রাত ১২.৪০ মিনিটে বারান্দার দরজা খোলা রেখে আমি শুয়ে পড়লাম । এতক্ষন ছোট্ট একটি শক্তিশালী রেডিওতে বারান্দায় দাড়িয়ে নিরব রাস্তা আর থিয়ান আন মেন স্কয়ার যেদিক সেদিকে নজর দিয়ে উত্তেজিত হয়ে একটা প্রচণ্ড গর্জনের আওয়াজের জন্য কান পেতে দাড়িয়ে আছি । কটা সিগারেট শেষ করেছি জানিনে । খাটে স্ত্রী ঘুমিয়ে পাশে ছোট্ট বেডে ৮ মাসের কন্যা ঘুমিয়ে । স্ত্রী ঘুমিয়ে যাবার আগে জিজ্ঞাসা করছিলেন কিছু হয়েছে কিনা। গরমের দিন । ১৪ তালায় একটু হাল্কা হাওয়া আছে ।
বিকালে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে ফ্রেন্ডশিপ স্টোরে নামলাম । ঠাং আন স্ট্রিট (chang an street) লোকে লোকারণ্য । একটু সন্দেহ জাগল মনে,এত লোকতো হয়না তাও পাবলিক সিসটেম বন্ধ করে!!! ফুটপাত ধরে এগুলাম জিয়াঙগুওমেন ওভারপাসের দিকে, প্রামে মেয়ে শোয়া । হাউজিং কমপ্লেক্স পর্যন্ত এসে আমি স্ত্রীকে বললাম তুমি এখানে দাড়াও , দেখছতো পুরো ফুটপাতই জনতার দখলে ।বললাম তাকে আমি দেখে এসেই পাশের কূটনীতিক ভবনে কারো বাসায় আডডা দেব । আমরা মুলত স্কয়ার যাওয়ার পরিকল্পনায় এসেছিলাম কিন্তু আমার নাকে তখন বারুদের গন্ধ ।লোকের ফাকে ফাকে জায়গা করে এগুচ্ছি । রাস্তাটি ৩০০ ফুট চওড়া, গেঞ্জি হাফপ্যান্ট পরা লোকেরা হাতপাখা দোলাচ্ছে বসে। ওভারপাসের ওপর এসে দেখি ভিড়ের মধ্যে একজন সৈনিক উচুতে কিসের ওপর বসা যেন । আরেব্বাবা এযে ট্যাঙ্ক ! লোকেরা ট্যাঙ্ককে ঘিরে দাড়িয়ে । উত্তর দিক থেকে উঠে আসা রাস্তাটা শুধুই ট্যাঙ্কের সারি , আর তার পিছনে আর্মি ট্রাক । আর্মিরা নেমে ফুটপাতে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছে , আশপাশ দিয়ে লোকে লোকারণ্য । এবার নজর দিলাম স্কয়ারের দিকে কারন আমি উচুতে দাড়িয়ে । নাহ সাম্নের ৩ কিলোমিটার কোথাও ফাকা নেই । আর্মিরা বেশ রিলাক্সে আছে কিন্তু আমার হিসেবের যন্ত্রটি কাজ করছে দ্রুতগতিতে । আবার ফিরলাম স্ত্রীর কাছে । আমায় জিজ্ঞাসা করল আমরা কি যেতে পারব । আমি প্রাম ধরে ঠেলতে ঠেলতে বললাম যত দ্রুত পারি চল বাসায় যাই, ট্যাঙ্ক , সাঁজোয়া ইউনিট এসেছে ,জনতার প্রতিরোধে দাড়িয়ে আছে । যেকোনো মুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হবে । স্ত্রীও আমার মত ভয় পেয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফ্রেন্ডশিপ ষ্টোরের পাশে এসে দেখি কোন যানবাহন নেই। পাশের রাস্তায় দাঁড়ালাম । একটা ট্যাক্সি এল তাকে প্রায় জোর করে নিয়ে বাসায় ফিরলাম । শুধু আমি জানি কি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে । ঠাং আন এভিনিউর লক্ষ জনতার অনেকেই জানেনা পিপলস লিবারেশন আর্মি পৌঁছে গেছে । এরা কখন আসে ? জাতীয় সংহতি যখন হুমকির সন্মুখীন ঠিক তখন । চীনে পুলিশই যথেষ্ট সবকিছু নিয়ন্ত্রণে কিন্তু আজ আমি বেসামাল হয়ে গেলাম পি এল এ দেখে। স্কয়ারের অবস্থান আমরা মে মাস থেকেই দেখছি, কূটনীতিকদের কথা শুনি আর শুনি আমাদের ২০ জন চীনা সহকর্মীদের কথা । চীনা রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর আমরা জানি।
ভোর ৪ টা , মেয়ে উঠেছে খাবার খেতে । স্ত্রী আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল শোন গুলির আওয়াজ । ধড়মড় করে উঠেই বারান্দা । হ্যাঁ, গুলি চলছে থেমে থেমে । চোখ গেল স্কয়ারের যেখান থেকে সোনালি আলোর নিশানা ওঠে সেদিকে , নাহ ওখানে অন্ধকার । আমি টের পাচ্ছি ঠিক কোথায় গুলি হচ্ছে । বা দিক থেকে ডানে সব পয়েন্টে । মেশিনগানের গুলি , অটোম্যাটিক রাইফেলের গুলি । রেডিও খুললাম । প্রায় সব রেডিও বলছে রাত ১.১৫ মিনিটে আক্রমনের সুচনা । কি বোকা আমি পৌনে একটায় ঘুমিয়ে পড়েছি । কে জানত আমি ঘুমালেই ওরা গুলি চালাবে ?
কার সাথে এই উত্তেজনা ভাগাভাগি করা যায় ? জিএম সাহেবের পিএস ৮ তালায়, এখন হয়ত ঘুমিয়ে। চা চড়িয়ে দিলাম কিচেনে । রেডিওটা বাহাতেই ঘুরছে । ভোর ছটায় পায়ে হেটে ৮ তালায় নামলাম , বেল বাজালাম রিয়াসাতের । ও প্রায় ঘুম ঢল ঢল চোখে চিৎকার করে উঠল “সাচ হায়? মার দিয়া দুশমনকো”? বললাম চলে আসো চা খাব একসাথে । এবার লিফটে উঠে এলাম ।উত্তেজনায় ঘুম নেই । সব চুপ হয়ে গেছে । আমাদের নতুন ভবনে এখনো কেবল লাইন লাগেনি । সব দুতাবাসে নিজেদের আয়োজনে ডিশ এন্টেনা লাগানো আর আছে পাচতারা হোটেলগুলোতে। আমাদের দুজন ম্যানেজার খুনলুন(Kunlun) হোটেলে থাকেন এবং ওরা সি এন এন লাইভ দেখেন । আমিও কদিন গেছি দেখতে , না জানি এখন কি দেখাচ্ছে ।
আজ রবিবার, ছুটিরদিন। কায়দা করে ছুটিরদিনেই দমন করল । দশটা নাগাদ নিচে পার্কিংএ নামলাম । কজন কূটনীতিক আলাপ করছেন, যোগ দিলাম ওদের সাথে । সবাই মর্মান্তিক খবর দিচ্ছে , মৃতদেহের হিসাব দিচ্ছে , দেশটি কার হাতে , কে পরিচালনা করছে ইত্যাদি । সবথেকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা । রক্ষা নেই বিদেশিদের, লুটে পেটে মেরে ছাই করে দেবে , হ্যাঁ তখন হয়ত বিদেশি হস্তক্ষেপ হবে তাও বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রের জনগনের পক্ষে । সকালেই আরেক অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় ৪০ জন সাইকেল আরোহী ও পথচারী নিহত হলেন বেইজিং হোটেল এর সামনে । বেইজিং হোটেল স্কয়ার নিকটবর্তী হওয়ায় সব বিদেশি মিডিয়া ওখানেই আশ্রয় ছিল এবং আছে। বিবিসির সংবাদদাতা জানালার পাশে বসেই লাইভ দিচ্ছিলেন রেডিওতে, আমিও শুনছি, হটাৎ ক্যাট ক্যাট শব্দ এবং ভাষ্যকার নিসচুপ , কিছু পতনের শব্দ ও আবার শুরু “ এইমাত্র টহল সেনারা কৌতুহলী পথচারিদের উপর গুলি চালিয়েছে, আমি মাটিতে পড়ে ওভাবেই শুয়ে আছি , হ্যাঁ দেখা যাচ্ছে, জনা চল্লিশেক লোক পড়ে আছে রাস্তায়, এরা বোধকরি অনুধাবন করতে পারেনি এই ভোরে কি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে থিয়ান আন মেন স্কয়ারে “।
হোটেলে গেলাম বাইক মেরে এবং সি এন এন এর রেকর্ড কৃত ক্যাসেট এনে ভিসিআর এ চালিয়ে দেখলাম। দিনে দুদফা গেলে মোটামুটি কভার করা যাবে আর টেলিফোনে তো যোগাযোগ থাকছেই ।
দুপুরে খুব লম্বা ঘুম দিলাম ।
বিকালে আবারো নিচে , ছোট ছোট অনেক জটলা । একজন রুক্ষ মহিলা রিয়াসাতের সাথে কিছু বলছিল, ভিড়ে গেলাম ওখানে । এই মহিলা আমাদের ৩ তালায় থাকে জার্মান টি ভির ক্রু । সে দিল আরও লাইভ বর্ণনা। ওরা জীপ নিয়ে ক্যামেরা চালিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত , যখন মাথায় রাইফেল ধরে বলল ক্যামেরা নামাও ঠিক তখনি ওরা ক্যামেরা ত্রিপড থেকে চালু অবস্থায় নামিয়ে জীপ চালিয়ে দিল । যারা ওদের কাছে এসেছিল তারা ওই মহিলার ভাষায় বর্বর ও অমানুষ।তো জীপ চালিয়ে প্রথমে মহিলা ও আরও ক্রু ,ক্যামেরা ম্যানদের এই বাসায় নামিয়ে একজন চলে গেল সোজা এয়ারপোর্টে । তার টিকিট সবসময় থাকে । সে সবগুলো ক্যাসেট নিয়ে ভোরের লুফথানসা বিমানে জার্মান চলে গেল । দুপুর ১ টায় জার্মান টি ভি পৃথিবীর প্রথম যারা সদ্য তোলা স্কয়ারের ছবি পৃথিবীকে দেখাল । মহিলার মুখে তৃপ্তির হাসি, সে আমায় সিগারেট খাওয়াল।
সন্ধ্যার সি সি টি ভির অপেক্ষায় বসে রইলাম। শুরু হল খবর । কি আশ্চর্য ! খবর পাঠিকার কোন মেকাপ নেই , কাল পোশাক ও কাল ব্যাজ , কাদছে সে । বিপ্লব দমনের মর্মান্তিক খবর পড়ল সে কেদে কেদে। তাহলে টি ভি রেডিও এসব এখনো সেনা নিয়ন্ত্রণে আসেনি? সে ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম পলকহীন চোখে, রেকর্ড করলাম । আরও অনেক অজানা দৃশ্য দেখতে পেলাম সরকারী নিয়ন্ত্রনহীন মিডিয়ায়
এভাবে মানুষের তাবৎ ইচ্ছা অবদমিত করে একটি অপরিকল্পিত বিপ্লবের অবসান হল ।
সৈনিকদের পোড়া মৃতদেহর ৩ টি ছবি
সব ছবি ওয়েব থেকে সংগৃহীত ।।