নৌকা ভ্রমন আমার মতে সবচেয়ে উপভোগ্য ভ্রমন । আর সেই ভ্রমনের সুযোগটি এলো ক্যাবলকার ট্যুরের পরই। আসলে ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট নামটা আমাকে সুন্দরবন মনে করিয়ে দেয়। যেটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট। লংকাউই এর ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট ট্যুরে আকর্ষনীয় ব্যাপারগুলোর অন্যতম হলো সেখানে ঈগল ফিডিং করার ব্যবস্থা আছে। আর আছে ফিস ফার্ম , ব্যাট কেভ, ক্রুকুডাইল কেভ, আর আন্দামন সাগরে নৌকায় ঘুরার মত চমৎকার কিছু ব্যাপার। সেখানে আছে জুতা দ্বীপ, কিলিম জিওফরেস্ট পার্ক ইত্যাদি।আমার কাছে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে ঈগল পয়েন্ট আর ক্রুকুডাইল কেভ । তবে ভ্রমনের সময় ভাললাগাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
প্রথমে সংখ্যানুপাতে দুটি নৌকা ভাড়া করা হলো। স্টেশনটাই চমৎকার। দারুন রঙিন কিছু নৌকা ভেড়ানো ছিল ঘাটে। আমরা পৌঁছামাত্র আমাদের জন্য নির্ধারতি নৌকা চলে এলো। আমরা সংখ্যায় দু'জন কম হলে একটা নৌকায় হয়ে যেত। কলিগ, কলিগদের স্ত্রী আর সন্তানসহ মোট আমরা বারোজন এই ভ্রমনের সহযাত্রী। দু'নৌকায় ভাগ হয়ে যাওয়াতে ভালই হলো। নৌকার ভেতর ইচ্ছে মত খোলামেলা জায়গা পাওয়া গেল ।
যথা সময়ে নৌকা ছেড়ে দিল। আমরা চারজন রোযাদার। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে । হাতে মাত্র দুই ঘন্টা সময়। আমাদের নৌকা চলতে থাকলো । নৌকার দুই তীরে অপরুপ সবুজের ছড়াছড়ি। পরিস্কার স্বচ্ছ পানিতে আমাদের যন্ত্রচালিত নৌকা ঢেউ তুলে এগিয়ে যাচ্ছিল। নদীর তীরে বানর বানরামীতে ব্যস্ত । ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট সীমা নির্ধারন করে দিয়েছে উঁচু পাহাড় গুলো ।দেখে সেগুলোকে কোরাল পাহাড় মনে হলো । সেগুলোর সাদা রং আর ফসিলে ব্যাপক উপস্থিতি তেমনটাই বলছিলো। যাই আমারা নদীর বুকে ঢেউ তুলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । আর বিমুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির লীলা উপভোগ করছিলাম। স্নিগ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ্ব জল আর অপরূপ প্রকৃতি মনটা সতেজ করে দিয়েছে অনেক খানি। নদীর তীর ঘেষে বেশ কিছু ভাসমান ঘর দেখা যাচ্ছিল । জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ওগুলো ফিস ফারম সহজ বাংলায় বলতে গেলে মৎস খামার । আমাদের ভ্রমনের অংশ হিসেবে ফিস ফিডিং এর প্রয়োজনীয় খাবার গুলো সংগ্রহ করে ট্যুরিস্ট এজেন্ট।
একটি ভাসমান ঘরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে নানা প্রজাতির মাছ জাল দিয়ে ঘিরে রেখে তারমধ্যে ছেড়ে দেয়া আছে ।একজন দশ বারোবছরের বালক আমাদের তাদের খামারের মাছগুলো দেখাচ্ছিল । পানিতে খাবার দেয়া মাত্র ক্ষিপ্র গতিতে মাছগুলি খাবার খাচ্ছিল। বেশ বড় আকৃতির একেকট মাছ। এক খোপে ছিল শার্ক । খাবার দেয়ামাত্র দৌঁড়ে এসে খাবার খেয়ে ফেলছিল ; প্রকান্ড আকারের মাছ। আর সেগুলোর আতঙ্ক জাগানিয়া বর্ননা হচ্ছিল । যেমন শার্ককে বলছে এটি খুব ভয়ানক মাছ যদি কেউ পানিতে আঙুল দাও সে আঙুল খেয়ে ফেলবে। এবং আমাদের এও বলা হলো তোমার আঙুল দিতে পারো তবে নিজ দায়িত্বে । আঙুল খেয়ে ফেললে তারা এর জন্য দায়ী নয়। পরের খোপে যেয়েও সেই একই রকম বিবরণী । শুধু মাত্রা বাড়ছিল এই আরকি। পরেরটিতে যে মাছ সেটি আরও বড়। সেটি পুরু হাতই খেয়ে ফেলবে। মাছের সাইজ দেখে অবিশ্বাসের কিছু নেই। খেলে খেয়েও ফেলতে পারে বলে মনে হলো। তাছাড়া কেবল কারের শুরুতে যে শো দেখেছি তাতে মাছের ক্ষমতা কত তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। সবার দারুন অভিজ্ঞতা হলো। সেখানে অবশ্য যেটি ইচ্ছা সেটি খাও মার্কা অফার ও ছিল।যে মাছটি পছন্দ হবে সেটি বলা মাত্র ধরে রান্না করে খাইয়ে দেয়া হবে তবে তার জন্য রিংগিত গুনতে হবে।
আমরা মানুষ সবচেয়ে বড় খাদক আর আমাদের কাছে সবকিছু অসহায় যত রাক্ষুসী আর হিংস্রমাছ হোকনা কেন? সেটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। আমার কোর আনের আয়াত মনে এলো যার অর্থ মনে হলো। সকল কিছু মানুষের সেবার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আমরাও কয়েকজন প্রস্তুত ছিলাম সেগুলো খেয়ে তা প্রমান করার জন্য । সেরকম কিছু হয়নি। আর মাছ খাওয়াও হয়নি ।তবে মাছ গুলো দেখে দারুন ভাল লেগেছে। মেগা সাইজের চিংড়ি মাছ দেখে লোভ হয়েছিল দারুন। তবে কেউ মাছ খায়নি।
ফিস ফিডিং পর্ব তৃপ্তিসহকারে শেষ করে আমরা চললাম ক্রোকোডাইল কেভ এর দিকে । নৌকা ছুটে চলল । আমরা পানি হাত দিয়ে নেড়ে পুলকিত মনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । আমার মনটা ছিল ঈগল পয়েন্টে । চলতে চলতে এক পর্যায়ে পৌছে গেলাম কাঙ্খিত ক্রোকোডাইল কেভ। সেখানে কোন কুমির ছিলনা। তবে সেই কেভটি দেখলে যে কেউ অনুমান করবে যে এটা হয়তো প্রাগৈতিহাসিক সময়কার কোন বিশাল আকৃতির কুমিরের গুহা। আমাদের দুটো নৌকা সেই গুহায় ঢুকে গেল । গুহার দেয়ালগুলো খেয়াল করলাম।চমৎকার ! মনে হবে কেউ এঁকে রেখেছে। তাতে চুনা পাথরের প্রলেপ। আর নিচের অংশে স্পষ্ট শামুক ঝিনুকের ফসিল সম্বলিত বেডিং।এগুলো দেখে কুরাল আইল্যান্ড আর কুকুনা বেড এর কথা মনে পড়ে গেল। ফসিল বা জীবশ্মগুলি অধ্যায়ণ করলে সহজেই এর বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব। যাই হোক একজন পর্যটকের চোখ কিছুক্ষনের জন্য হলে ভূবিজ্ঞানীর চোখে পরিণত হওয়ার সুযোগ এনে দেয় এই ক্রুকুডাইল কেভ। সেখান থেকে সোজা চলতে লাগলাম ঈগল পয়েন্টে।
অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা গেলো বহুকাঙ্খিত সেই ঈগল পয়েন্ট। অনেকগুলি ঈগল পাখা মেলে বৃত্তাকারে উড়ছে। আর নদীর স্বচ্ছ পানি থেকে ছুঁ মেরে মাছ শিকার করছে। সত্যি এবার আভিভূত হলাম । আমরা একেবারে ঈগল পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছলাম । বুট ম্যান মাছ ছুড়ে দিলেন নদীর স্বচ্ছপানিতে আর অমনি ঈগল ছুঁ মেরে মাছ তুলে নিল। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর ছুটে চললাম আন্দামান সাগরের জুতা দ্বীপে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় আমাদের সেই ছুটে চলা । পাশেই কিলিম জিওফরেস্ট পার্ক । আর আর একটু সামনে আন্দামান সাগরে কিছুদূর গিয়েই জুতা দ্বীপ। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। ওটার নাম কেন জুতা দ্বীপ ওর ছবিই সেটি বলে দিবে।
ফিস ফার্ম , ক্রকুডাইল পয়েন্ট, ঈগল পয়েন্ট পেরিয়ে জুতা আইল্যান্ডে আমাদের ভ্রমন শেষ হলো। এবার ঘরে ফেরার পালা। নদীপথে আমরা এগুতে থাকি। নদীর বাঁকে কোথাও একপাশে চর পড়েছে। যে পার্শ্বে চর পরে সে পাশটা নদীর পলিসঞ্চয় এলাকা স্বভাবতই সেখানটা অগভীড় আর বিপরীত পাশটা ক্ষয় এলাকা হওয়াতে সেটা হয়ে থাকে গভীড়। নদীর দুই তীর ঘেষে অপরূপ সব রূপ সুধা লেহন করতে করতে আমরা ঘাটের দিকে ফিরতে থাকি।
একসময় ভ্রমন শেষ হয়ে যায়। কলিগ তনয়া ইশ্বরার লাইফ জেকেট পছন্দ করেছে ও সেটা খুলবে না । অনেক অনুনয় বিনয় করেও কাজ হচ্ছিল না। বাবার অনেক খানি প্রলোভন আর মায়ের অনেকখানি চোখ রাঙানিতে অবশেষে আমরা সফল হলাম। লাইফ জ্যাকেট জমা দিয়ে দ্রুত ঘাট থেকে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ইফতারের সময় আসন্ন। ইফতারের প্রস্তুতি নিতে আমাদের গাড়িতে চেপে বসলাম । এটি ছিল জুলাইয়ের ২৬ তারিখ। এর মধ্যে দিয়েই দারুন আনন্দের এক নৌকা ভ্রমনের সমাপ্তি হল ।
ছবি নিজস্ব এলবাম। সহকারী পরিচালক নুরুজ্জামান সবুজ ও অনিমেষ তালুকদার কে ফটোক্রেডিট দেয়া হলো।তাদের কাছ থেকেও ছবি নেয়া হয়েছে ।
ফিস ফারম