প্রতিকী ছবি
বাংলাদেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরছেন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে একই সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে বিমসটেক সম্মেলনে মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক না হওয়ায়।
চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি। বিশেষ করে চীনের শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এবং মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। চীনের এই বিনিয়োগ দেশের উৎপাদন শিল্প, ওষুধশিল্প এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এছাড়া, চীনা বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুধুমাত্র থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকের সুযোগ থাকছে না। বাংলাদেশ সরকার ভারতকে বৈঠকের প্রস্তাব দিলেও সাড়া মেলেনি, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা দূরত্বের ইঙ্গিত দেয়।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল কতটা সফল হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ভারতের সঙ্গে ঐতিহ্যগত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি ঝুঁকে পড়া কিছুটা কৌশলগত দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন থেকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার এই প্রয়াস অবশ্যই ইতিবাচক, তবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়লে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য চীনের বিনিয়োগ অবশ্যই একটি বড় অর্জন। তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও চীন— উভয় দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুসংহত রাখতে হলে বাংলাদেশের উচিত কৌশলগত দূরদর্শিতা বজায় রাখা।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, চীনের বিনিয়োগ সুবিধাগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তাপ কমানো। ভবিষ্যতে এই দুই পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতার আসল পরীক্ষা।
এর পাশাপাশি, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় থাকলেও ভারতের দিক থেকে কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। চীন ইতোমধ্যে তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে, যা বাংলাদেশে সেচ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ভারত এই প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।