
******
ছয়তলার ছাদের পানির ট্যাঙ্কির উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছি। বিগত দুই ঘন্টা ধরে। শুনছি চড়ুই পাখিদের দৈনন্দিন সাংসারিক কলহের সংলাপ। এবং উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে দেখছি চ্যাপ্টা হয়ে দৃষ্টির সমকোণে ঝুলে থাকা আকাশ। চার পাঁচটা পুড়ে যাওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পায়ের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। দুদিন আগে খাওয়া হয়েছিল ওগুলো। এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। ঝাঁট দেয়নি কেউ। কেননা ছাদটা গত দুদিন ধরে তালা বন্ধ। খাটো রেলিঙের কারণে এই ছাদে কারো ঢোকা নিষেধ। আমার অবশ্য তাতে সমস্যা নেই খুব একটা। দিনের বড় একটা সময় দিব্যি এখানেই কাটাই আমি। আর বসে বসে একা দূরত্ব মাপি। সময়ের, আকাশের,অন্ধকারের.........ছায়া থেকে আলোর অথবা আলো থেকে ছায়ার............
এখান থেকে একটা সমুদ্র হেঁটে হেঁটে চলে গেছে অপর্ণার ঘরের জানালায়। অপর্ণা অবশ্য ডুবে যায়না তাতে। এমনকি সাঁতারও কাটে না। দিব্যি পায়ে হেঁটে সমুদ্রটা পার হয়ে ডাঙায় উঠে গেছে সে। এখন সে আর জলকন্যা নেই। ডাঙায় চরে বেড়ানো মাছের ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্য তার। জেনেছি আমি।
আমার তবু সাঁতার দিয়ে ওর কাছে যেতে ইচ্ছে হয়। সবাই পার হয়ে গেছে অথচ শুধু বোকা এই এক আমি কেন এই নষ্ট সমুদ্রটা পার হতে পারছিনা ভেবে আমার ভয়ঙ্কর রাগ হয়। রাগে শরীরটা ছিঁড়েখুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
বিধি বাম! সেই রাস্তাটাও তো বন্ধ।
অপর্ণা যদি জানত, আমি হামাগুড়ি দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে ওর চিবুকটা ছুঁয়ে দেবার অপেক্ষায় এখানে বসে আছি - তাহলে কি বলত সে? অভিব্যাক্তিটাই বা কেমন হত তার? জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল আমার।
অথচ সেটা জানার এখন আর কোনো উপায় নেই।
শুন্য সময়ে শুন্য দৃষ্টি দিয়ে আমি তাই শুধু পরিত্যক্ত সমুদ্রের বিস্তৃতি মাপি এখন।
**********
ছেলেটার শরীরটা থেঁতলে গিয়েছিল মুখ বরাবর সামনে থেকে। দিনে দুপুরে জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষের ছয়তলা থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্যটাই ছিল যথেষ্ট রোমাঞ্চকর - উত্তেজনাহীন এই শহরের মানুষের পক্ষে। তারপর যখন তার রক্তের সমুদ্রে নিথর শুয়ে থাকা দেহটা উল্টে কেউ অনাবৃত করে দিল আগাগোড়া বিকৃত হয়ে যাওয়া থেঁতলানো মুখ- তখন অনেকেই স্নায়ুর উপর চাপ সইতে না পেরে সন্তর্পনে সরে গেল ঘটনাস্থল থেকে। আমার অবশ্য সে উপায় ছিল না পেশাগত কারণে। কেইস কাভার করতে সাথে আসা সহকর্মী ফটোগ্রাফারকে গোটাকতক ছবি তুলতে বলে আমি চিন্তিত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে স্টোরিলাইনের শিরোনাম ভাবছিলাম। গোটাগুটি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ার কারণে শরীরের সামনের সমস্ত অংশটাই থেঁতলে গিয়েছিল তার। পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে ঝুরঝুরে হয়ে পড়েছিলো বেশ কয়েক জায়গায়। চেপ্টে যাওয়া মাথা থেকে গলগল করে বেরুনো রক্ত আর মগজ লেগে ছিল মুখ আর কানের আশেপাশে। হৃৎপিন্ডটা অবশ্য তখনও ছিল ক্ষতবিক্ষত শরীরের ভেতরেই। বাইরে বেরিয়ে আসেনি। তবু দৃশ্যটার বিভত্সতা ছিল ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ঠ। তখনও যারা চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল উত্সুক দৃষ্টিতে, আমি মৃতদেহের পাশ থেকে তাদের দিকে সরে এলাম।
"আজকাইলকার পুলাগুলান! যেরাম নাখাস্তা হেরামই গাধা। আয় হায় রে! সামাইন্য একখান মাইয়ার লাইগা এরামনি করে কেউ?"
"হ! ওই এক মাইয়া গ্যাছে আরো কত মাইয়া আইত। হেল্লাইগা মইরা যাবি তুই? মাইয়াডা তো ঠিকই সুখে ঘরসংসার করতাসে। ওই মাইয়া তো একখান মরাখাগী! এর আগেও দুইডা পুলারে এমনেই ছাড়সে শুনছি। ওই যে এরাম করব হেইয়া তো জানা কতাই।"
"আরে নিমকহারাম পুলা,নিজের বাপ মায়ের কথা একবার ভাববি না? ওই মাইয়াডাই সব?"
"থাক চাচামিয়া! মইরাই তো গ্যাছে। অহন আর গাইল দিয়েন না! চলেন অর বাপ মায়েরে ইট্টু দেইখা আহি।"
আশপাশ থেকে এরকম কিছু কথার চুম্বক অংশ ভেসে আসে আমার কানে। প্রেমিকার বিশ্বাসঘাতকতায় আঘাত পেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা একেবারে অবিশ্বাস্য না হলেও আজকালকার দিনে একটু বিরল তো বটেই। ভিড় বেয়ে ভেসে আসা কথাগুলো থেকে আমি তাই আত্মহত্যার অন্যান্য সব সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। কিন্তু আত্মঘাতী যুবকটির বেশ কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে কথা বলেও প্রেমে ব্যর্থতা ছাড়া দুর্ঘটনার পেছনের আর কোনো কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলাম।
অতঃপর ঘটনাস্থলে দায়িত্বে থাকা পুলিস সুপারের কাছ থেকে ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ জেনে নিয়ে সহকর্মীকে ক্যামেরা গুটিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটার নির্দেশ দিলাম।
আজকের সারাদিনটা এই বিভত্স স্টোরিটা লিখতেই লেগে যাবে।
ভেবে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
***************
আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই জায়গাটায় ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। সময়ের হিসেব নেই যদিও এখন কোনো। মনে হয় কয়েকটা যুগ ধরে এখানেই আছি। অথবা কয়েকটা শতক। জায়গাটা খুব প্রিয় হয়ে গেছে আমার ইতোমধ্যেই। রাত্তিরবেলা আকাশে চাঁদ উঠলে একা শুয়ে শুয়ে জ্যোত্স্না লুটেপুটে খাওয়া যায়। তাতে ভাগ বসানোর কেউ নেই। সমস্ত নির্জন রাত্রি আর অপার্থিব জ্যোত্স্না আনন্দ হয়ে আমার শরীরে ঝরে ঝরে পড়ে। এখানে আমি আছি বেশ।
শুধু অপর্ণার কথা খুব মনে পড়ে। ওর শরীরের ভাঁজে আলতো করে আঙ্গুল চালাতে ইচ্ছে হয়। এখনো ওর শরীরের প্রতিটা ভাঁজ আছে তেমনই নিপাট আর নিটোল। ঢিলে হয়ে যায়নি একটুও।
সেই নেশা ধরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সমস্ত সমুদ্র মন্থন শেষে ঠিক ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে গাঢ় চুম্বনের মুহূর্তগুলোতেই সে ফিক করে দুষ্ট হাসি হেসে বলে উঠত,এই দিলাম ফাঁকি। বলেই হাতের তালুতে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরত আমার।
আহ! মনে হয় যেন কতকাল পেরিয়ে গেছে সেইসব দিনের পর।
অপর্ণাকে আমার খুব জরুরি দরকার ছিল।
ওকে বলা হয়নি আমার ভেতরে বাসা বেঁধে আছে কে। বোকা মেয়েটা জানত না জন্মনিরোধী বটিকা দিয়ে শুক্রানু আর ডিম্বানুর অনাকাঙ্খিত মিলনকে বাধা দেয়া যায় শুধু। জরাকে নয়।
মৃত্যুর পথে শেষ পাটা বাড়িয়ে দেবার আগে কতইনা চেষ্টা করেছিলাম ওকে জানানোর। মুঠোফোন বেজে বেজে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বার্থপর মেয়েটা একটাবারও সাড়া দেয়নি।
তবু সান্তনা বাবা মা কে এই দুর্বিষহ সত্যের গ্লানির মুখোমুখি হতে হলো না। আজ আমি ছায়া হয়ে ভেসে গেছি বলেই তাদের চোখের জল আমাকে খুঁজে ফিরছে আকাশের তারায়। শরীরে থাকলে সেই চোখ কেবল অন্ধকারে মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতো যন্ত্রণায়।
অপার্থিবদের চেয়ে পার্থিব মানুষের যন্ত্রণা অনেক বেশি গভীর।
অনেক নারকীয় ও ক্লেদময়।
*************************************
সকাল ১০টা থেকে রমনা থানায় বসে আছি ওসি হামিদুর রহমানের অপেক্ষায় এবং মনে মনে পিন্ডি চটকাচ্ছি তার। সারা মাসের বাজার করার জন্য ব্যাটা আজকের দিনটাই হাতে পেল। আমি একশভাগ নিশ্চিত আমার সাথে এপয়েন্টমেন্ট থাকার কারণেই কাজটা করেছে সে। পুলিশরা সাংবাদিকদের অহেতুক ঘুরিয়ে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পায় - আগেও লক্ষ্য করেছি ব্যাপারটা। তিন কাপ চা ইতোমধ্যেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে চতুর্থ কাপ হাতে নেয়ার পর পাকা এক ঘন্টা অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওসি মহোদয়ের আগমন ঘটল।
- সরি ম্যাডাম,এক্সট্রিমলি সরি! বাজার করতে গিয়ে একটু দেরী হয়ে গেছিল। শালার বদমাইশ দোকানদারগুলি........
- না না ঠিক আছে। কিছু মনে করিনি আমি।
জোর করে মুখে সামান্য হাসি টেনে এনে বললাম। ওসি সেটা লক্ষ্য করলো সম্ভবত। তাই ভনিতা না করে কাজের কথায় গেল।
-ময়না তদন্তের রিপোর্টটার ব্যাপারে তথ্য চাইছেন তো? ভেরি ইন্টারেস্টিং এন্ড শকিং রিপোর্ট এজ ওয়েল।
তেল চকচকে ধূর্ত হাসি তার চোখে মুখে।
- কিরকম?
কৌতুহলী দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলাম আমি।
-আপনি নিজেই দেখেন। মতিউর! ম্যাডামকে সুইসাইড কেইসের রিপোর্টটা এনে দাও।
মতিউর নামের কনস্টেবলটি একটা লাল ফিতেয় বাঁধা ফাইল আমার সামনে এনে রাখল। আমি তড়িত হাতে রিপোর্টটায় চোখ বুলালাম। আচমকা এক জায়গায় এসে আমার চোখ আটকে গেল।
সেখানে লেখা - The blood test result shows that the victim was an HIV positive!
আমি স্থির দৃষ্টিতে ওসির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,তার মানে সম্ভবত মেয়েটাও............?
- মনে তো হয় তাই।
আমি আস্তে করে ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে ওসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ভীষণ। যাকে বলে একেবারে ঝুম বৃষ্টি। প্রতি বছর পূজোর সময়টায় এরকম মুষলধারে বৃষ্টি হয় সবখানে।
আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বৃষ্টি দেখছি। বৃষ্টির জলে সামনের রাস্তাটার আশপাশের সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আর ঠিক সেই পথে আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো একে একে গড়িয়ে গড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে সময়ের হাত ধরে.............
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:৫০