ক্যান্সার: জানার আছে অনেক কিছু পর্ব-২
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভিতিকর রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্যান্সার। আর আমাদের বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যান্সার আগামী দিনগুলোতে খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এর দুটি আরণ আছে একটি হলো আমরা ক্যান্সার সম্পর্কে অসচেতন এবং এর চিকিৎসা ব্যয় বহন করার ক্ষমতা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই নেই। আমি পর্ব-১ এ শুধু মাত্র ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এ পর্বে কারণ গুলো নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।
সাধারণত ৯৫% ক্যান্সারের জন্য আমাদের পরিবেশ দায়ী অর্থাৎ environmental factors আর ৫% ক্যান্সার রোগ হলো বংশগতির সাথে সম্পর্কিত। কমন এনভাইরনমেন্টাল ফ্যাক্টর গুলো হলো তামাক (২৫-৩০%), খাদ্য ও স্থুলতা (৩০-৩৫%), সংক্রমন (১৫-২০%), রেডিয়েশন/তেজস্ক্রিয়তা ১০%, তাছাড়াও স্ট্রেস এবং অন্যান্য পরিবেশ দূষক দায়ী।
তবে এটা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব যে ঠিক কোন কারণে একজন ব্যক্তির ক্যান্সার হয়েছে। মূলত একজন ব্যক্তির ক্যান্সার হওয়ার পিছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে।
১. রাসায়নিক বস্ত বা কেমিক্যালসঃ
ক্যান্সার রোগের ক্রমবিকাশ/ডেভেলপমেন্ট জানার জন্য মূলত জানা দরকার কোন ডিএনএ মিউটেশনটি সেলের বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক এবং মেটাস্ট্যাটিস পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যে সকল পদার্থ মিউটেশন ঘটায় তাদেরকে ইংরেজীতে বলা মিউটাজেন (mutagen) আর যে সকল mutagen ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী তাদেরকে বলা হয় কারসিনোজেন carcinogen. আবার সকল কার্সিনোজেনই কিন্ত মিউটাজেন নয়। নির্দিষ্ট প্রকারের ক্যান্সারের জন্য নির্দিষ্ট প্রকারের পদার্থ/বস্তু/ সাবস্ট্যান্স দায়ী। যেমন তামাক বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারের জন্য দায়ী এবং ৯০% ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তামাকের সাথে ফুসফুসসহ অন্যান্য ক্যান্সারের সম্পর্ক প্রায় কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে চলেছেন। তামাকের ধোয়া ৫০ এরও অধিক কার্সিনোজেন বহন করে যেমন- নাইট্রোসামিনস, পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রো কার্বন। উন্নত বিশ্বের প্রতি ৩ জন মারা যাওয়া ক্যান্সার রোগীর মধ্যে ১ জন তামাক দ্বারা আকান্ত রোগী। যুক্তরাষ্টে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী ধুমপায়ীদের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলার সাথে সাথে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে চলছে।
২. ডায়েট/খাদ্য এবং ব্যায়ামঃ
খাদ্য, শারীরিক অকর্মন্যতা এবং স্থূলতা প্রায় ৩০-৩৫% ক্যান্সারের জন্য দায়ী। অতিরিক্ত দৈহিক ওজন বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী এবং যুক্তরাষ্টে প্রায় ১৪-২০% ক্যান্সার মৃত্যুর স্থূলতা দায়ী। ডায়েটের কারণে যে ক্যান্সার হয় তার অর্ধেকের বেশী মূলত অতিরিক্ত পুষ্টি/খাবারের কারণে হয়ে থাকে। যে সকল খাবারে শাক-সবজি, ফলমুল ও দানাদার খাদ্যের পরিবর্তে অধিক প্রসেস ফুড থাকে সেগুলোও বিভিন্ন ক্যান্সারের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে হাই সল্ট ফুড গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের সাথে, আফলাটক্সিন বি১, কমন ফুড কনটামিনান্ট লিবার ক্যান্সারের সাথে, বিটেল নাট চিবানো ওরাল ক্যান্সারের সাথে সম্পৃকক্ত।
৩. সংক্রমন বা ইনফেকশনঃ
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৮% ক্যান্সার মৃত্যু কোনো কোনভাবে সংক্রমক রোগের সাথে সম্পৃক্ত। ভাইরাসগুলোই মূলত ক্যান্সারের সংক্রমন ঘটায় তবে ব্যাক্টেরিয় ও পরজীবিও ক্যান্সারের সংক্রমন ঘটাতে পারে। যে সকল বাইরাস ক্যান্সার রোগ সৃস্টি করে তাদেরকে অনকোভাইরাস বলে।যেমন, human papillomavirus (cervical carcinoma), Epstein–Barr virus (B-cell lympho proliferative disease and nasopharyngeal carcinoma), Kaposi's sarcoma herpes virus (Kaposi's sarcoma and primary effusion lymphomas), hepatitis B and hepatitis C viruses (hepatocellular carcinoma), and Human T-cell leukemia virus-1 (T-cell leukemia).
৪.রেডিয়েশন/বিকিরণ/ তেজস্ক্রিয়তাঃ
প্রায় ১০ শতাংশ ক্যান্সার রেডিয়েশন এক্সপোজারের কারণে হয়ে থাকে। আয়নাইজিং রেডিয়েশন বা ননআয়নাইজিং আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনই ক্যান্সারের সাথে সম্পৃক্ত। অধিকাংম নন মেলানোমা নন ইনভেসিব স্কীন ক্যান্সার ননআয়নাইজিং আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের কারণে হয়ে থাকে। রেডিয়েশন যেকোন বয়সের প্রাণীর শরীরের প্রায় সকল অংশেই ক্যান্সার ঘটাতে পারে। রেডিয়েশন এর অন্যতম উৎস হলো মেডিক্যাল ইমেজিং ও রেডন গ্যাস। তবে রেডিয়েশনের মাধ্যমে ক্যান্সার হলে তা পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেতে ক্যান্সারের ধরণভেদে বিভিন্ন সময় লাগতে পারে।যেমন সলিড টিউমার হতে প্রায় ১০-১৫ বছর লাগতে পারে। আয়নাইজিং রেডিয়েশন কোষের ভিতর র্যান্ডম মিউটেশন ঘটায়।ক্রোমোজোম ভেঙ্গে ফেলতে পারে যার ফলে কোষে ক্রোমোজমের সংখ্যার পরিবর্তন হয়ে যায়, এক বা একাধিক জিনকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিএনএ সিকুয়্যেন্স বাদ দিতে পারে, ক্রোমোজমাল ট্রান্সলোকেশন ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের অ্যাবনরমালিটি তৈরী করে। এসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু সময় কোষের মৃত্যু ঘটে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষত যদি টিউমার সাপ্রেসর জিন নিষ্ক্রিয় হয় তখন অবশ্যই টিউমার গঠন করবে। আয়নাইজিং রেডিয়েশন এর মাধ্যমে ক্যান্সার হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি স্বাধীন ধাপ রয়েছে (ক) কোষের মরফলজিক্যাল পরিবর্তন (খ) কোষের অমরত্ব লাভ ও (গ) টিউমার গঠনের জন্য অভিযোজন। একটি রিপোর্টের তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পাদিত ৭ মিলিয়ন সিটি স্ক্যান ২৯০০০ জনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। অন্য আরেকটি তথ্যমতে ২০০৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের ০.৪% ক্যান্সার রোগী সিটি স্ক্যান দ্বারা আক্রান্ত যেটা কিনা ১.৫-২% পৌঁছাতে পারে। দীর্ঘক্ষণ সুর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে মেলানোমাসহ অন্যান্য স্কীন ক্যান্সার হতে পারে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে মোবাইল ফোন, বৈদ্যুতিক পাওয়ার ট্রান্সমিশনসহ একই ধরণের উৎস থেকে বিকিরিত নন আয়নাইজিং রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।
৫. বংশগতিঃ
পূর্বেই বলেছি মাত্র ৫ শতাংশ ক্যান্সার বংশগত কারণে হয়ে থাকে। ০.৩% এরও কম মানুষ জেনেটিক ডিফেক্ট বহন করে যা কিনা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। যে দুটি জিন ক্যান্সার তৈরীর জন্য দায়ী সেগুলো হলো বিআরসিএ১ ও বিআরসিএ২।
৬. ফিজিক্যাল এজেন্টঃ
কিছু বস্ত/পদার্থ তাদের রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিবর্তে ফিজিক্যাল এফেক্ট এর মাধ্যেমে কোষের ক্যান্সার ঘটাতে পারে। এবেসটস একধরণের প্রাকৃতিক ফাইবার বা তন্ত যা সেরস মেমব্রেনের মেসোথেলমিয়া ক্যান্সারের জন্য দায়ী। নন ফাইব্রাস পদার্থ যেমন কোবাল্ট, নিকেল, ক্রিস্টালাইন সিলিকা ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত ফিজিক্যাল কার্সিনোজেন দেহে প্রবেশের পর ক্যান্সার ঘটাতে কয়েক বছর লেগে যায়। তবে ফিজিক্যাল ট্রমা ক্যান্সারের জন্য দায়ী একথাটা এখনও জোরালোভাবে গৃহীত নয়।
৭. হরমোন
কিছু কিছু হরমোন কোষের বৃদ্ধিতে সহযোগীতা করার মাধ্যমে ক্যান্সার তৈরীতে অবদান রাখে। যেমন- ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর ও তাদের বাইন্ডিং প্রোটিন ক্যান্সার তৈরী ও কার্সিনোজেনেসিস এ ভুমিকা পালন করে। সেক্স সম্পর্কিত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হরমোন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট, ওভারি, টেস্টিস ক্যান্সার। এছাড়াও থাইরয়েড ও বোন ক্যান্সারে হরমোনের প্রভাব রয়েছে। যেমন যে সকল মায়ের স্তন ক্যান্সার আছে তাদের কন্যাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এজন্যই কিন্ত গত বছর হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি তার নিজের স্তন অপসারণ করে ফেলেছেন।