তুমি আমায় বেঁধেছো বৃত্তের পরিধিতে (প্রথম পর্ব)
“হ্যালো ফ্রেন্ডজ ব্রেকের পর আবার ফিরে এলাম আপনাদের পছন্দের শো “ভালোবাসার গল্প” এর ভ্যালেন্টাইন্স এপিসোড নিয়ে আর সাথে আছি আমি আরজে বিন্দু।
চার চারটা বছর কেটে গেল কিন্তু ভার্সিটি লাইফের একটা পহেলা ফাল্গুনও পালন করা হয়নি দেখে ফ্রেন্ডরা মিলে ঠিক করলাম এবার যেমন করেই হোক আমরা আসছি। অনেক মজার একটা দিন কাটিয়েছিলাম সেদিন। আর দিনটা ছিল আমার জীবনের একটা স্মরনীয় দিন। ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে কখন যে সূয্যি মামা ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন খেয়ালই করিনি। খেয়াল হতেই তরিঘরি করে বিদায় নিয়ে টি.এস.সির মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। একটা রিক্সাও যাবেনা শুনে মেজাজটা চরম বিগড়ে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি করে বিশ্রী অবস্থা।
“বিন্দু। এনিথিং রঙ?” ঘুরে তাকাতেই দেখি বৃত্ত দাঁড়িয়ে আছে। কিসের কি এনিথিং! ওকে দেখে আমার এভরিথিং রঙ হয়ে গেল।
“না মানে...দেখুন না একটা রিক্সাও পাচ্ছিনা। রিক্সাওয়ালারা সব এক-একজন লাটসাহেব হয়ে বসে আছে। বাসায় যাবো কিভাবে সেই চিন্তায় মাথা ঠিক ছিল না। তাই...”
“হাহাহাহা...সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। যদি কোন প্রব্লেম না থাকে তাহলে আমি লিফট দিতে পারি।”
কিসের প্রব্লেম কিসের কি। শুনে তো আমি আট দুগুনে ষোলখানা হয়ে গেলাম। “না, না আমার কোন প্রব্লেম নেই। কিন্তু...”
কথা শেষ করার আগেই বৃত্ত একটা রিক্সা ঠিক করে তাতে উঠে বসলো।
“উঠুন।”
“হুম। উঠছি।”
“মামা যাও। কি জানি বলছিলেন তখন?”
“ও...না মানে বলছিলাম। আপনি আমাকে চেনেন?”
“বাহরে, একই এলাকায় একই এপার্টমেন্টে থাকি আমরা। না চেনার কি আছে?”
“হুম...তাও ঠিক। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম...”
“কি ভেবেছিলেন?”
“না, কিছুনা।” বলে একটা পানসে হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম।
“হুমম। বুঝলাম।”
“কি বুঝলেন?”
“যা বোঝাতে চাইলেন।” বলেই হাসা শুরু করলো বৃত্ত।
কি আজব! আমি তো কিছুই বলিনি। এ ছেলে কি বুঝতে কি বুঝলো ভেবেই আমার মাথা ভনভন করতে লাগলো। পুরোটা রাস্তাই চুপচাপ ছিলাম আমরা, বিশেষ করে আমি। ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন আবার কি বলতে কি বলে ফেলি। যাইহোক বাসায় ফেরার পর ও রিক্সা ভাড়া মেটালো। তারপর দুজনে লিফটে উঠলাম। ও চারতলায় আর আমি ছয়তলায় নামবো। চারতলায় লিফট আসতেই ও নেমে গেল। হঠাৎ কি মনে করে ওপেন বাটন হোল্ড করে বললো,
“২০ তারিখ থেকে আমার একজাম।”
“তো?”
“আটটার বাসে যাওয়া হবে না তাই। দশটার বাসে যাবো।“ বলেই চলে গেলো।
আর আমি ২৫০ ভোল্ট কারেন্টে শক খেয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। তার মানে বৃত্ত সব জানে। সেই মুহুর্তে আমার চেহারা দেখতে কেমন হয়েছিল জানিনা। হয় পাকা টমেটোর মতো মুখটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল আর নয়তো ১০ সেকেন্ড পালসের মতো মাথার চুলগুলো খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল।
আর এভাবেই চলছিল আমাদের দিনগুলো। আমি নানারকম পাগলামি করতাম আর ও সময়ে সময়ে জানান দিয়ে যেতো যে আমি ধরা পড়ে গেছি। কিন্তু বৃত্ত যে কেন আমার এইসব পাগলামি মুখ বুজে সহ্য করে যেতো তা তখনো আমি বুঝে উঠিনি, হয়তো বুঝে উঠার চেষ্টাই করিনি।
চার-পাঁচ মাসের মাথায় বৃত্ত পাশ করে বের হয়ে গেলো আর আমারও অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেলো। সেইদিনটার কথা আজো মনে আছে। সাত-সকালে বৃত্তকে ফোন দিয়ে বললাম দেখা করবো। ও ওর অফিসে যেতে বললো। সেখানে গিয়ে ওকে নিয়ে বের হয়ে একটা ক্যাফেতে বসলাম।
“কেমন আছো?”
“ভালো না।”
“কেন?”
আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, “বাবা, আমার বিয়ে ঠিক করছে। আমাকে ডিসিশান নেয়ার সাত দিন সময় দিছে। আজকে তার শেষ দিন। কিন্তু আমি এখনো পর্যন্ত কোন ডিসিশান নিতে পারি নাই।“
“বলবা যে তোমার বলার কিছু নাই।”
“তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি জানো না মৌনতা সম্মতির লক্ষন।”
“ও...তো আমি কি করবো?”
“কি করবো মানে? তোমার কিচ্ছু করার নাই?” বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“কুল। বিন্দু। এটা রেস্টুরেন্ট। প্লিজ সিট ডাউন।“ আমি বসার পর ও বললো, “আচ্ছা একটা কথা বলো তো। তোমার বাবা তোমার জন্য যাকে পছন্দ করেছে তাকে দেখেছো তুমি?”
“নাহ।“
“হুমম...তাহলে এক কাজ করো। বাসায় গিয়ে আগে তার ছবিটা দেখো। ওককে...চল এবার।“
কথাটা শুনেই আমার মনের মধ্যে একটা খটকা লাগলো যে এখানে সিনেমাটিক কোন ব্যাপার নেই তো। হয়তো আমি বাসায় গিয়ে দেখবো বাবা আমার জন্য বৃত্তকেই ঠিক করেছে। হলোও তাই। ছবিটা হাতে নিয়ে আমি যখন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ঠিক তখনি একটা ম্যাসেজ আসলো, “বিন্দু ছাড়া কি বৃত্তের কোন অস্তিত্ব আছে নাকি কখনো ছিল?”
আর এই হল আমাদের প্রেম কাহিনী।”
***
এফ.এম টা অফ করে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকে বৃত্ত। আজ তিনদিন হলো বিন্দু রাগ করে বাবার বাড়িতে চলে গেছে। অন্য কোন ছেলে হলে পরের দিনই গিয়ে বউ এর রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসতো। কিন্তু বৃত্ত ছিল তার ইগো প্রবলেম নিয়ে। যদিও ও জানে পুরো ঘটনার জন্য ওই দায়ী। তবুও স্ত্রীর কাছে হার স্বীকার করতেই যেন ছিল তার যত আপত্তি।
কিন্তু বিন্দু!!! এই মেয়েটাকে যত দেখে তত অবাক হয় বৃত্ত, সেই প্রথম দিন থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু বিন্দুকে কখনো তা বুঝতে দেয়নি। আসলে মেয়েটা তার পাগলামি আর আহলাদিপনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে তা বুঝে উঠতে পারেনি। অন্য কোন মেয়ে হলে অনেক আগেই বুঝে ফেলতো।
মাঝে মাঝে বৃত্তর বড্ড অদ্ভুত লাগে বিন্দুকে। এই যেমন আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক, সারাটাদিন বৃত্ত মন খারাপ করে বসে রইলো বিন্দু ওকে ফোন করেনি বলে, যদিও সেটা করার কথা নয়। কারন ও জানে বিন্দু ভীষন রাগ করে আছে ওর উপর। অথচ দিন শেষে কি দেখতে পেল, বিন্দু ঠিক তার সারপ্রাইজ গিফটটা দিয়েছে। ওর আজকের প্রোগ্রামটাই ছিল বৃত্তকে নিয়ে। এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ আর কি হতে পারে। অথচ ও। আসলে বিন্দু ঠিকই বলে নিজেকে যতই চালাক ভাবুক না কেন ও আসলেই একটা বেকুব। নইলে এতোদিন ধরে কার সাথে ইগো দেখালো। উফফ...প্রচন্ড রাগ উঠছে ওর নিজের উপর।
কি করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল রেডিও স্টেশনে গিয়েই বিন্দুকে চমকে দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সোজা স্টেশনে গিয়ে হাজির। কিন্তু বিধাতা এবারো তার পক্ষ নিলনা। গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলো যে বিন্দু মিনিট পাঁচেক আগে বেরিয়ে গেছে। বাকি থাকে একটাই উপায় আর তা হল বিন্দুদের বাসায় যাওয়া।
রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। অলরেডি সাড়ে দশটা বেজে গেছে। বিন্দুদের বাড়িতে গিয়েই দ্রুত কলিংবেল বাজাতে থাকে বৃত্ত।
বিন্দুর মা দরজা খুললেন।
“বৃত্ত। তুমি? এসো ভেতরে এসো।”
“আন্টি, বিন্দু কই? ওকে ডাকুন না প্লিজ।”
“বিন্দু তো এখনো ফেরেনি। ফ্রেন্ডরা মিলে কোথায় জানি গেট-টুগেদার করবে বলেছিল। আচ্ছা আমি ফোনে জেনে নিচ্ছি কোথায়...”
“না থাক আন্টি। আমি বরং আজ আসি।” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বৃত্ত। ফোন করার কথা মাথায় আসলেও কল আর করে না ও।
বাসায় গিয়ে খাটে ধপ করে বসে পড়ে বৃত্ত। আজ পর্যন্ত বিধাতা কখনোই ওর পক্ষ নেয়নি শুধুমাত্র বিন্দুকে বিয়ে করার ডিসিশান নেয়া ছাড়া। ওর ভাগ্যটাই এমন। বুকের কাছটায় হাত রেখে চোখটা বন্ধ করে বৃত্ত। আংটিটা এখনো পকেটেই আছে। তিনদিন ধরে এটাকে বুক পকেটে নিয়ে ঘুরছে বৃত্ত বিন্দুকে দেবে বলে। কিন্তু কি ভাগ্য যে আংটিটা আজ বিন্দুর হাতে থাকার কথা তা বৃত্ত এখনো পকেটে নিয়ে ঘুরছে।
“কোথায় কোথায় খুঁজতে যাওয়া হল, শুনি।” কথাটা শুনেই চমকে উঠে বৃত্ত।
“তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে...”
“জানি। তাইতো চলে আসলাম। নইলে কি আর আসতাম।” বলেই দুষ্টুমির হাসি ফুটে ওঠে বিন্দুর ঠোঁটে।
“কিন্তু আন্টি যে বললো তুমি ফ্রেন্ডদের সাথে...”
“আম্মু যা জানে তাই বলছে। এখন আমি কি বলবো, আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য এখানে চলে আসছি। কি ভাববে আম্মু শুনলে।“
“কিছু ভাবার কি আর বাকি রাখছো তুমি।”
“হইছে...অনেক বেশি বুঝে ফেলছো। এখন বল আমার গিফট কই।”
“ওহ শিট। ভুলেই গেছি। কি করে মনে থাকবে বলো। সারাদিন তো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই গেলো।”
“সেটা তো আজকেই না খুঁজছো। গত দুদিন কি করছো?”
“বড্ড ভুল হয়ে গেছে। স্যরি। এবারের মতো মাফ করে দাও।” বলে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করেই হার স্বীকার করে বৃত্ত। এই হারের মাঝে যে কি আনন্দ বিন্দু তা জানেনা।
কিন্তু আর বুক পকেটের উপর হাত পড়তেই বিন্দু বুঝতে পারে যে বৃত্ত মিথ্যে বলেছে।
“আমি জানতাম তুমি এবারো ভুলে যাবে।” বলে মিথ্যে অভিমানে গাল ফোলায় বিন্দু। কিছুই বলেনা কারন ও জানে, ওর কাছে হারতেই বৃত্ত বেশি ভালোবাসে...
উৎসর্গ : রুদ্র, অয়ন, দ্বীপ্ত, আবীর, স্বপ্নীল, নীলাব্রু, ইমন, অভ্র, নিলয় (আমার সব গল্পের নায়কদের


ভালবাসা দিবসের বিশেষ ই-বুক 'মুঠো ভরা রোদ' এ প্রকাশিত।
ღ সবাইকে ভালোবাসা দিবসের অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা ღ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:০৭