বর্তমানে বাংলাদেশে ধার্মিক মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে । আমি নিজে বাক্তিগতভাবে দেখেছি প্রতি ১০ জনের মাঝে অন্তত ৮ জন নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়ে। ছাত্রদের মাঝে এই হার আরও বেশি। ভাল ছাত্র হলে ত কথাই নেই। কিন্তু আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি যে আমার জানা “ধার্মিক” শব্দের অর্থের সাথে এই ধার্মিক শ্রেণীর বড়ই অমিল। শুধু অমিল নয়,তারা পরস্পরবিরোধী ।
আমার এক বন্ধু- ভীষণ স্টাইলিশ । ফেসবুকে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সপ্তাহে ২-৩ বার এডিট করা ছবি আপলোড করে।চুলে জেল না দিয়ে ঘর থেকে বের হয় না। ২ দিন পর পর ফেসবুকের নতুন নতুন মেয়ে “friend” এর সাথে রিকশা , KFC তে ঘোরাঘুরি করাটা তার কাছে স্মার্টনেসের প্রতীক। প্রতিটা পর্ণ সাইট এর নিয়মিত আপডেট তার নখদর্পণে । আমার সেই বন্ধুর ফেসবুক এর “people who inspire you” তে সবার আগে আছে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এ নাম। সে দৈনিক ৩ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ইহুদি- খ্রিষ্টানদেরকে উঠতে বসতে গালি দেয় (তার মতে যে কোন ইহুদী ও খ্রিষ্টানই খারাপ। ইহুদী হয়ে জন্মানো মানুষের খারাপ হওয়া বাধ্য। কিন্তু তার জীবনের লক্ষ্য ও আমেরিকা তে সেটেল হওয়া।)
এখন আসি আমার আরেক বন্ধুর কাছে।মেয়ে । নব্য আধুনিকতার উজ্জল আলোতে যার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। চাপা জিন্স না পরলে তার শান্তি হয় না। বডি ফিটিং ফতুয়া , টিশার্ট ছাড়া অন্য কিছুতে একদম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আমার এই বন্ধুও খুব “ধার্মিক”। ছেলে বন্ধুটার চেয়ে বাসায় বেশি থাকা হয় জন্য এর নামাজের ওয়াক্ত ৪ ।
তবে হ্যাঁ, সবাই এরকম না। আমার এক কাজিন আছে-বোরকা ছাড়া বেরই হয় না। চাপা , পাতলা বোরকার নিচে টাইট জিন্স। উফফফ।। যা সেক্সি লাগে না......(এই ড্রেসে সে কোথায় কোথায় যায়-তা না হয় না-ই বললাম )
এতক্ষণ আমি যাদের কথা বললাম,তারা আসলে একজন না,বহুজনের প্রতিভূ । একজন মানুষের সত্যিকার মুক্তির জন্য জেটা দরকার-সেই জ্ঞান, শিক্ষা তাদের নাই(বা বিকৃত ভাবে আছে)। ভাল স্কুল-কলেজ এ পড়ে ভাল রেজাল্ট করেছে ,কিন্তু পড়া শুধু কপি-ই হয়েছে ব্রেন এ। ইন্সটল হয়নি। আর তার অভিশাপটা পড়েছে দেশের ওপর। আর এ কারনেই তথাকথিত এই ধার্মিক বাড়ার সাথে সাথে দেশে নোংরামি বাড়ছে। যা হবার কথা ছিল না। তারা তাদের বিকৃত যৌন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পর্ণ দেখা, ফোন-সেক্স –এসবে তাদের কোন সমস্যা নেই।।কারন ধর্মে তা নিষেধ করা হয়নি (!!!!) । নিজের শরীর দেখিয়ে অন্যকে আকৃষ্ট করাটা হয়ে গেছে আধুনিকতা, “নারীমুক্তি”। ধর্মের কথা বাদ ই দিলাম,কিন্তু একবার ও মনে হয় না তাদের যে তাদের মাঝে মানবিক গুনের এতই অভাব যে শেষ পর্যন্ত শরীর দিয়ে “আধুনিক” হতে হচ্ছে ? এর চে বড় অপমান আর কি হতে পারে? আধুনিক হবার জন্য দরকার আধুনিক চিন্তার,কাজের ।বর্তমানে কয়জন মেয়ে তা করছে??১৯৭১ এ ইডেন কলেজের মেয়েরা পুলিশের সাথে বিরোধে জড়িয়ে গিয়েছিলো,ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে পুলিশ জাবার সময়ে তাদের মাথায় ইট মেরেছিল,শহীদ মিনার তো তাদের ই বানানো।আর এখন?অবসর সময়ে কয়জন বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে বসুন্ধরায় যায় আর কয়জন নীলক্ষেত এ যায়?? যারা নীলক্ষেত এ যায়,তারাও একাডেমিক বই কিনতে যায়,বাকিরা যায় হুমায়ূন এর বই কিন্তে...বই পড়া মানেই হয়ে গেছে গল্পের বই পড়া । জাফর ইকবাল স্যার এর গল্প-উপন্যাস সব পড়া হয়ে যায়।“একটুখানি বিজ্ঞান” পড়া হয় না...”থিউরি অফ রিলেটিভিটি” এর নাম ও শোনা হয় না।। সায়েন্স এর স্টুডেন্ট-অথচ ইউনিভার্সিটি তে EEE তে ভর্তি হবার পর সে দেখে transistor. তাহলে কি বুঝে EEE নিলো? কারন এটার “ডিমান্ড আছে”। চাকরি দরকার।।সুন্দরী বউ দরকার,গাড়ী দরকার-তাই পড়াশুনাটা দরকার...তাই বুয়েট এ ভর্তির জন্য এত ঝামেলা।। ভর্তির পর ওমেকা ,সানরাইস,বাসায় গিয়ে টাকা কামানো । পড়াশুনা যাও হয়,জিপিএর জন্য। লাভ এর দিক দিয়ে যা হল- বাংলাদেশ এ গবেষণার কোন খাত নেই।। কেউ করতেও চায় না-দরকার কি? এত এত ঝামেলা করার? কষ্ট করার? তার চে MBA করে বেশি বেতনের জব পাওয়া যায়...।
এতক্ষণ হয়ত আমার কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল । কিন্তু না-উপরে যেসব পুরান কাসুন্দি ঢাল্লাম, তার কারন ও এই তথাকথিত আধুনিক ধার্মিক মানুষেরা(আরও এক দল আছে-যাদেরকে আমরা বখাটে বলি।ওরা নষ্ট হলে নিজেরাই হয়,পরিষ্কার ভাবে নষ্ট হয়-পানি ঘোলা করে না)- যাদের এই জীবনে আর সৃজনশীলতাকে,মহৎ কাজকর্মকে(যেগুলোতে আপন স্বার্থ নাই) আসল মনে হয় না...মনে হয় টাকা আর “শান্তির জীবনকে” । ইহকাল এর তো গুরুত্ত নাই...পার হয়ে গেলেই হয়... পরকালের জন্য কাজ করতে হবে,তাই এই দুনিয়ায় অত মহৎ টাইপ জিনিস না করলেও চলবে। কিন্তু ওই যে তারা “আধুনিক”,তাই তারা তাকা-পয়সা-ভোগ বিলাস দিয়ে পার করে দিতে চায় এই জীবন। পাশ্চাত্য আর কিছু না পারলেও ভোগ বিলাসীতা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে এদের মাঝে।আর এ জন্যই ছোটবেলায় গাড়ী বানানোর স্বপ্ন দেখা ছেলে মেকানিক্যাল এ পড়ে না।। IPE তে পড়ে । মেকানিক্যাল এ পড়া কষ্ট । ডিমান্ড ও নাই দেশে। “risky subject”...তার বিকৃত ধর্ম তার স্বপ্ন নাই করে দিয়েছে ...।
আমি কিন্তু “বিকৃত ধর্মের” কথা বলেছি-ধর্মের না...সত্তিকার এর ধর্ম একজন মানুষকে কিরকম বানায় তা দেখতে চাইলে নটরডেম কলেজের শ্রদ্ধেয় স্যার মিজানুর রহমান এর সাথে পরিচিত হতে পাড়েন। দাড়ি-টুপি পড়া যে মানুষটার শখ হল বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করা। সারাদিন জ্ঞান এর কথা বলেন। এবং এই জ্ঞান টাকা কামানোর জন্য না-মহত্তের জন্য। সমাজের অসঙ্গতি যার সহ্য হয় না...সারাদিন মানুষ হবার কথা বলেন এবং ৯০% ছাত্রের বিরক্তির পাত্র হন।হবেন নাই বা কেন? তিনি তো আর “ক্যারিয়ার-ওরিয়েন্টেড” কথা বলেন না যে তা ভাল লাগবে। যেখানে কলেজের অন্য একজন নামকরা শিক্ষক বলেন-“তোমরা নটরডেম এর ছাত্র, প্রাডো গাড়ী কেনার ড্রিম থাকতেই পারে”, সেখানে মিজান স্যার বলেছিলেন- “টাকার চিন্তা থাকলে সায়েন্স এ আসছ ক্যান?? science is the subject of saint...”
উল্লেখ্য ২ জন স্যার ই অনেক ধার্মিক ।
যাক, আগের কোথায় ফিরে যাই-১ টা ধর্ম মোটেও নামাজ পড়া না বা তার যুক্তি খোঁজা না। শুধু ঈশ্বরকে খুশি করা বা নিজের শাস্তির ভয় না। এটা একটা লাইফস্টাইল। যে লাইফস্টাইল সমাজকে,মানুষকে ভাল রাখবে। এটা “সমাজব্যাবস্থা”- “নামাজব্যাবস্থা” না। সুতরাং আমরা যদি লাইফ স্টাইল টা বাদ দিয়ে আল্লাহ্কে খুশি করার চেষ্টা করি- সেটা কি ধার্মিকতা?
তাহলে কেন এই তথাকথিত ধার্মিকে দেশ ভরে যাচ্ছে ?আমার মতে প্রধান কারন ২ টা- স্বার্থ আর চিন্তাহীনটা । আল্লাহ্র বরকত ছাড়া বড় হওয়া যাবে না। সুখী হওয়া যাবে না, রেজাল্ট ভাল হবে না,পরকালে বাঁশ খেতে হবে- এই চিন্তা থেকে নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য, শাস্তির ভয়ে আমরা যে কর্ম করি-সেটাই ধর্মকর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে । কোন শাস্তির ভয়ে যে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকে,নিজের বিবেক থেকে না,সে তো ফাঁক ফোঁকর খুজবেই উল্টাপাল্টা কাজ করার। আর সেটাই তো হচ্ছে...
আর চিন্তা-চেতনা কাজে না লাগানোকে দায়ী করছি এ জন্য যে ধর্মের(সমাজব্যাবস্থা) ১ টা নিয়ম কেন আরোপিত হল-পটভুমি কি ছিল-এর প্রভাব কি- এসব আমরা ভাবি না... প্রশ্নবিদ্ধ করে উত্তর খুজি না, জানতে চাই না-গুনাহর ভয় এ আর ঝামেলা না করার জন্য। আমাদের তো আরও কত কাজ আছে । সময় কোথায় এসব করার? just মেনে নেই-না বুঝে শুনেই। আর এ কারনেই ইসলাম এর “ঢিলাঢালা, দেহের গড়ন বুঝা না যাওয়ার মত জামা” রূপান্তরিত হয়েছে “স্কিন-টাইট বোরকায়”। কারন আমরা ভাবি “বোরকা পরতে হবে” কিন্তু মন চায় “স্টাইল” করতে । তারপর ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয় নতুন কাটিং এর বোরকা- “সেক্সি বোরকা”। নিজেদের দেহ ঢেকেঢুকে রাখার দায়িত্ব শুধুই পড়ে মেয়েদের ওপর। “স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, তার চে বেশি না করা”এর নিয়মটা শুধু ম্যাট্রিক পরীক্ষাতেই মনে থাকে।
গার্ল-ফ্রেন্ড/ বয়-ফ্রেন্ড এর সাথে সেক্স করার পর ও তাই কেউ কেউ নিজস্ব যুক্তি বানায় ধর্মের নিরিখে এবং তারপর ধর্ম নিয়ে গলাবাজি করে...(সম্ভবত তাদের এই চিন্তা আসে কিছু হিন্দি সিনেমা থেকে যেখানে সকালে নায়ক-নায়িকা নামাজ পরে,আর রাতে......)
দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দর করা-যেটা ছিল সবচে দরকারি- এখন সেটাই আর নেই-আছে কিছু আনুষ্ঠানিকতা আর ভণ্ডামি ।আমরা ভাবছি নামাজ পরলে আল্লাহ খুশি হয়ে যাবে, আর আমাদের স......ব কিছু মাফ করে দিবে। এরা কার্ল মার্ক্স এর বস্তুবাদ ঘৃণা করে, কিন্তু জানে না নিজেরা কতটা সংকীর্ণ বস্তুবাদিতায় নিমজ্জিত। যে বস্তুবাদ স্বার্থের বস্তুবাদ। আধ্যাত্মিকতা যে কি- তা তারা জানে না,কিন্তু ভাব ধরে যে খুব জানে, বোঝে ।
এখন আমাদের দেশে মুরুব্বীরা ধর্মের ব্যাপারে বলে- “আর কিছু না কর,অন্তত নামাজটা পড়।” কি হাস্যকর কথা।।যেখানে বলা উচিত ছিল-“নামাজ কালাম পরতে না পারলেও জীবন বিধানটা মান ” সেখানে পুরা উল্টা কথা...। ছেলেপেলেরাও স্মার্ট একটা ভাব নিয়ে বলে-“ধর্ম নিয়ে আমি বেশি কিছু জানি না,তেমন কিছু করিও না।কিন্তু নামাজটা পড়ার চেষ্টা করি”।
ওয়াও !!! তুমি জানই না ধর্ম কি,তাহলে নামাজ পড় ক্যান?না বুঝেই তারা “ধর্ম কর্ম” করে। কিন্তু এটা আর যেই কর্মই হক,ধর্ম না ।
স্রষ্টা অনেক বড় । আমাদের ইবাদত, তার প্রতি বিশ্বাস – এসবের ওপর তার কোন কিছুই নির্ভর করে না। তিনি আরও উপরে। এই ইবাদত, আরাধনা- সব দেয়া হয়েছে আমাদেরই জন্য । মিজান স্যার ও ঠিক এটিই বলেছিলেন ক্লাস এ- “নামাজ আসলে কার জন্য দেয়া হইছে কও ত......আমাদের, মানুষের জন্য।আমাদের নামাজ পড়া না পড়ায় তার কিছু যায় আসে না। যায় আসে আমাদের।” এখন সেই নামাজের উদ্দেশ্যই আর ঠিক নাই আমাদের মাঝে। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য,লাভ লোকসান এর জন্য আল্লাহ্কে পটানর(আমার ভাষার জন্য আমি দুঃখিত কিন্তু এতাই সত্যি) জন্য যে ইবাদত, তা কোন ইবাদত এর পর্যায়েই পড়ে না। সুতরাং স্রষ্টাকে এরকম ঘুষ(খব খারাপ লাগছে এই ভাষায় কথা বলতে।কিন্তু উপায় নেই) দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই...তিনি আমাদের কল্পনার চেও অনেক বেশি মহৎ। এবং মহৎ সেই সত্ত্বা আমাদের মহত্তকেই বড় করে দেখবেন, ত্যাগ কে দেখবেন- অন্য যে কোন কিছুর আগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১১ রাত ২:৩৩