একটা উন্মুল ও উন্মাদ সম্প্রদায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের শিকড় থেকে বিচ্যুত হলে যা হয় আর কী, সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো ঘুরপাক খায় আর নিন্মগামী হয়! এমন নির্বোধ যে নিজেদের পতনও টের পায় না। সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কবিতার (সৃষ্টিকর্তার বন্দনা ব্যতিত) মতো নান্দনিক শিল্পের বিরোধীতা করা এক মতবাদের অনুসারী এরা, কিন্তু এসব ত্যাগও করতে পারে না। ফলে এরা কী করবে, কোন পথে হাঁটবে, কিভাবে উৎসব উদযাপন করবে তা বুঝে উঠতে পারে না। তালগোল পাকিয়ে ফেলে। নিজেরাই নিজেদের মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ড করে। কোনো আদর্শ বা দর্শনে পৌঁছতে পারে না। উৎসবের নামে তারা যা করে, তা হয়ে যায় সম্প্রদায়গত রাজনীতি। একদিকে মূর্তি হারাম বলে হিন্দু-বৌদ্ধদের মন্দিরের মূর্তি ভাঙবে, মাজার ভাঙবে, সারাদেশের ভাস্কর্য ভাঙবে; অন্যদিকে উৎসবে নিজেরাই মূর্তি বানিয়ে শোভাযাত্রা করবে! বাদ্যযন্ত্র হারাম বলে বাউল আখড়া পুড়িয়ে দেবে, বাউলদের চুল-দাড়ি কেটে দেবে; অন্যদিকে নিজেরাই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোভাযাত্রায় নাচানাচি করবে! ছবি তোলা হারাম বলে একদল রাস্তায় নামবে এনআইডি কার্ডে ছবি রাখার বিরুদ্ধে, আরেক দল নিজের ফেসবুক পেইজে সেলফির বন্যা বইয়ে দেবে ও বিত্ত-বৈভব প্রকাশ করবে! একদিকে ভিন্ন সম্প্রদায়ের ভূমিপুত্রদের ওপর নিপীড়ন করে জন্মভূমি থেকে উৎখাত করবে, অন্যদিকে ভয় দেখিয়ে বা টাকার লোভ দেখিয়ে তিনজন বৃদ্ধা ভূমিকন্যাকে (সাজানোও হতে পারে, অতীতে তেমন হয়েছে) ধরে এনে নিজেদের শোভাযাত্রার সামনে রেখে দেখাবে যে তারা কত অসাম্প্রদায়িক! আরব্য ভাষায় এটাকে তাকিয়া বলে। এরা আসলে কী চায় তা নিজেরাও জানে না। ফলে এরা যা করে তা হয়ে যায় উন্মাদের কর্মকাণ্ড! আর তাদের এই উন্মাদ কর্মকাণ্ডকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে! এদের নির্মল কোনো উৎসব নেই, সবই রাজনৈতিক উৎসব!
এদের এই উন্মাদকাণ্ড যদি কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে কোনো অসুবিধা থাকত না। মুশকিল হলো এরা পৃথিবীর অন্য সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির মানুষকে বিরক্ত করে। ভিন্ন সংস্কতির ওপর আক্রমণ করে, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালায়, মানুষ হত্যা করে। ছলে-বলে অন্যদেরকে মতাদর্শ বদলে উন্মাদের মিছিলে যুক্ত করতে চায়। আরও মুশকিল হলো আপনি যখন তাদের এই আক্রমণাত্মক, ধ্বংসাত্মক, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন, তখন জঙ্গি থেকে সুশীল সকলে একযোগে কোরাসে গলা মিলিয়ে আপনার গায়ে ‘উন্মাদবিদ্বেষী’ তকমা লাগিয়ে দেবে। কারণ, তারা এই ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে তাদের মতবাদের অনুসঙ্গ বা ধর্ম বলে জ্ঞান করে।
কিন্তু, তাদের জন্য যা ধর্ম, পৃথিবীর সভ্য সম্প্রদায়গুলোর জন্য তা জীবিকা ও জীবন-মরণের প্রশ্ন। ফলে সভ্য সম্প্রদায় উন্মাদদের ‘ধর্মীয় অনুসঙ্গ’, অর্থাৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
মূর্তি ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শোভাযাত্রার আজকের দিনটা পেরিয়ে গেলে কাল থেকেই উন্মাদ সম্প্রদায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হবে পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে, মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে। তাদের উপাসনালয় বা যুদ্ধমন্ত্রালয়ের মাইকগুলো গর্জে উঠবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’ ও ‘পৌত্তলিকতা’ আখ্যা দিয়ে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’, পহেলা বৈশাখে মুড়ি-খই-নাড়ু খাওয়া ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’। তাহলে ভাত খাওয়া কী? এই প্রশ্ন তুললেই উন্মাদ সম্প্রদায় গর্জে উঠবে- ‘আপনি উন্মাদবিদ্বেষী’।
এরা সহজে শোধরাবে, সভ্য হবে, এই আশা করা সুদূর কল্পনা। ফলে আপনি এদের হাতে ভিন্ন ধর্মের মন্দিরের মূর্তি ও বাধ্যযন্ত্র ভাঙার সংবাদ দেখে রাতে ঘুমাতে যাবেন, আর সকালে উঠে মূর্তি ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এদের শোভাযাত্রার নামে রাজনৈতিক ও ভণ্ডামীপূর্ণ উন্মাদযাত্রা দেখবেন, যেখানে বাঙালি সংস্কৃতির চিহ্ন থাকবে না!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫০