somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওই ছিঁড়েছে মেঘের পাল

১০ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই মেঘ এই বৃষ্টি। কখনো বা পূবাকাশ লাল করে ঝরে রোদের কিরণ। ক্ষানিক পরেই মেঘের ডাক। ধান চাল আর শুকাতে দেয়া কাপড় গোছাতে ব্যস্ত গৃহিনী। রাখালরা ব্যস্ত গরু-ছাগল নিয়ে। আর রাস্তার যাত্রীরা মেলেন ছাতা। পরেন রেইনকোট। বর্ষার প্রকৃতির রঙ এটি। প্রকৃতি যখন রুক্ষ। গ্রীষ্মের তাপদাহ। কলজে শুকিয়ে ওঠা গরমে যখন অস্থির সবাই। তখন একখণ্ড মেঘ চায় মানুষ। স্রষ্টাও বুঝেন সেই আকুতি। তাই গ্রীস্মের পরেই আসে বর্ষা। আসে প্রশান্তি নিয়ে। অস্থির মানুষকে দেয় শান্তির পরশ। গায়ে লাগে নতুন রঙ। নতুন আমেজ।
আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। বৃষ্টির মাস। সদ্য বিদায়ী গ্রীষ্ম থেকে হাফ ছাড়ে মানুষ। নতুন উদ্যম আনে কাজে। গায়ে গতরে আসে ভিন্নতা। সারাদিন বর্ষণে ক্লান্ত হয় আকাশ। রুক্ষ হয় বাতাস। কিন্তু বর্ষার ক্লান্তি নেই। ‘যতটা গর্জে ততটাই বর্ষানো’ তার কাজ। আষাঢ় মাসে বর্ষা হাজির হলেও এর আমেজ থাকে আরো আগে। গাছে গাছে আসে নতুন পাতা। নতুন কুড়ি। জীবনের গতিধারায় আনে পরিবর্তনের ছন্দ। মানুষও পুরনো দু:খ ভুলে নেচে ওঠে বৃষ্টির ছাঁচে।

এ দেশের মানুষ বৃষ্টির জন্য আনন্দিত। বৃষ্টি ভালোবাসে না এমন লোক পাওয়া মুশকিল। বৃষ্টিতে ভিজে আবেগে মথিত হয় হৃদয়। শরীর হয় পুলকিত। বৃষ্টি নিয়ে কত শত স্মৃতির জমিন তৈরি হয়েছে হৃদয়পটে তার হিসেব নেই। বৃষ্টির আনন্দ বেশি থাকে শৈশবে। আসমান কালো করলেই হলো। দৌড়ে বাইরে যেতে আকুল হয়ে ওঠে মন। তারপর খালি গায়ে ঘুরাঘুরি। গাছ তলায় আম কুড়ানো। বৃষ্টির পানিতে ধান ক্ষেত ডুবে গেলেই কলা গাছের ভেলায় চড়ে সারাদিন পার করা। কিংবা মাছ ধরার গল্প তো স্মৃতিপটে জমে আছে সব বাঙালির। শৈশবের বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় শিহরিত হয় মন। অজানা আবেগে বাঁধভাঙা উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে মনের অজান্তেই। তবে বিপত্তিও আছে। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে জ্বর হতে পারে। এ জন্য সবসময় মায়েরা নিষেধ করেন বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু অবুঝ মন কি আর সে বারণ মানে। সবকিছু উল্টে দিতে চায়।

তাই তো ছন্দে ছন্দে আল মাহমুদ লিখেছেন
বই খুলে সে কাল পেয়েছে কেয়া ফুলের নাম
বর্ষা ঋতুর ফুল নাকিগো গন্ধে মাতায় গ্রাম
ফুলটাও চাই গন্ধও চাই এইতো আষাঢ় মাস
শহরটাকে গ্রাম করে দাও সিমেন্ট ভেঙে ঘাস।


আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি যেন নতুন অতিথি। সে আসে নতুনত্ব নিয়ে। আসে পুরাতনের পুঞ্জিভূত রূপ নিয়েও। তাই সে কখনো চিরনতুন আবার কখনো চিরপুরাতন। আমাদের পরিচিত এই পৃথিবী আমাদেরই ব্যবহার দ্বারা এত সীমাবদ্ধ, এত মলিন হয়ে ওঠে। আমরা তার ভেতর কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাই না। কোনো সৌন্দর্য রাখি না। কিন্তু আষাঢ়ের প্রথম মেঘ সেই নতুন পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই আদি-অনন্তকাল থেকেই আষাঢ়ের এই রূপ বাংলা প্রকৃতির কাছে চিরচেনা। তুমুল বৃষ্টিধারা, নদীমাতৃক দেশের নদীর পূর্ণ যৌবন, নদীকূলের ভাঙাগড়া সবই বাঙালির রক্তের সঙ্গে যেন মিশে আছে। আসলে বৃষ্টির কাছে আবদার সবার একটু বেশিই। এর সাথে যদি যোগ হয় গাছের সবুজ, নদীর ঢেউ আর মাঝির গান তাহলে তো ষোলকলা পূর্ণ! তাই তো বৃষ্টিমুগ্ধ কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন

নববর্ষার জলে আবগাহি কভু পুলকিত মনে
গান গাহিয়াছি মাল্লার রাগে বাদলের ধারা সনে।


আষাঢ় আমাদের জন্য আনে আশীর্বাদ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ যখন ফসলি জমিন করে চৌচির। তখনই বৃষ্টিধারা নামে আকাশ থেকে। মাটিকে করে শীতল। চাষযোগ্য করে অনাবাদি ফসলে মাঠ। কৃষকের মুখে আনে আনন্দের হাসি। বাংলার প্রকৃতির এই সবুজ-শ্যামল রূপ তা তো বর্ষারই দান। বাংলার চিরচেনা সবুজ রূপকে সত্যি করতে আর কৃষকের ফসল বোনার স্বপ্নকে সফল করতেই বর্ষা আসে। এ ঋতুতে আরো ফোটে কিছু ফুল। কদম, কেয়া, নয়নতারা, খালবিলে শাপলা, শালুক আরো নাম না জানা কতো ফুল। আর কদম ফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের অনুষঙ্গ থাকে এই আষাঢ়েই। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায় ওঠে এসেছে এসব ফুলের কথা

রিমঝিম রিমঝিম ওই নামিল দেয়া
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া
ঝিলে শাপলা, কমল
ওই মেলিল দল
মেঘ অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া।




বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় থাকে এক মায়াময় খেলা। যাতে হারিয়ে যায় সবার মন। কবিগুরু লিখেছেন

বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছোট্টবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।


বৃষ্টি যে কেবল শিশুদেরই আনন্দ দেয় এমন নয়। বৃষ্টি পাখ-পাখালি আর গাছ-পালাকেও আনন্দে ভাসায়। বৃষ্টি পাখ-পাখালিদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলে। গাছে গাছে আনে ছন্দ। পুরনো পাতা ঝড়ে নতুন পাতা গজায়। ফুল আসে গাছে। আসে ফল। এক অন্যরকম সজীব-সতেজ করে তোলে বৃষ্টির পানি। তেমনটিই পাওয়া যায় কবি ফররুখ আহমদের ছড়ায়

‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।


বর্ষার বিদায়ে বিমর্ষ হয় মন। থেমে যায় বৃষ্টি ভেজার আনন্দ। ভেলায় চরার সাদ। এমনটাই টের পেয়েছেন জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম। আবার তিনি নিজেও ব্যথিত হয়েছেন বর্ষার বিদায়ে।

তার ছড়ায় ওঠে এসেছে এমনই অভিব্যাক্তি
সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকি উঠ না কবরী উঠে না দুলি!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদি অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!


আবার বৃষ্টির নেতিবাচক ফলও রয়েছে আমাদের সমাজে। বিশেষ করে রাস্তায় যাদের বসবাস। কিংবা ভালো একটি বাড়িও নেই যাদের। খড়ের ছাউনি বেয়ে পড়ে পানির ধারা। তাদের কাপালে বৃষ্টি আনন্দের চেয়ে কষ্টদায়কই হয়ে ওঠে। কবি জসিমউদিদন বলেছেন সেই কথা

বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি
একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।


বৃষ্টির পানি কেবল আনন্দের জন্য নয়। বৃষ্টির পানি অনেক উপকারী। আল্লাহর দান এ বৃষ্টির পানি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা জমিনে সর্বপ্রকার শস্য ও ফসল উৎপাদিত করি।’ সুরা লোকমান
বৃষ্টির পানিতে আছে মানবদেহের রোগ নিরাময়ের অনুষঙ্গ। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। এতে ময়লা আবর্জনা নেই। এই পানি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এটি প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে নদ-নদী, খাল-বিল বা সমুদ্র হতে বাষ্প হওয়ার মাধ্যমে পানি যখন জলীয় বাষ্প হয়ে ওপরে ওঠে যায়, তখন পানি ময়লা-আবর্জনামুক্ত হয়ে যায়। এই জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় মেঘ। পরে মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি হয় তখন বিশুদ্ধ পানি ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়।
ভূ-গর্ভস্থ পানি আসলে বৃষ্টির-ই পানি যা আল্লাহ ভূ-গর্ভে সংরক্ষণ করেন। সে ভূ-গর্ভস্থ পানি মাটির প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে স্রোতাকারে প্রবাহিত হয় এবং সে স্রোতের উচ্চতা উঠানামা করে। আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি পরিমিতভাবে, এরপর তা মাটিতে সংরক্ষণ করি।’ সুরা- মু’মিনুন
বৃষ্টি ছন্দময় হোক জীবনে। বৃষ্টির পানি হোক উপকারী। উপকার করুক সবার। সেই কামনা আজকের বৃষ্টিমুখর দিনে।


শিশু-কিশোর পত্রিকা নকীব জুলাই১২ সংখ্যায় প্রকাশিত...

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:৩৮
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×