শামসুর রাহমানকে নিয়ে অপপ্রচারের শুরু যখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে নামলো বাঙালী। গোলাম আযমসহ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের গন আদালতে বিচারের জন্য গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। দুটো ফ্রন্টে চলেছে এই অপপ্রচার। একটি (যা ব্লগেও ছাগুরাম ও মুরীদানদের তরফে বহুল প্রচারিত) শামসুর রাহমান তার কবিতায় আজানকে বেশ্যার হাসির সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবির উগ্র জঙ্গীদের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হওয়ার পেছনে একটা বড় ভূমিকা ছিলো এই প্রচারণার। অথচ এই মাতোয়ালা রাইতে কবিতাটিতে সেই অপপ্রচারের কোনো সাক্ষ্যই মেলে না। নেশাতুর এক মাতালের বাড়ি ফেরার পথে প্রলাপে ভরপুর কবিতাটা তুলে দিলাম :
এই মাতোয়ালা রাইত
হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্দা পাও
আবে, কোন মামদির পো সামনে খাড়া? যা কিনার,
দেহস্ না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথথি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।
হগলে আমারে কয় মইফ্যার পোলা, জুম্মনের বাপ
কয় হুস্না বাণুর খসম, বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি
দিয়া কয়, ব্যাপারি তুমি মনের মানু আমার
দিলের হকদার!
আসলি কেউগ্যা আমি, কোনহানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুরিহাট্টা, চানখারপুল, আশকজমাদার লেন
যেইহানেই মকামের ঠিকানা থাউক,
আমি হালায় হেই একই মানু
গুলগাল, মুখে ফুদ্দি দাড়ি, গালে কাঁটা দাগ
যেমুন আধুলি একখান খুব দূর জমানার।
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।
তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কালের মুখ,বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!
শুনুন মাসুদ আখন্দের কণ্ঠে :
দ্বিতীয় অপ্রপচারটিও কম বিষাক্ত নয়। শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানীদের সেবা করেছেন, দালাল ছিলেন, স্বাধীনতার পর ভোল পাল্টেছেন। এটি বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয় সুশান্তর মতো অনেকেই। তারা অবলীলায় কবিকে প্রো পাকিস্তানী বলে গালি দিয়ে বসে। ১৯৭১ সালের ১৭ মে দৈনিক পাকিস্তানে ৫৫জন বুদ্ধিজীবি সাক্ষরিত যে বিবৃতিটি পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজে লাগায় তাতে শামসুর রাহমানের সাক্ষর ছিল না। অথচ আহসান হাবীব, ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হকদের ছিল। এদের বেশীরভাগই বন্দুকের মুখে সই দিয়েছেন। এমনকি সই দিয়েও মরতে হয়েছে মুনীর চৌধুরীকে। সেসময় দৈনিক পাকিস্তানে সাহিত্য পাতা দেখতেন শামসুর রাহমান। সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, যিনি সাক্ষরদাতাদের অন্যতম। অথচ অপপ্রচারে শামসুর রাহমানকেই সম্পাদক বানিয়ে দেয় অনেকে।
বাস্তবে শামসুর রাহমানকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ফরাসি কবি পল এলুয়ার ও লুই আরাগঁর কাতারে অনায়াসেই ফেলা যায়। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে রাজপথে ছিলেন মিছিলে। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে কবি পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন নরসিংদির পাড়াতলী গ্রামের পৈত্রিক ভিটায়। এখানেই রচিত হয় তার অমর দুই সৃষ্টি- স্বাধীনতা তুমি এবং তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা নামে কবিতাদুটোর। জুনে তিনি ফিরে আসেন ঢাকা, যোগ দেন কাজে। কিন্তু কবিতা লেখা থামেনি। সেসব কবিতা কপি হয়ে হাতে হাতে পৌছে যেত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় শামসুর রাহমানের এই অবরূদ্ধ যাপনের অনুভূতি সম্বলিত কিছু কবিতা। আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভূমিকাসহ সেসব কবিতা ছাপা হয়েছিল ছদ্মনামে। মজলুম আদিব বা নির্যাতিত কবি- দিয়েছিলেন আবু সয়ীদ নিজেই। এর একটি তুলে দিচ্ছি নিচে:
বন্দী শিবির থেকে
ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।
বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।
অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।
অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু'চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।
১৯৬৯ সালের কোহিনুর কেমিকেল কোম্পানির একটি ডায়েরিতে লেখা কবিতাগুলোই নিয়ে পরবর্তীতে বের হয় বন্দী শিবির থেকে নামের কাব্যগ্রন্থটি যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ এক লেখচিত্রও বটে। তাকে নিয়ে যে কোনো ধরণের অপপ্রচারে আমাদেরই অপমান, এবং সেগুলো প্রতিহত করা অবশ্যই জরুরী। সবশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কবিকে। তিনি কবিতা হয়েই বেঁচে রইবেন আমাদের মাঝে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও।
কবির নিজের মুখে স্বাধীনতা তুমি :
ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া (শুধু প্রথমটি) বাকিগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহ
কৃতজ্ঞতা : শব্দগুচ্ছ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, লাল দরজা ও শিমুল সালাহউদ্দিন