মেঝ বেলায় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার একটা বই পড়েছিলাম 'গোরস্থানে সাবধান' নামে, সেখানে কোলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিটেরপ্গোরাচীন এক খ্রীস্টান কবরস্থানের দারুন জাকালো বর্ণনা ছিল, যাতে জোব চার্নকের সমাধিটাও আছে। মুলত: এই বইটা পরেই এ ধরণের সমাধিক্ষেত্র সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হয়েছিলাম, খোজ নিতে থাকলাম বাংলাদেশেও কি আছে এমন? অবশেষে খোজ মিলল ঢাকার ওয়ারির খ্রিস্টান সমধিক্ষেত্রের। এম্নিতে গোরস্থান শব্দটি শুনলে আমার কেন যেন একটা গা ছমছমে অনুভুতি হয়! তবে দিনের বেলা তো ভুতের ভয় নেই, তাই একদিন সাহস করে চলে গেলাম ঢাকার ওয়ারির খ্রিস্টান সমধিক্ষেত্রের সমাধি সৌধ গুলোকে দেখার জন্য।
সমাধি বা কবরের উপরে বিশেষ আকারে বানানো স্মৃতিসৌধকে সমাধি সৌধ বলা হয়। মিশরের বিখ্যাত পিরামিড কিংবা ভারতের তাজমহল এই সমাধিসৌধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মৃতদেহের সাথে ফুল ও বিভিন্ন দ্রব্য শ কবরদেবার প্রথা ৫০,০০০ বছর আগে প্রচিলত ছিল! এর পরে কালের সাথে সাথে সমাধি আর সমাধি সৌধ নির্মানের পদ্ধতিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই এই সমাধি সৌধ গুলো ইতিহাস আর ঐতিহ্যের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশের উপনিবেশিক শাসনামলে সমাধি সৌধ স্থাপত্য নির্মানে এক নতুন ধারা সংযোজিত হয়, এর চমৎকার একটা নির্দশন হলো ঢাকার ওয়ারিতে অবস্থিত নারিন্দা খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্র!
বাংলায় বসবাসরত বৃটিশরা এই সমাধি ক্ষেত্রটি নির্মাণ করেছিলেন, যা বাংলার অন্যতম বৃহৎ সমাধিক্ষেত্র ।অনুমানিক ৬।৪৫ একর জমির উপর নির্মিত এই সমাধিক্ষেত্রটি তৎকালনী ইউরোপীয় ব্যবাসায়ী ও তাদের পরিবার পরিজনদের জন্য নির্ধারিত ছিল, এছাড়া সিপাহী বিদ্রোহের সময় লালবাগ দূর্গে নিহত সৈনিকদের সমাধিও এখানে আছ্বে।
১৮৭০ সালে তোলা নারিন্দা খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রের ছবি!
এখানে পাওয়া সর্বপ্রাচীন শীলা লিপিটির সময়কাল ১৭২৪ খ্রী:, সেই হিসাবে ধারণ করা হয় ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে সম্ভবত এই সমাধিক্ষেত্রটি নির্মিত হয়েছিল। এর প্রায় একশ বছর পরে বিশপ হবার ঢাকা শহর পরিভ্রমনে আসলে এই সমাধাক্ষেটিও দেখতে এসেছিলনে, তার বর্নানায় তিনি সমাধিক্ষেত্রটিকে পরিত্যক্ত, জঙ্গলে ছাওয়া এবং ধ্বংসাবেশষ পরিবেষ্টিত জায়গা হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
বাংলায় খৃষ্টানদের এই সমাধিক্ষেত্রটি নির্মানে অবশ্য তেমন বিশেষ কোন পরিকল্পনা চোখে পরে না, মানে প্রাচীন সমাধি স্তম্ভ গুলোর বিন্যাস তেমন গোছানো না, অনেকটা খেয়ালখুশি মতো যেন বানানো হয়েছিল। ভেতরের রাস্তাগুলো এমন ভাবে বানানোযে , রাস্তা থেকে কোন সমাধিস্তম্ভ তেমন পরিস্কার ভাবে বোঝা যায়না!
এরপরও ভালো ভাবে খেয়াল করলে এখানে তিনটি ভাগের সমাধি বিন্যাস লক্ষ করা যায়। প্রথম অংশের মধ্যে আছে ১৭২৮ থেকে শূরু করে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে পুরানো কবর গুলো, দ্বিতীয় ভাগে বাম দিকের দেয়াল বরাবর রয়েছে ১৮৫০ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের সমাধি গুলো আর সমাধি ক্ষেত্রের একেবার শেষের দিকে আছে সমসাময়িককালে নির্মিত স্থাপনা গুলো।
এটা হলো মুল প্রবেশদ্বার। বর্তমান কালে নতুনকরে বানানো গেট দিয়ে ঢুকে বেশ কিছু দূর এগুবার পরে চোখে পড়বে এটা। মুরীয় আদলে তৈরি এই তোরনটি যেন হঠাৎ করেই গজিয়ে উঠেছে, এর অবস্থানের সাথে আশেপাশের সমাধি স্থাপনার গুলোর অবস্থান কেমন যেন একটু বেখাপ্পা লাগে! তবে কি কোন বিধিবদ্ধ ভুমি পরিকল্পনা ছাড়াই সমাধিক্ষেত্রের নকশা বানানো হয়েছিল?
চারকোনা, গোলকারা, চাঁদোয়া বা পিরামিড আকারের বেশ কিছু সমাধি চোখে পড়বে এখানে, যা সমসামিয়ক কোলকাতার ইংলিশ সামধক্ষেত্রের অনুকরণে তৈরি! এই সমাধিগুলোই অপেক্ষাকৃত পুরাতন এবং তৎকালিন প্রাদেশিক খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্র গুলোর মতো বারুক রিতীতে বানানো। এর মধ্যে পিরামিড আকারের সে সমাধি আছে সেগুলো আবার বেশি পুরানো এবং এই সমাধি গুলোর নাম হলো "ওবেলিস্ক"!
এই পিরামিড আকারের সমাধিগুলোই সবচেয়ে পুরানো ও মৌলিক। উপমহাদেশে ওবেলিস্ক সর্বপ্রথম দেখা যায় মাদ্রাজে, এগুলো ১৬৮০ সালের দিকে বানানো হয়েছিল।
এটাও ওবেলিস্ক, সাদা চুনকাম করে ফেলা হয়েছে, উপরে ক্রুশবিদ্ধ যীশু।
এলিজাবেথ নামক জনৈক মহিলার সমাধি, বিষন্ন মা মেরীর মূর্তিটা অনন্যতা এনে দিয়েছে!
এটার নির্মাণ রীতিটাও চমকপ্রদ, তবে এপিটাফের কিছুই আর পড়া যায় না!
বারুক রিতীতে বানানো গোলাকার আরেকটা সমাধি, এপিটাফ কেউ একজন খুলে নিয়ে গেছে!
সবচেয়ে অকর্ষনীয় এবং দৃষ্টিনন্দন সমাধি গুলো হলো গম্বুজ শ মন্দির আকারে নির্মিত স্থাপনা গুলো।
গোল, বর্গাকার বা আটকোনা স্ট্রাকচারের সাথে ডরিক এবং আয়োনিক ধরণের স্তম্ভ আর উপরে গোলাকার গম্বুজ সমাধি গুলোকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে । ইউরোপীয় রীতির সাথে স্থানীয় মুঘল রীতির সমন্বয়ের একটি চমৎকার উদারণ এগুলো।
এরমধ্যে সব চাইতে নজরকারা সমাধি সৌধটি বেক এর যেটা কলোম্বো সাহেবের সমাধি নামে ভুল পরিচিত।
কলোম্বো সাহেবের সমাধিসৌধ
চারকোণা এই স্থাপনার শীর্ষে গম্বুজ আচ্ছাদিত একটা আটকোনা বরুজ আছে, আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এর ভিতের কবরের সংখ্যা কিন্তু তিনটা। প্রতিদিকে একটা করে দরজা আছে। দেয়ালে বেশ কিছু শিলালিপি আছে আবে প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত!
সমাধিটির সামনের দিকে খুব সু্ন্দর প্যাচানো নকশা করা ফ্রী স্ট্যান্ডিং পিলার আছে!
বর্তমানে এই সমাধিক্ষেত্রটি সেন্ট মেরী ক্যাথিড্রালের তত্ত্বাবধানে আছে। ওয়ারির জয়কালী মন্দিরের কাছে , বলধা গার্ডেনের সাথেই অবস্থিত এই প্রাচীন নির্দশনটি দেখে আসুন যে কোন একদিন পুরোপরি ধ্বংস হয়ে যাবার আগেই!!!!
তবে যতই স্থাপত্যিক সৌন্দর্য্যের বর্ণানা করি না কেন, আমাকে হাজার টাকা দিলেও গোরস্থানে পাশের বাড়ি গুলোতে থাকবো না
এই সংক্রান্ত সুন্দর একটা লেখা, সৌম্য ভাইয়ের ৪০০ বছরের রাজধানীঃ নারিন্দা আর্মেনীয়ান গোরস্তান
প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র নিয়ে আমার অনান্য লেখা..........
১।বাংলাদেশের মেগালিথিক সৌধ গুলো কি আসলেই কি সমাধি বা স্মারক সৌধ????
২।শূন্য গর্ভ হাইকোর্টের মাযার
তথ্য সুত্র:
১। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা -১, প্রত্নত্বাত্বিক ঐতিহ্য,
২।বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা -২, স্থাপত্য।