যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ লেখা, সেটা বেশিদিন আগের নয়। বন্ধুদের বাংলায় স্ট্যাটাস দেয়া দেখে এক বন্ধুর তীব্র উষ্মা ভরা এক স্ট্যাটাস। সেখানে লেখা যারা বাংলায় স্ট্যাটাস দেয় তারা নাকি নিজেদের বাঙালিত্ব দেখাবার জন্য বাংলায় স্ট্যাটাস দেয়। আমি নিজেও নিজের প্রায় সব স্ট্যাটাস বাংলায় দেই। সুতরাং সেখানে কিহয় দেখার অপেক্ষায় রইলাম। সে স্ট্যাটাসে কিছুক্ষণের মাঝেই শুরু হল মন্তব্যে মন্তব্যে ইংরেজী হরফে বাংলা স্ট্যাটাস দেওয়ার পক্ষে যুক্তি আর তার বিরুদ্ধে, সেখানে আমি ছিলাম নীরব দর্শক। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল বন্ধুটি সে স্ট্যাটাস মুছে দিয়েছে। সেটা নিজের ভুল বুঝে নাকি মন্তব্যের বাক বিতণ্ডায় বিরক্ত হয়ে সেটা জানার সৌভাগ্য হয়নি। তবে এত অল্পসময়ে বোধোদয় হবার কথা নয় বলেই আমার মনে হয়েছে। সে স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে একটা সময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আসলেই কি আমি মানুষকে আমার বাঙালিত্ব দেখাবার জন্য স্ট্যাটাস দিই? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আজকের এই লেখা।
১৯৫২ সালে কিছু রক্ত টগবগ করা কিছু যুবক কেন ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল? কিংবা ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা দিবস আমরা এত ঘটা করে কেন আয়োজন করি? এ প্রশ্ন দুটো রেখেছিলাম আমার কিছু বন্ধুর কাছে। প্রায় বেশিরভাগ বন্ধুর উত্তর ছিল, প্রথম প্রশ্নের জন্য উত্তর ছিল, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের ভালবাসা ছিল বলে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জন্য, ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য। আসলেই কি কেবল ভাষার প্রতি সম্মান কিংবা কিছু শহীদের প্রতি সম্মান দেখানোই উদ্দেশ্য? অন্তত আমার নিজের কাছে কখনো তা মনে হয়নি।
প্রথম প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, আমরা কি অন্য কোন জাতির চেয়ে কম মেধাবী? আমরা কি পারতাম না ১৯৫২ সালে বাংলার বদলে ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিতে? তখনতো বটেই এখনো আমাদের দেশের একটা বড় অংশ অন্য মাধ্যমে পড়াশোনা করে। সেটা একেবারে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। তবে কেন কিছু যুবকের নিজের ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া? বিলিয়ে দেয়ার কারণ এ ভাষা আমার ভাষা, বাঙালীর ভাষা। এ ভাষা যে শুধু আমাকে নিজের ভাষায় ভাব প্রকাশের সুযোগ করে দেয় শুধু তাই নয়, এ ভাষা আমার আমিত্বকে নিজের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। আমি বাংলায় কথা বলে, লিখে, চিৎকার করে পৃথিবীর কাছে আমার আমিত্বকে জাহির করি। আমি পারতাম না বাংলার বদলে অন্য ভাষায় এমন করে নিজের অস্তিত্বকে পৃথিবীর কাছে নিজেকে জাহির করতে। এ জাহির করা কেবল কোন ভাষাকে জাহির করা নয়, বাঙালী হিসেবেও নিজেকে জাহির করা নয়, আমার আমিকে সবার কাছে জাহির করা। এরপর আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের কথায়। ২১ ফেব্রুয়ারী আজ আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তো বটেই, বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছেও আজ মনে হয় কেবলি আনুষ্ঠানিকতা। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া কিংবা টক শোতে নিজের মুখ দেখানোর মত একটা আলাদা দিন মাত্র। এছাড়াও এ দিন হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা দাবী করবার দিন। তার চেয়েও বড় কথা এ দিন ভাষা শহীদদের গুণকীর্তনের দিন। কিন্তু ভাষা শহীদেরা কি টিভিতে, পত্রপত্রিকায় নিজেদের গুণকীর্তন শোনার আশায় নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন? নাকি নিজের অস্তিত্বের উপর আঘাত দেখে তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন? দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সফলতার সাথে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের নিজেদের অস্তিত্বের মূল খোঁজার আগ্রহ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন টিভিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দেখার চেয়ে চ্যানেল বদলিয়ে মুন্নি বদনাম হুয়ি দেখতে আগ্রহী বেশী। যে প্রজন্মের একটা বড় অংশ আজ বাংলাকে মনে করে কেবলি বাঙালিত্ব দেখানো, সোজা কথায় ভাব দেখানো।
একটা সময় ছিল যখন ইন্টারনেটে বাংলায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করাটা কঠিন ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা দেখতেও অনেক সমস্যা ছিল। এখন এধরনের কোন সমস্যাই নেই। সুতরাং বলা যায় ইন্টারনেটে নিজেকে বাংলায় প্রকাশ করতে কোন বাধা নেই। সেটা ব্লগিং করেই হোক কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই হোক। তাহলে অন্য ভাষার হরফে বাংলা লিখে কেন আমরা আমাদের দৈন্যতার প্রকাশ করব? ইন্টারনেটে বাংলার সহজলভ্যতার কথা অনেকেই এখনো জানে না। তাই আমরা যারা নিয়মিত ব্লগিং করি তারাই এটা শুরু করতে পারি। শুরুটা আমাদের দিয়েই হোক না! কেননা নিজেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে আমি যে শুধু আমার ভাষাকে সম্মান করছি কিংবা ভাষা শহীদদের সম্মান করছি তা তো নয়, বরঞ্চ আমি যে আমার নিজেকেই নিজের আসল মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করছি।