প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এখনো চীন সফরে রয়েছেন। চীন সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক হাইপ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সাসেক্সফুল সফর আর কোনো দলের সরকার প্রধান করতে পারেন নাই। এই সফরের পর প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতা সারজিস আলম উনাকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যে সফর নিয়ে এত মাতামাতি স্বাভাবিক ভাবে মনে কৌতুহল জাগে আসলে কি স্মরণকালের সেরা সফর ছিলো বাংলাদেশের জন্য ?
প্রধান উপদেষ্টা চীনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'বোয়িও'র আমন্ত্রণে চীনে গিয়েছেন। চীনের প্রধান নেতা শি জিন পিং এর সাথে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাত হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি ও আটটি সমঝোতা স্মারক(mou) সম্পাদিত হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে মোট ২.১ বিলিয়ন ডলার লোন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মংলা বন্দরের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন, চায়না ইকোনমিক জোনের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন, ও প্রযুক্তি খাতে ১৫০ মিলিয়ন দেয়ার কথা হয়েছে। এলডিসি গ্রাজুয়েট হলে চায়না ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশ তাইওয়ান ইস্যুতে এক চীন নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তিস্তা প্রজেক্ট নিয়ে তেমন আলোচনা হয় নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধান উপদেষ্টা চীন কে সহায়তার জন্য আহবান জানালেও চীনের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। চারটি জাহাজ নির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে চীন বাংলাদেশ কে সহায়তা দিবে। বাংলাদেশ থেকে আম কাঠাল চীনে বেশি বেশি রপ্তানির জন্য শি জিন পিং আহবান জানিয়েছেন।
চীনের লোন, অনুদান প্রতিশ্রুতির অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয় । চীনের অর্থছাড় করার প্রক্রিয়া খুবই ধীর। তাছাড়া চীন যেসব প্রকল্পের জন্য অর্থছাড় দেয় সেখানে শর্ত থাকে খুবই কঠিন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চীন তার প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র নয় শতাংশ ছাড় দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে চীনের অর্থছাড় বন্ধ আছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরের পূর্বে গতমাসে পররাষ্ট্র পর্যায়ের বৈঠকে চীন সম্মতি জানিয়েছিল লোন শোধের পিরিয়ড বিশ বছর থেকে পিছিয়ে ত্রিশ বছর করার জন্য। চীনের দেরিতে অর্থছাড়ের কারণে অনেক সময় কোনো প্রকল্পের জন্য প্রাপ্ত পুরো অর্থ পেতে সময় বেশি লাগে। এতে লোন শোধের জন্য কম সময় পাওয়া যায়। প্রধান উপদেষ্টার সফরে চীন এই ব্যাপারে কিছুই বলে নাই । অন্যদিকে লোনের সুদের পারসেন্টেজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় ২/৩ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য। চীনের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারেও ক্লিয়ার কাট কোনো সাড়া মেলে নি।
এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও চীন ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়ার ঘোষণায় বাংলাদেশে বেশ হইচই পড়ে গেছে। আসল বাস্তবতা হলো চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের কম মূল্যের পণ্য চীনে রপ্তানি করে। ২০২২ সাল থেকে চীন একটি নিদিষ্ট পরিমাণ কোয়ান্টিটির পণ্যের জন্য নিরানব্বই ভাগ শুল্ক ছাড় দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের এতে করে রপ্তানি বাড়েনি কারণ রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য পোশাক চীনে যায় না। তাই ইউরোপে শুল্ক মুক্ত হলে যেমন সুবিধা পাওয়া যায় চায়নার ক্ষেত্রে তেমনটা পাওয়া যায় না।
চীনের প্রধান নেতা শি জিন পিং বাংলাদেশ থেকে প্রচুর আম কাঠাল রপ্তানির জন্য আহবান জানিয়েছেন। সাধারণত বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয় সেগুলোর প্রধান ভোক্তা প্রবাসীরা। চীনে এখন বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বাংলাদেশের। এসব আম, কাঠাল ও চিপসসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রধান ক্রেতা তারাই হবেন। হালাল খাবার হিসাবেও প্রবাসীরা বাংলাদেশের পণ্য কিনে থাকেন।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চীন একটি টু শব্দ করে নাই। চীনের মদদে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকানো হয়েছে। একজন মাদার তেরেসা নোবেল পাওয়ার আশায়(আসলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ২০১৮ সালের) চীনের প্রেস্ক্রিপশনে এই কাজ করেছেন। উহা এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে গেছে। চীনের সাথে সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মি উভয়ের ভালো কানেকশান আছে। কিন্তু চীনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় নি।
মংলা বন্দরের দায়িত্ব চীন কে দেয়ার ব্যাপারে যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এইটা কোনো বড়ো ঘটনাই না। লেডি হিটলার হাসিনা চেয়েছিলেন চীনকে মংলা বন্দরের দায়িত্ব দিতে। কিন্তু সবশেষ ভারত সফরের পর এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন। চীন মংলা বন্দরের দায়িত্ব নিতে মরিয়া ছিলো অনেক আগে থেকেই। তাই শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ ছিলো। তাছাড়া প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের আগেই বাংলাদেশ-চীন এগ্রিমেন্ট হয়েছে মংলা বন্দরের ব্যাপারে।
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশ হয়তো ডিফেন্সিভ স্ট্রাটেজি নিচ্ছে তিস্তা প্রকল্পের ব্যাপারে। চীনের পক্ষ থেকে হয়তো অনির্বাচিত সরকারের সাথে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার ইচ্ছা ছিলো না। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন কে সাপোর্ট করা সঠিক হয়েছে কিনা তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরের পূর্বে ভারতে সফরে যেতে চেয়েছিলেন। ভারতের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। বিমসটেক সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাত করতে প্রধান উপদেষ্টা আগ্রহী হলেও সাড়া মেলেনি। এর আগে unga সম্মেলনে দুইজনের মধ্যে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। ভারত তার স্ট্রাটেজি ধরে রেখেছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেছিলেন একমাত্র নির্বাচিত সরকারের সাথে ভারত আলোচনায় বসবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব তাএ সবরকম চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও যদি বরফ না গলে আমাদের কোনো দায় নেই।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর অত্যন্ত সাদামাটা হয়েছে। উনার কোনো চেষ্টার ত্রুটি ছিলো না সফর সফল করার জন্য। কিন্তু তিনি কোনো নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধি নন। তাই বেশি কিছু প্রত্যাশা রাখা যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:০৯