আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। বৃষ্টির মাস। সদ্য বিদায়ী গ্রীষ্ম থেকে হাফ ছাড়ে মানুষ। নতুন উদ্যম আনে কাজে। গায়ে গতরে আসে ভিন্নতা। সারাদিন বর্ষণে ক্লান্ত হয় আকাশ। রুক্ষ হয় বাতাস। কিন্তু বর্ষার ক্লান্তি নেই। ‘যতটা গর্জে ততটাই বর্ষানো’ তার কাজ। আষাঢ় মাসে বর্ষা হাজির হলেও এর আমেজ থাকে আরো আগে। গাছে গাছে আসে নতুন পাতা। নতুন কুড়ি। জীবনের গতিধারায় আনে পরিবর্তনের ছন্দ। মানুষও পুরনো দু:খ ভুলে নেচে ওঠে বৃষ্টির ছাঁচে।
এ দেশের মানুষ বৃষ্টির জন্য আনন্দিত। বৃষ্টি ভালোবাসে না এমন লোক পাওয়া মুশকিল। বৃষ্টিতে ভিজে আবেগে মথিত হয় হৃদয়। শরীর হয় পুলকিত। বৃষ্টি নিয়ে কত শত স্মৃতির জমিন তৈরি হয়েছে হৃদয়পটে তার হিসেব নেই। বৃষ্টির আনন্দ বেশি থাকে শৈশবে। আসমান কালো করলেই হলো। দৌড়ে বাইরে যেতে আকুল হয়ে ওঠে মন। তারপর খালি গায়ে ঘুরাঘুরি। গাছ তলায় আম কুড়ানো। বৃষ্টির পানিতে ধান ক্ষেত ডুবে গেলেই কলা গাছের ভেলায় চড়ে সারাদিন পার করা। কিংবা মাছ ধরার গল্প তো স্মৃতিপটে জমে আছে সব বাঙালির। শৈশবের বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় শিহরিত হয় মন। অজানা আবেগে বাঁধভাঙা উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে মনের অজান্তেই। তবে বিপত্তিও আছে। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে জ্বর হতে পারে। এ জন্য সবসময় মায়েরা নিষেধ করেন বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু অবুঝ মন কি আর সে বারণ মানে। সবকিছু উল্টে দিতে চায়।
তাই তো ছন্দে ছন্দে আল মাহমুদ লিখেছেন
বই খুলে সে কাল পেয়েছে কেয়া ফুলের নাম
বর্ষা ঋতুর ফুল নাকিগো গন্ধে মাতায় গ্রাম
ফুলটাও চাই গন্ধও চাই এইতো আষাঢ় মাস
শহরটাকে গ্রাম করে দাও সিমেন্ট ভেঙে ঘাস।
আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি যেন নতুন অতিথি। সে আসে নতুনত্ব নিয়ে। আসে পুরাতনের পুঞ্জিভূত রূপ নিয়েও। তাই সে কখনো চিরনতুন আবার কখনো চিরপুরাতন। আমাদের পরিচিত এই পৃথিবী আমাদেরই ব্যবহার দ্বারা এত সীমাবদ্ধ, এত মলিন হয়ে ওঠে। আমরা তার ভেতর কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাই না। কোনো সৌন্দর্য রাখি না। কিন্তু আষাঢ়ের প্রথম মেঘ সেই নতুন পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই আদি-অনন্তকাল থেকেই আষাঢ়ের এই রূপ বাংলা প্রকৃতির কাছে চিরচেনা। তুমুল বৃষ্টিধারা, নদীমাতৃক দেশের নদীর পূর্ণ যৌবন, নদীকূলের ভাঙাগড়া সবই বাঙালির রক্তের সঙ্গে যেন মিশে আছে। আসলে বৃষ্টির কাছে আবদার সবার একটু বেশিই। এর সাথে যদি যোগ হয় গাছের সবুজ, নদীর ঢেউ আর মাঝির গান তাহলে তো ষোলকলা পূর্ণ! তাই তো বৃষ্টিমুগ্ধ কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন
নববর্ষার জলে আবগাহি কভু পুলকিত মনে
গান গাহিয়াছি মাল্লার রাগে বাদলের ধারা সনে।
আষাঢ় আমাদের জন্য আনে আশীর্বাদ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ যখন ফসলি জমিন করে চৌচির। তখনই বৃষ্টিধারা নামে আকাশ থেকে। মাটিকে করে শীতল। চাষযোগ্য করে অনাবাদি ফসলে মাঠ। কৃষকের মুখে আনে আনন্দের হাসি। বাংলার প্রকৃতির এই সবুজ-শ্যামল রূপ তা তো বর্ষারই দান। বাংলার চিরচেনা সবুজ রূপকে সত্যি করতে আর কৃষকের ফসল বোনার স্বপ্নকে সফল করতেই বর্ষা আসে। এ ঋতুতে আরো ফোটে কিছু ফুল। কদম, কেয়া, নয়নতারা, খালবিলে শাপলা, শালুক আরো নাম না জানা কতো ফুল। আর কদম ফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের অনুষঙ্গ থাকে এই আষাঢ়েই। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায় ওঠে এসেছে এসব ফুলের কথা
রিমঝিম রিমঝিম ওই নামিল দেয়া
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া
ঝিলে শাপলা, কমল
ওই মেলিল দল
মেঘ অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া।
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় থাকে এক মায়াময় খেলা। যাতে হারিয়ে যায় সবার মন। কবিগুরু লিখেছেন
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছোট্টবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।
বৃষ্টি যে কেবল শিশুদেরই আনন্দ দেয় এমন নয়। বৃষ্টি পাখ-পাখালি আর গাছ-পালাকেও আনন্দে ভাসায়। বৃষ্টি পাখ-পাখালিদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলে। গাছে গাছে আনে ছন্দ। পুরনো পাতা ঝড়ে নতুন পাতা গজায়। ফুল আসে গাছে। আসে ফল। এক অন্যরকম সজীব-সতেজ করে তোলে বৃষ্টির পানি। তেমনটিই পাওয়া যায় কবি ফররুখ আহমদের ছড়ায়
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
বর্ষার বিদায়ে বিমর্ষ হয় মন। থেমে যায় বৃষ্টি ভেজার আনন্দ। ভেলায় চরার সাদ। এমনটাই টের পেয়েছেন জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম। আবার তিনি নিজেও ব্যথিত হয়েছেন বর্ষার বিদায়ে।
তার ছড়ায় ওঠে এসেছে এমনই অভিব্যাক্তি
সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকি উঠ না কবরী উঠে না দুলি!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদি অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!
আবার বৃষ্টির নেতিবাচক ফলও রয়েছে আমাদের সমাজে। বিশেষ করে রাস্তায় যাদের বসবাস। কিংবা ভালো একটি বাড়িও নেই যাদের। খড়ের ছাউনি বেয়ে পড়ে পানির ধারা। তাদের কাপালে বৃষ্টি আনন্দের চেয়ে কষ্টদায়কই হয়ে ওঠে। কবি জসিমউদিদন বলেছেন সেই কথা
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি
একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।
বৃষ্টির পানি কেবল আনন্দের জন্য নয়। বৃষ্টির পানি অনেক উপকারী। আল্লাহর দান এ বৃষ্টির পানি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা জমিনে সর্বপ্রকার শস্য ও ফসল উৎপাদিত করি।’ সুরা লোকমান
বৃষ্টির পানিতে আছে মানবদেহের রোগ নিরাময়ের অনুষঙ্গ। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। এতে ময়লা আবর্জনা নেই। এই পানি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এটি প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে নদ-নদী, খাল-বিল বা সমুদ্র হতে বাষ্প হওয়ার মাধ্যমে পানি যখন জলীয় বাষ্প হয়ে ওপরে ওঠে যায়, তখন পানি ময়লা-আবর্জনামুক্ত হয়ে যায়। এই জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় মেঘ। পরে মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি হয় তখন বিশুদ্ধ পানি ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়।
ভূ-গর্ভস্থ পানি আসলে বৃষ্টির-ই পানি যা আল্লাহ ভূ-গর্ভে সংরক্ষণ করেন। সে ভূ-গর্ভস্থ পানি মাটির প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে স্রোতাকারে প্রবাহিত হয় এবং সে স্রোতের উচ্চতা উঠানামা করে। আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি পরিমিতভাবে, এরপর তা মাটিতে সংরক্ষণ করি।’ সুরা- মু’মিনুন
বৃষ্টি ছন্দময় হোক জীবনে। বৃষ্টির পানি হোক উপকারী। উপকার করুক সবার। সেই কামনা আজকের বৃষ্টিমুখর দিনে।
শিশু-কিশোর পত্রিকা নকীব জুলাই১২ সংখ্যায় প্রকাশিত...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:৩৮