বিলাসিতায় মগ্ন মুসলিম জাতি তার আরেক মুসলিম ভাইয়ের নির্মম হত্যার সংবাদ শুনে কেবল একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেদের রাজভোজ আর খোশগল্পে মনোনিবেশ করে। হায় আফসোস! কোথায় সেই মহামানব যিনি বলেছিলেন, "গোটা মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মতন", কোন মুখে তার সাথে সাক্ষাৎ করবো? কেন আল্লাহ বলেছেন, " মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই "? আজ আমরা আমাদের দেহের এক অংশে আঘাত পেলে অপর অংশে তা অনুভব করি না, সেই আঘাত সারানোর চেষ্টা করি না। কেবল ব্যাথানাশক ওষুধ সেবন করে সাময়িক শুশ্রূষার চেষ্টা করি যা দীর্ঘমেয়াদে মরণব্যাধি ক্যানসারের আকারে আত্মপ্রকাশ করে যখন দিন গণনা করা ছাড়া কিছুই বাকি থাকে না। গাজার জমিন আজ লাশের ভার সইতে পারছে না তাই আকাশে আমাদের ভাইবোনের লাশ উত্থিত হয় কিন্তু তাতেও আমাদের আনন্দে ভাটা পড়ে না। ঈমানের এতটাই অবক্ষয় হয়েছে যে মুসলিম তার সহোদরের অনিষ্ট কামনা করে। সম্পদের মোহে মরিয়া হয়ে বিলাসী জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আমরা অন্ধের মত মরীচিকার পিছনে ছুটে চলছি। কোরআনের আয়াতগুলো যেন জীবন্ত চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমাদের অন্তর তালাবদ্ধ তাই বিবেকের কড়া নড়ছে না।
# اَلۡہٰکُمُ التَّکَاثُرُ ۙ حَتّٰی زُرۡتُمُ الۡمَقَابِرَ ؕ
(পার্থিব ভোগ সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। (আত তাকাছুর - ১, ২)
এ আয়াতে আছে বর্তমান সমাজের নির্মম বাস্তবতা। সামান্য একটু চিন্তা করলেই এর শতভাগ সত্যতার প্রমাণ মেলে, অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে অন্য আয়াতে আছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা যেটা উপলব্ধি করতে পারলে মৃত্যুর পূর্বেই বহু হিসাব চুকে যেত। আফসোস উপরের আয়াতের মধ্যে আমরা শক্তভাবে আবদ্ধ।
اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّلَہۡوٌ وَّزِیۡنَۃٌ وَّتَفَاخُرٌۢ بَیۡنَکُمۡ وَتَکَاثُرٌ فِی الۡاَمۡوَالِ وَالۡاَوۡلَادِ ؕ کَمَثَلِ غَیۡثٍ اَعۡجَبَ الۡکُفَّارَ نَبَاتُہٗ ثُمَّ یَہِیۡجُ فَتَرٰىہُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَکُوۡنُ حُطَامًا ؕ وَفِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۙ وَّمَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَرِضۡوَانٌ ؕ وَمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ
জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, কৌতুক, বাহ্যিক সাজসজ্জা, তোমাদের পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে অন্যের উপরে থাকার প্রতিযোগিতারই নাম। তার উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদগত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, তারপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপর তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখেরাতে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়। (আল হাদীদ - ২০)
# وَمَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَالۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَآءِ وَالۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ ہٰذِہِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَہۡلُہَا ۚ وَاجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّاجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا ؕ
(হে মুসলিমগণ!) তোমাদের জন্য এর কী বৈধতা আছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে সেই সকল অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করবে না, যারা দু‘আ করছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম অন্যত্র সরিয়ে নাও এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হতে একজন অভিভাবক বানিয়ে দাও এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হতে একজন সাহায্যকারী দাঁড় করিয়ে দাও? (আন নিসা - ৭৫)
এ আয়াতে কি ফিলিস্তিনের মুসলিমদের আর্তনাদ নেই, নেই কি প্রতিবেশি আরাকানের অসহায়ত্ব, কাশ্মীর সহ গোটা ভারতে নিপীড়িত মুসলিমের আকুতি? তবে যে সকল মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা দান করেছেন তাদের চিন্তাচেতনাও কোরআনে ব্যক্ত করা হয়েছে। দেখুন তো কোথায় অমিল আছে? ভোগবিলাসে মত্ত আরব বাদশাহদের অবস্থাই যেন সুস্পষ্ট।
إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱرْتَدُّوا۟ عَلَىٰٓ أَدْبَـٰرِهِم مِّنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلْهُدَى ۙ ٱلشَّيْطَـٰنُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا۟ لِلَّذِينَ كَرِهُوا۟ مَا نَزَّلَ ٱللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِى بَعْضِ ٱلْأَمْرِ ۖ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ ٢٦
নিশ্চয় যারা হিদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পৃষ্টপ্রদর্শনপূর্বক মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদের কাজকে চমৎকৃত করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দিয়ে থাকে। এটি এ জন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যারা অপছন্দ করে তাদের উদ্দেশ্যে তারা বলে, ‘অচিরেই আমরা কতিপয় বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব’। আল্লাহ তাদের গোপনীয়তা সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। (সুরা মুহাম্মদ :২৫,২৬)
# وَیَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَوۡلَا نُزِّلَتۡ سُوۡرَۃٌ ۚ فَاِذَاۤ اُنۡزِلَتۡ سُوۡرَۃٌ مُّحۡکَمَۃٌ وَّذُکِرَ فِیۡہَا الۡقِتَالُ ۙ رَاَیۡتَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ یَّنۡظُرُوۡنَ اِلَیۡکَ نَظَرَ الۡمَغۡشِیِّ عَلَیۡہِ مِنَ الۡمَوۡتِ ؕ فَاَوۡلٰی لَہُمۡ ۚ
আর যারা ঈমান এনেছে তারা বলে, কোন সূরা নাযিল হয় না কেন? অতঃপর যখন যথোচিত কোন সূরা নাযিল হয় এবং তাতে যুদ্ধের উল্লেখ থাকে, তখন যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তুমি তাদেরকে দেখবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্যুভয়ে মূর্ছিত ব্যক্তির তাকানোর মত। তাদের জন্য রয়েছে চরম ধ্বংস। (মুহাম্মাদ - ২০)
নতুন দাঁত গজানো বহু ইসলামি বক্তার মুখে ফিলিস্তিনের যুদ্ধে যোগদানের বেশ আকুতি ও আহ্বান শোনা গেছে। মনে হতো যেন এক্ষুনি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে আল আকসা মুক্ত করবে। কিন্তু যখন নিজ মাতৃভূমিতে পাখির মত গুলি করে নির্বিচারে নির্দোষ মানুষকে এমনকি নিষ্পাপ বাচ্চাদেরও শহীদ করা হয়েছিল তখন সেই মুক্তিকামীদের কোন হদিশ পাওয়া যায় নি। আল্লাহ এমন প্রজন্মকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যাদের মাধ্যমে কল্পনাতীত ভাবে জালেমের পরাজয় ঘটেছে। একইভাবে আল্লাহ আবার এমন কোন দলকে প্রেরণ করবেন যারা ইসরায়েলী বর্বর জালিমদের কচুকাটা করবেন ইনশাআল্লাহ।
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَنۡصُرُوا اللّٰہَ یَنۡصُرۡکُمۡ وَیُثَبِّتۡ اَقۡدَامَکُمۡ
হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহ (তাআলার দীন)-এর সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম অবিচলিত রাখবেন। (মুহাম্মাদ - ৭)
এতো বিপুল সংখ্যক মুসলমান থাকা স্বত্বেও পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের অসহায় অবস্থা। যে ভবিষ্যৎবাণী নবীজি ﷺ হাজার বছর পূর্বেই করে গেছেন এবং তার কারণও বলেছেন।
# আব্দুর রহমান ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) .... ছাওবান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ অদূর ভবিষ্যতে অন্য জাতির লোকেরা তোমাদের উপর বিজয়ী হবে, যেমন খাদ্য গ্রহণকারী বড় পাত্রের দিকে আসে। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেঃ আমাদের সংখ্যা কি কম হবে? তিনি বলেনঃ না, বরং সে সময় তোমরা সংখ্যায় অধিক হবে। কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে সমুদ্রের ফেনার মত। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর হতে তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দূর করে দেবেন এবং তোমাদের হৃদয়ে অলসতার সৃষ্টি করে দেবেন। তখন জনৈক সাহাবী বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! অলসতার সৃষ্টি কেন হবে? তিনি বলেনঃ দুনিয়ার মহব্বত ও মুত্যু ভয়। ( সুনানে আবু দাউদ :৪২৯৭)
দুনিয়াপ্রীতি ও মৃত্যুর ভয় মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত মুমিনদের পরিচয় তুলে কোরআনে বলেছেন,
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ ١٥
মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের সম্পদ ও নিজেদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ। (হুজুরাত:১৫)
ক্ষমতাভেদে দায়িত্বে তারতম্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যার ক্ষমতা বেশি তার দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা বেশি। একজন মুমিন মুসলিমের ক্ষেত্রেও একই। আমরা সাধারণ মুসলিম তাই চাইলেই অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয় কিন্তু নিজের সাধ্যমত অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
# সর্বস্তরের মুসলিমের জন্য অপরিহার্য অপর মুসলিমের বালা মুসিবতে আল্লাহর দরবারে অধিক পরিমাণে দোয়া করা। যার এছাড়া অন্য কিছু করার সাধ্য নেই সেই এতটুকু তো করতেই পারে।
# দানের হাত প্রশস্ত করা। ক্ষতিগ্রস্থ মুসলিম ভাইকে অর্থ, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা।
# জালেমকে দুর্বল করার চেষ্টা করা। যে সকল পদক্ষেপ নিলে জালেমের শক্তি কমে যাবে সে কাজ করা। যেমন, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করা।
# নিপীড়িত মুসলিমের পক্ষে ও জালেমের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং নিজ দেশের সরকারে চাপ সৃষ্টি করা যাতে অন্যায়ের বিরূদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। কেবল নিন্দা জানানো কোন সমাধান নয়।
# সম্ভব হলে জালেমের সহায়তাকারী দেশে বসবাস পরিত্যাগ করা। সেখানে সেবা, মেধা দিয়ে তাদের বল বৃদ্ধি না করে নিজের ভাইয়ের জীবন বাঁচানোর কথা মাথায় রাখা উচিত।
# শারীরিক ও মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা যাতে ডাক আসার সাথে সাথে নিজের জান মাল নিয়ে নিপীড়িত ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া যায়।
# নিজেদের সন্তানদের ভোগবাদী চেতনা থেকে বের করে অপরের কল্যানের জন্য সর্বদা ত্যাগী মনোভাব গড়ে তোলা।
এ পরীক্ষা শুধু ফিলিস্তিনের মুসলমানদের নয়, এটি গোটা মুসলিম উম্মাহর পরীক্ষা। নিপীড়িত ভাইদের আর্তনাদ ভোগবিলাসে নিমজ্জিত আরবদের নিশ্চুপতা যদি পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য আযাব ডেকে আনে তাহলে অবাক হওয়ার কথা নয়। গাজাবাসী তো মরেও বেঁচে যাবে কিন্তু যদি হাশরের মাঠে আমাদের এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন আমরা কি উত্তর দিবো???
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:২৬