বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করার বিরুদ্ধে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিভিন্ন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রেডিও তেহরান কথা বলেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি'র সাথে ।
রেডিও তেহরান : বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করার বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনেকেই বিষোদগার করে চলেছেন। কিছুদিন আগে ডেপুটি স্পিকার এর সমালোচনা করেছেন , আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ এর মধ্যে কয়েকবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন । তো আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি , ৮৫ পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়াটাকে এত নেতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে কেন?
রাশেদ খান মেনন : তার কারণ হিসেবে আমি প্রথমত বলবো যে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না । আমরা মনে করি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি । এর আগে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল সে প্রচেষ্টা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশে যেমন ৮৫ পার্সেন্ট মুসলমান আছে পাশাপাশি ১৫ পার্সেন্ট অন্যান্য ধর্মের মানুষ রয়েছে । যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয় তাহলে অন্যান্য ধর্মের মানুষ কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে । আর তৃতীয়ত হচ্ছে, বাংলাদেশের ভিত্তিটাই ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক । আর এ অসাম্প্রদায়িকতা ছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে । কারণ পাকিস্তান একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল । আর সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভিত্তির সাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের ঘোষণাটি একটি সাংঘর্ষিক বিষয় । বর্তমান সরকারের সময় আমরা বলছি বাংলাদেশ হবে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ । এটি কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় । সুতরাং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ধর্মীয় আবরণ দেয়াকে আমরা সমর্থন করি না এবং তার অবকাশ এখানে নেই ।
রেডিও তেহরান : আচ্ছা জনাব রাশেদ খান মেনন, আইনমন্ত্রী বলতে চাচ্ছেন , রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার কারণেই জঙ্গীবাদ শক্তিশালী হচ্ছে । তো আইনমন্ত্রীর এ ধরনের বিশ্বাস বা মানসিকতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি ?
রাশেদ খান মেনন : আমরা মনে করি এটা হওয়ার কারণেই জঙ্গীবাদ শক্তিশালী হচ্ছে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে অনেকে উৎসাহিত হয়েছেন । এর প্রথম যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৫ সাল পরবর্তীকালে যখন ধর্মের নামে রাজনীতিকে পারমিট করা হয় তখন থেকে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মধ্য দিয়ে এর স্বীকৃতি দেয়া হয় । যে কারণে আজ আমরা দেখবো রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় চলে এসেছে যা অন্য কোনো সময় সম্ভব ছিল না বা হতে পারেনি । যেমন এ প্রসঙ্গে বলা যায় - ব্লাসফেমী আইনের কথা । রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে বলেই আজ ব্লাসফেমী আইনের কথা বলতে পারছে ; রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে বলেই সংখ্যালঘুদেরকে আলাদা করে দেখার একটা জায়গা তৈরী হয়েছে। সংখ্যালঘুদেরকে পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে অনেকটা জিম্মি করে রাখার সুযোগ এখানে রয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সংহতি এবং ঐক্যকে বিনষ্ট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পরহেজগার , নামাজী এবং রোজা রাখেন ; ধর্ম পালন করেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই । যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল না তখনও এদেশের মানুষ মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত ছিল এবং তারা ধর্মীয় সবকিছু পালন করেছে । সুতরাং যে মানুষ অতীতে এতকাল ধরে ধর্ম পালন করে এসেছে রাষ্ট্রীয় পরিচয়বিহীনভাবে সেক্ষেত্রে আজ কেন এই পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে ।
রেডিও তেহরান : ১৯৮২ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । তো এখানে কিন্তু একটি প্রশ্ন চলে আসে , তাহলে ৮২ সালের আগে বা তারও আগে কি বাংলাদেশে কোনো উগ্রবাদী সন্ত্রাসী তৎপরতা ছিল না ?
রাশেদ খান মেনন : হ্যাঁ ছিল । বিভিন্ন ইজমের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা বা উগ্রবাদী তৎপরতা ছিল । তবে এভাবে ছিল না । রাষ্ট্রধর্ম সংযোজিত হওয়ার পর ধর্মীয় উগ্রবাদী তৎপরতা এসেছে । আর এ ধর্মীয় উগ্রবাদী তৎপরতা মূলত শুরু হয়েছে ১৯৮০ দশকের শেষভাগ থেকে । মূলত: আফগান যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং পাক গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই মিলে যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরী করেছে এবং সেখানে যে যুদ্ধ চলছে সে সময় থেকে এ ধরনের জঙ্গীবাদী তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করছি।
রেডিও তেহরান : জনাব রাশেদ খান মেনন, কেউ কেউ বলছেন আইনমন্ত্রী রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে বিরুপ মন্তব্য করে বাস্তবে তিনি ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে আবস্থান নিয়েছেন । এ সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন ?
রাশেদ খান মেনন : রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে বলে আমার মনে হয় না । কারণ আমাদের দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কখনই ধর্মীয় অনুভূতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি । এটি হয়েছে রাজনৈতিক কারণে । বাংলাদেশের চরম সুবিধাবাদী প্রেসিডেন্ট ও রাজনীতিক এবং স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের মতো একজন ব্যক্তির দ্বারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়েছে । সুতরাং ধর্মীয় ভীরুতা বা ধর্মের প্রতি আনুগত্যের কারণে এটি হয়েছে তা প্রমাণ করে না । ফলে রাষ্ট্রধর্মের বিরোধীতা করা বাংলাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে বা লেগেছে বলে আমার মনে হয় না । আপনাকে এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় আমি জানাচ্ছি । স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করায় সেসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল এর বিরুদ্ধে সফল হরতাল পালন করেছিল। বিএনপি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলে যে সরকার চালিয়েছে তারা আজ যদি এর বিরুদ্ধে কথা বলে তো সেটি কেমন হবে ! ফলে আইনমন্ত্রীর রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান বা কথা এদেশের জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে এ কথাটি ঠিক নয় ।
রেডিও তেহরান : ইসলাম ধর্ম অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেয় । অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক । এদেশে কখনো গুজরাট বা বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মত কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় নি । বাংলাদেশের প্রতিবেশি এমন দেশও আছে যেখানে প্রায় প্রতি মাসেই সাম্প্রদায়িক হাংগামা বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে । মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ সত্যিই এর ব্যতিক্রম । তারপরও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের অনেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের ব্যাপারে বিষোদগার করছেন, এ বিষয়টিকে বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ কিভাবে মূল্যায়ন করবে বলে আপনি মনে করেন ?
রাশদ খান মেনন : ইসলাম সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দেয় না একথা নি:সন্দেহে সত্য । কিন্তু তাতে বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক একথায় সন্দেহ থেকে যায় । কারণ বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক কনসেপ্টের ভিত্তিতে । ফলে সো কলড রাষ্ট্র ধর্মের নাম দিয়ে বা ধর্মীয় করণের নাম দিয়ে যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরী করেছে তারাই সাম্প্রদায়িক এবং জঙ্গীবাদের উদ্যোক্তা । এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক আছে । এখানে দুটো ইসলাম । একটি হচ্ছে রাজনীতির ইসলাম , আর অন্যটি হচ্ছে ধর্মের ইসলাম । বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের ইসলামকে পছন্দ করে ; রাজনীতির ইসলামকে পছন্দ করে না ।
রেডিও তেহরান : রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষের দলগুলো যেমন জাতীয় পার্টি , বিএনপিতে অনেক অমুসলিম নেতা রয়েছে । এই দল দুটির অমুসলিম সমর্থকের সংখ্যাও কম নয় । তারপরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টিকে সমর্থন করার জন্য এই দল দুটিকে কি সাম্প্রদায়িক বলা যাবে কি ?
রাশেদ খান মেনন : আপনার প্রশ্নের সাথে পুরোপুরি আমি একমত নই । আপনি যে বল্লেন বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষের দল একথাটি ঠিক নয় । হ্যা জাতীয় পার্টি এটি করেছিল তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের সাথে একজোট হয়ে হরতাল করেছিল । তবে একথাটি ঠিক এ দুটি দল সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহিত করে । দল দুটির বিরুদ্ধে এ অভিযোগে কোনো সন্দেহ নেই । আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশয় দেয়া নি:সন্দেহে ইতিবাচক নয় ; নেতিবাচক একটি বিষয় । #
তথ্য সূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১০:৪২