৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্ষিতা বাঙালি নারীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অস্ট্রেলীয় ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস গণধর্ষণের ভয়াবহ মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক পাক অফিসারকে জেরা করেছিলেন যে, তারা কীভাবে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারল। অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক বিচলিত হলেও পাক অফিসারদের সাচ্চা ধার্মিক হৃদয়ে এ কথায় কোনো রেখাপাত ঘটেনি। তাদের সোজা জবাব ছিল এ রকম:
“ আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে, একজন ভালো মুসলমান কখনওই তার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশি সম্ভব বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করে যেতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণকারী এক পাকিস্তানি মেজর তার বন্ধুকে চিঠি লিখেছে:
“আমাদের এসব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানি।”
উপরের ঘটনা দুটো প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ। এটা শুধুমাত্র নিম্নপদস্থ সৈনিকদের মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর উচ্চপদস্থ অফিসারদের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। ৭১ এ সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ডিভিশান কমান্ডারের কনফারেন্সে এক অফিসার পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। নিয়াজী তখন সেই অফিসারকে বলেন:
“আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক বলে ধরে নিও।'
”তারপর তিনি হেসে বলেন:
“ভালোই তো, এসব বাঙালি রক্তে পাঞ্জাবি রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।
”ধর্ষণের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন:
“আপনারা কীভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে, যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং যৌনক্ষুধা মেটাতে যাবে ঝিলমে?
”পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী তার "East Pakistan The End Game" বইতে আরও লেখেন:
“নিয়াজী জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাসক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন।”
“গত রাতে তোমার অর্জন কি শেরা (বাঘ)?”চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকে বোঝাতেন!
পাকিস্তানি জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা "A Stranger In My Own Country" বইতে লিখেছেন:
“নিয়াজী ধর্ষণে তার সেনাদের এতই চাপ দিতেন যে তা সামলে উঠতে না পেরে এক বাঙালি সেনা অফিসার নিজে আত্মহত্যা করতে বসেন।”
“বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা।” মাল বলতে এখানে বাঙালি মেয়েদের কথা বলা হয়েছে!
এই সব খণ্ড খণ্ড জবানবন্দি এই কথাই প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ সাধারণ কোনো যুদ্ধের ধর্ষণ নয়। এটা পাকবাহিনী শুধু আনন্দের জন্য করেনি, তারা এটা করেছে দায়িত্ববোধ থেকে। শুধু আনন্দের জন্য এত বীভৎসতা, এত বার ধর্ষণ করতে হয় না। খুলনার ক্যাম্প থেকে কাচের জারে ফরমালিনে সংরক্ষিত নারী শরীরের অংশ উদ্ধার আর দেয়ালে সদম্ভে এঁকে রাখা কৃতকর্মের ছবি দেখে বুঝে নিতে হয় যে, এই ধর্ষণ দু-একজন সামরিক কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন মনোরঞ্জনের ঘটনা নয়। তারা এসব করেছিল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে।
সেই এজেন্ডার কথা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কালজয়ী উপন্যাস “নিষিদ্ধ লোবান”এ তুলে ধরেছেন বাস্তবসম্মতভাবে:
“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানি হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।
”যারা পাকিস্তানের পক্ষে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে কথা বলে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেয়, পাকিস্তানের দালালী করে। এরা পাকিস্তানের ফেলে যাওয়া বীর্যপাতের ফসল!