বিচার বসছে। শহর নয় গ্রাম্য আদালত। বিচারকের আসনে তিন যুবক। সবার বয়স ২১ থেকে ২৬ এর মধ্যে। পুরো গ্রাম চলে এসেছে বিচার দেখতে। সবাই গোল হয়ে বসা। কোনো চেয়ার নেই। কেউ ঘাসে বসেছেন। কেউ জুতায়। কেউবা কলার পাতায়।
মসজিদে আগে কলার পাতায় সিন্নি দেয়া হতো। মোহসেন আলীর মনে পড়ে গেল। গপগপ করে সিন্নি খেত পাড়ার মানুষ। ছেলে বুড়ো জওয়ান। গরিবদের বিয়েতেও খেতে দেয়া হতো কলা পাতায়। সবাই এমন তৃপ্তিতে খেতো যেন ভাত নয় অমৃত খাচ্ছে। রাজ্যের তৃপ্তি মিটে যেত সে খাওয়ায়।
মোহসেন আলী দেখল বিচারের কাজ ভালোভাবেই এগুচ্ছে। তরুণ বিচারকদের কথাগুলো কি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সবাই। মুরব্বি ও মাতুব্বর টাইপের লোকরাও। রূপ কথার রাজ্য নয়তো!
বিচার শেষ হলো। সবার মুখে হাসি। পরাজিতদের মুখেও। মোহসেন আলীর প্রেম উছলে উঠল। কোনো মেয়ের প্রতি নয়। গ্রামের প্রতি। পেপারে গ্রামটার কথা পড়ে দেখতে এসেছিল। দুইদিনের সংক্ষেপ সফর। কিন্তু কিভাবে সপ্তাহ পার হলো। জানে না মোহসেন। রাতে বাসায় ফিরে পেপারটা আবার মেলে ধরল। আগের চেয়ে লেখাগুলো বড় বড় লাগছে। যেন ম্যাগনিফাইং গ্লাস রেখে পড়ছে- গ্রামের নাম ছিল নালুয়াডাঙ্গা। হয়ে গেল শিউলিমালা। এমনি নয়। পেছনে লম্বা ইতিহাস। ইতিহাসের পেছনে তিন তরুণ। সমাজের অধপতন দেখে দেখে যাদের বিতৃষ্ণা জেগেছিল। একদিন নেমে গেল অভিযানে। প্রথমে শিক্ষা স্বাস্থ্য ধর্ম। তারপর সমাজ আর নৈতিকতা। একদিন দুদিন নয়। কাজ চলল ছয় বছর। সাফল্য এল। কালো পায়রাগুলো সাদা হলো। উড়লো আকাশে। গ্রামের মানুষের অসম্ভব ভক্তি জমে গেল। এভাবে তো জীবন সুন্দর করা যায়। তিন তরুণকে তারা সরদার বানাল। গ্রামে অবিচার নেই। অন্যায় নেই। মাঝে সাজে কেউ অন্যায় করলে তার কঠোর শাস্তি। দেখে যেন অন্যরা নিরুৎসাহিত হয়। গ্রাম চলল শুদ্ধ নিয়মে। যেন দেশের ভেতর স্বায়ত্বশাসিত একটি গ্রাম।
দৈনিক ভোরবেলার এ প্রতিবেদনে মুগ্ধ হয়েছিল চল্লিশোর্ধ মোহসেন। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিল গ্রাম দেখতে যাবে। বের হল পরদিন ভোরবেলায়। নোয়াখালী থেকে সোজা ঠাকুরগাঁওয়ের শিউলিমালায়। গ্রামে হোটেল নেই। এক লোককে তার অভিপ্রায়ের কথা জানালে অনায়াসে থাকতে দিল। কেটে গেল সাতদিন।
মোহসেন আলীর দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত। সে এখানেই থেকে যাবে। মেজবানকে জানাল এ কথা। খুশি মনে উৎসাহ দিলেন তিনি।
গ্রামে থাকলে কিছু করা চাই। কী করবে। ভেবে ভেবে দেখল এখানে ভালো একটা হোটেলের অভাব। ভাত রুটির হোটেল। গ্রামের বাজারে যাওয়ার পর সে দেখেছিল খাবারের কোনো হোটেল নেই। সবই মুদি দোকান। দেখতে দেখতে তার হোটেলটা ওঠে গেল একসপ্তায়।
বেশ আয়োজন করে হোটেলটা শুরু হলো। কয়েকজন কর্মচারী রাখল। ভাত তরকারি রান্না হচ্ছে প্রতিদিন। সকালে রুটি সজবির ব্যবস্থা। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মোহসেন আলী দেখল হোটেলে লোক তেমন আসছে না। কিছু লোক আসছে আবার দরজা থেকেই ফিরে যাচ্ছে। তাদের অনেককে কারণ জিজ্ঞেস করলেও তেমন উত্তর পেল না। আসলে গ্রামের মানুষগুলো দেখলেই বড্ড ভাবুক মনে হয়। ভাবুকরা একটু কম কথা বলেন।
মোহসেন প্রথমে ভেবেছিলেন নতুন হোটেল। কয়েকদিন চলার পর সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু একমাস অতিক্রম করার পরও যখন অবস্থার উন্নতি হলো না মোহসেন ভাবল গ্রামের গ্রামের সরদারদের কাছে যাবে । বলবে সমস্যার কথা ।
সব শুনে একদিন হোটেলে এল তিন তরুণ । সামনে দাঁতেই ধরে ফেলল সমস্যাটা । পরদিন হোটেলের সাইনবোর্ডটা পাল্টে দিল তারা । ফড়শী হোটেল হয়ে গেল পড়শী হোটেল । বিকেল থেকেই লোক বাড়তে থাকল হোটেলে ।