নীলগিরির চূড়ায় কালি দাশের মেঘদূত
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি নিয়ে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম। উঁচু-নিচু পাহাড়, ঝর্ণা, লেক আর খরস্রোতা নদীর মিলনে বড়ই মায়াময় এ অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এবং সমান্তরাল পাহাড়শ্রেণী বঙ্গোপ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এসব ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পরতে পরতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং, খুমী, পাংখো, লুসাই, রিয়াং, বম, উসুই, অসমীয়া এবং বাঙ্গালীদের বসবাস এঁকেছে বিচিত্র জীবনধারার মোহনীয় ছবি। তাই প্রকৃতি এবং নানা জাতির মানুষ মিলিয়ে অপূর্ব এই অরণ্যময় অঞ্চল।
এখানে জীবন ও প্রকৃতির রং বদলাতে ছয় ঋতুর আনা-গোনা চোখে পড়ার মত। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত সব ঋতুই আসে স্বকীয়তা নিয়ে, আসে বৈচিত্রময় রূপ-রস নিয়ে। এর মাঝে সবুজের ঢালি হাতে আসে শরৎ। শরতের আগমনে সবুজে সবুজে ঢেকে যায় সব পাহাড়। সবুজ চাদরে আবৃত হয়ে পূর্ণতা পায় পাহাড়ী পরিবেশ।
গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার অজর ধারায় জেগে উঠতে শুরু করে এখানকার প্রকৃতি। গাছে গাছে উঁকি দিতে থাকে নতুন কুঁড়িরা। কচি পাতা আর গুল্ম-লতাদের লাজুক চাহনি বয়ে আনে জীবনের জয়গান। বর্ষায় জেগে ওঠা এই কুঁড়িদের দেহে দিপ্তী আসে শরতের ছোঁয়ায়। ঢালে ঢালে শত-সহস্র সবুজ পাতার বন্ধন ছড়িয়ে যায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে। সবুজে সবুজে ঢেকে যায় সমস্ত পার্বত্যাঞ্চল।
বর্ষা পেরিয়ে এখানে শরৎ এলেও থামে না বৃষ্টির দাপট। বরং কোন কোন সময় বর্ষার মতই ভারি বর্ষণ চলতে থাকে দিনের পর দিন। তবে এসময় বেড়ে যায় মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি খেলা। সকাল-সন্ধ্যা, দিন কিংবা রাতে প্রকৃতির এ হেয়ালিপনায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। পাহাড় থেকে পাহাড়ে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়ায় সাদা মেঘের বেলা। কান্ত-পরিশ্রান্ত কালি দাশের মেঘ দূতেরা ফুরামোন, তাজিং ডং, কেওক্রাডাং, চিম্বুক, নীলগিরি হয়ে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ীদের আঙিনা অবদি। চির চঞ্চল শিশুর মত শৈলপ্রপাত, সুভলং, রিচাং এবং আরো জানা-অজানা ঝর্ণাগুলো মনের আনন্দে নেচে যায় অবিরাম। বগাকাইন, রাইনখ্যং, মাতাই পুখিরী হ্রদের বুকে দিনে সূর্য আর রাতে চাঁদের আলো শরতেরআল্পনা এঁকে যায়।
শরতের আগমনে ফুলে-ফেঁপে ওঠে কাপ্তাই লেক। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জালের মত মেলে দেয় তার শাখা-প্রশাখা। কর্ণফুলী নদীর বুক ছাপিয়ে ছড়িয়ে যায় সারা মাইনী উপত্যকায়। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে মায়ালোকের সৃষ্টি করে লেকের স্বচ্ছ গভীর জলরাশি। আর লেকের এই জলরাশিকে ঘিরে বেড়ে যায় পাহাড়ী মানুষের ব্যস্ততা।
শরৎ শুধু এখানের প্রকৃতিতেই সুখের বীজ বুনে না, আনন্দের জোয়ার আনে মানুষের মনেও। কঠোর পরিশ্রম আর দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর জুমিয়ারা ঘরে তুলতে শুরু করে সোনালী ফসল। তাই ঘরে ঘরে খেলা করে নতুন ফসল আর নুয়া ভাতের আনন্দ। অন্যদিকে বৌদ্ধ সাধকেরা তিনমাস ব্যাপী বর্ষাযাপন শেষে বিহারে বিহারে ফানুস উড়িয়ে আয়োজন করে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব।
এখানে মানুষ,পাহাড় আর প্রকৃতি সব মিলিয়ে এক অবর্ণনীয় মহাকাব্যের সৃষ্টি করে শরৎ। আর একারণে, শরৎ এলেই পাহাড়ের দিকে ছুটতে থাকে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের স্রোত।