তার মনে হলো, সে কি বাবাকে যথেষ্ট সময় দিতে পেরেছে? ঢাকায় ব্যস্ত জীবন, চাকরি, সংসার—সবকিছুর মাঝে বাবাকে একা ফেলে এসেছে।
হাসপাতালে পৌঁছে রাফি সাহেবকে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলো। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলল, “মাইল্ড স্ট্রোক। তবে বয়সের কারণে শরীর দুর্বল। কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।” রাসেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। সে রুমাকে ফোন করল। “দিদি, বাবার অবস্থা ভালো না। তুই একবার আয়।” রুমা বরিশালে থাকে। শুনে সে বলল, “আমি আজই রওনা দিচ্ছি। রিয়াদের মা’কে খবর দে।” রাসেল রিয়াদের মা, তার বউ সানজিদাকে ফোন করল। সানজিদা বলল, “আমি রিয়াদকে নিয়ে আসছি। তুই বাবার পাশে থাক।”
বিকেলের দিকে রুমা এসে পড়ল। রাফি সাহেব তখনও অচেতন। রুমা বাবার হাত ধরে কাঁদতে লাগল। “বাবা, তুমি আমাদের ছাড়া থাকতে পারো না। আমরা কেন তোমাকে একা ফেলে চলে গেলাম?” রাসেল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাবা তাদের কত আদর করতেন। গ্রামের মাঠে হাত ধরে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। বর্ষায় পড়তে বসিয়ে গল্প শোনাতেন। তানিয়া মা রান্নাঘরে পড়ে থাকতেন—ভাত, ইলিশ মাছের ভর্তা, আর শুটকির চচ্চড়ি। সেই দিনগুলো এখন স্বপ্ন মনে হয়।
সন্ধ্যায় সানজিদা আর রিয়াদ এল। রিয়াদ দাদুকে দেখে ছুটে গেল। “দাদু, তুমি উঠো না! আমি তোমার সঙ্গে খেলব।” রাফি সাহেবের চোখে সামান্য নড়াচড়া হলো। রিয়াদের গলা শুনে যেন তিনি ফিরে আসতে চাইছেন। রাসেলের মনে হলো, বাবার জন্য রিয়াদই এখন সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ডাক্তার এসে বলল, “রোগীর অবস্থা এখন স্থিতিশীল। কাল সকালে হয়তো জ্ঞান ফিরবে।”
রাতে হাসপাতালের করিডরে রাসেল, রুমা আর সানজিদা বসে রইল। রিয়াদ মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রাসেল বলল, “দিদি, আমরা বাবাকে আর একা রাখতে পারি না।” রুমা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। বরিশালে আমার সংসার ঠিক আছে। আমি বাবার কাছে থাকতে পারি।” সানজিদা বলল, “আমরাও মাঝে মাঝে আসব। রিয়াদের জন্যও দাদু দরকার।” রাসেল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি ঢাকায় ফ্ল্যাটটা বেচে গ্রামে ফিরে আসব। বাবার সঙ্গে থাকব।”
পরদিন সকালে রাফি সাহেবের জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলে তিনি দেখলেন, রুমা, রাসেল আর রিয়াদ পাশে বসে আছে। দুর্বল গলায় বললেন, “তোরা এসেছিস?” রিয়াদ ছুটে গিয়ে দাদুর হাত ধরল। “দাদু, আমি তোমার কাছে থাকব। আর যাব না।” রাফি সাহেবের মুখে একটা হাসি ফুটল। তিনি রিয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। “আমার ছোট আমি, তুই থাকলে আমি বাঁচব।”
কয়েকদিন পর রাফি সাহেবকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি আর আগের মতো একা নন। রুমা গ্রামে ফিরে এসেছে। রাসেল ঢাকার চাকরি ছেড়ে গ্রামে একটা ছোট ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। সানজিদা আর রিয়াদ প্রতি সপ্তাহে আসে। বাড়িটা আবার জমজমাট হয়ে উঠেছে। রাফি সাহেবের শেষ রাতের সেই সুর আর শোনা যায় না। তিনি মনে করেন, হয়তো সেই গান তাঁকে সতর্ক করেছিল—একাকিত্বে নয়, পরিবারের মাঝে ফিরে আসার জন্য।
একদিন সকালে রাফি সাহেব জানালার পাশে বসে রিয়াদের সঙ্গে খেলছিলেন। রিয়াদ হঠাৎ বলল, “দাদু, তুমি যে রাতে পড়ে গিয়েছিলে, আমি স্বপ্নে দেখলাম তুমি আমাকে ডাকছ।” রাফি সাহেব চমকে উঠলেন। “তুই শুনেছিলি?” রিয়াদ হেসে বলল, “হ্যাঁ, তুমি বলছিলে—‘আমার ছোট আমি, আমাকে বাঁচা।’” রাফি সাহেবের চোখ ভিজে গেল। তিনি বুঝলেন, সেই শেষ রাতের সুর কোনো বিভ্রম ছিল না। সেটা ছিল তাঁর নিজের মনের ডাক—পরিবারের কাছে ফিরে আসার আহ্বান।
বাড়ির উঠোনে রুমা রান্না করছে—পড়শি এসেছে, তাই পোলাও আর মুরগির রোস্ট হচ্ছে। রাসেল গ্রামের বাজার থেকে ফিরল। সানজিদা রিয়াদকে পড়তে বসিয়েছে। রাফি সাহেব জানালায় বসে এই দৃশ্য দেখছেন। তাঁর মনে হলো, জীবন আবার পূর্ণতা পেয়েছে। সেই অন্ধকার থেকে অন্ধকারের যাত্রা আর নেই। এখন আছে আলো, হাসি, আর পরিবারের উষ্ণতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৫:১৪