০১.
আমার মা ছিলেন ভয়ানক বিকারগ্রস্থ মহিলা। কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষের রাতে তার মনে মৃত্যুর সাধ প্রবলভাবে জেগে উঠত। ঘড়ির পেন্ডুলামের মত পর্যাবৃত্ত ছন্দে দুলতে দুলতে তিনি মৃত্যু পূর্ববর্তী প্রার্থনাসমূহ পাঠ করতেন আর তার সমুদ্র গভীর চোখের তারায় মৃত্যুর ছায়া জ্বলন্ত সূর্যের মত প্রকট হয়ে উঠত। সেই ছায়া এক অমোঘ প্রতিসঙ্গী হয়ে গ্রাস করে নিয়েছিল আমাদের সমস্ত শৈশবকে। আমরা তার চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেতাম; আবার আমাদের কৌতুহলও হত। চারকোনা ঘরের বেড়ার ফাঁকে লুকিয়ে আমরা তার কার্যকলাপ সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতাম। দিনের আলোতে মা থাকতেন অসম্ভব শান্ত, কখনো দরজার ফাঁকে আমায় লুকিয়ে থাকতে দেখে তিনি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকতেন। আমার ভয় করত, তবু তার কাছে যাবার লোভটুকু আমি ছাড়তে পারতাম না। ভয়ে ভয়ে পা টিপে এগোলে তিনি হাসিমুখে আমায় হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের কোলঘেঁষে বসাতেন। আর আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলতেন, "পুড়ে যাবে! সব পুড়ে যাবে! শুধু ছাই এর গাদায় তুই হীরের নাকছাবি হয়ে থাকবি।" আমার ভয় করত ভীষণ তবু কথাগুলো শুনে আমি শিহরিত হতাম। ক্রমান্বয়ে যত রাত বাড়ত মায়ের চোখের পাতায় অস্থিরতা বাড়তে থাকত। শাপগ্রস্থ নিষাদীর মত চক্রাকারে সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে তিনি মৃত্যুবিলাপ করতেন। আর জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে দিতে চাইতেন নিজের অথবা সময়ের শরীর। বহু চেষ্টাতেও তার উন্মত্ত আক্রোশকে শান্ত করা যেত না কখনো। তাকে তাই চারপাল্লার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত ঘরের মধ্যভাগ জুড়ে থাকা প্রকান্ড পালঙ্কের সাথে। তার ঘরের দরজায় বিশালাকায় তালা ঝুলিয়ে বাবা আমাদের দুবোনকে নিয়ে ঘুমোতেন পাশের ঘরে। বাবার স্নেহভরা কন্ঠের ঘুমপাড়ানিয়া গান শুনতে শুনতে আমরা বিগত দিনের যাবতীয় দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ভুলে ঘুমিয়ে পড়তাম গভীর প্রশান্তিতে। একদিন বৈশাখের ঝড়ে আমাদের উঠোনে বজ্রপাত হলো। সেই বজ্রপাতে বাবার শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমরা দুবোন ছাই এর প্রান্তে দাড়িয়ে বিমূঢ় হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম - ছাই এর ভেতর থেকে বাবার ফিনিক্স হয়ে উঠে আসার...........বাবা আসলেন না.........আমাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হতে থাকলো.........সূর্যঘড়ির কাঁটা আমাদের চোখের পরে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো রাত পেরিয়ে দিন, দিন পেরিয়ে রাত.........বাবা তবু আর ফিরে আসলেন না.........আসলেনই না..........
০২.
মাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার দৃশ্য আমার চোখে ছিল অসহ্য। এক ভরা পূর্নিমার রাতে আমি তাই শেকল খুলে দিলাম। অতঃপর সারারাত জেগে মাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাবার প্রস্তুতি নিলাম কিন্তু মার কানে কানে ঘুমপাড়ানিয়া মন্ত্র পড়তে ভুলে গেলাম। মাঝরাত্তিরে আমার চোখের পাতা জড়িয়ে এলো। গান ভুলে আমি একসময় গভীর ঘুমে ঢোলে পড়লাম। কিন্তু মায়ের চোখ হঠাৎ মধ্যাহ্ন সূর্যের মত ধক করে জ্বলে উঠলো। মা অন্ধকারে ঘর পেরিয়ে উঠোনে নামলেন। তারপর দ্রুতপায়ে ছুটে গেলেন বাড়ির পাশের পদ্মদীঘির পাড়ে। আমি তখন ঘুমে অচেতন। নীলিমা ছিল আমার ছোট বোন। দীঘির পানিতে মায়ের ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দে তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। উদ্ভ্রান্তের মত মাকে বাঁচাতে সে ছুটে গেল দীঘির পাড়ে। জলে নেমে মার হাত ধরে টানতেই মায়ের মৃত্যুস্বপ্নে বাস্তবতার কঠিন বাধা পড়ল। মা সেটা সহ্য করতে পারলেন না। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি নীলিমার গলা দুহাতে সজোরে টিপে ধরলেন। মার বজ্রকঠিন হাত দুটোতে তখন ভর করেছিল আসুরিক দানবীশক্তি। ঘন অন্ধকারে তার চোখজোড়া জ্বলছিল আগুনের হলকার মত। নীলিমা সেই অপার্থিব শক্তিকে প্রতিহত করতে পারল না। অসহায় পতঙ্গের মত কাতরাতে কাতরাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ল........তারপর পাথরের টুকরোর মত ডুবে গেল জলপ্রকোষ্ঠে। ভোর হলে তার মৃত লাশ পদ্মফুলের মত ভেসে উঠলো দীঘির জলে। কি অপার্থিব দেখাচ্ছিল তার শান্ত স্মিত অনিন্দ্যসুন্দর মুখ,তাতে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। আমি অবাক হয়ে সেই মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
দিনের আলোয় মা সংবিত ফিরে পেয়ে মৃত কন্যার জন্য উচ্চস্বরে করুণ মৃত্যুবিলাপ করতে করতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললেন। আমি চোখের ভেতর বেঁধে নিয়েছিলাম পাঁচটা জবাফুল.........তবু আমার চোখের পাতায় মরুভূমির শুষ্কতা তীব্র খরার মত দানা বেঁধে রইলো। আমি কাঁদতে পারলাম না।
আমি শুধু শক্ত দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে রইলাম যক্ষের ধনের মত।
০৩.
গাঢ় অন্ধকারের ভেতর আমি ডুবসাঁতার দিচ্ছিলাম আপনমনে। আমি জানতাম এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আমার উত্থান হয়েছিল কোনো এক জলসিক্ত শ্রাবণ নিশিতে। এও জানতাম অন্ধকারেই মিলিয়ে যেতে হবে সময়ের শেষপ্রান্তে গিয়ে। ক্রমশ আমি অন্ধকারকে ভালোবেসে ফেললাম। হিমশীতল বরফের মত জমাট বাধা ঘন আঁধারে মিশে যেতে যেতে আমি জানলাম আঁধারের সৌন্দর্য অপার্থিব। সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে আমি সেই সৌন্দর্যকে পান করলাম। মায়ের চোখদুটোকে আমার আর ভয় করত না ছেলেবেলাকার মত। তার ছেলেমানুষী দেখে আমি আপনমনে হাসতাম। আমাদের বাড়ির দু'ঘর পরে থাকত গণিকার দালাল রইস। বহুদিন ধরেই তার লোভাতুর পশুর মত জ্বলজ্বলে চোখ আমি চিকচিকিয়ে উঠতে দেখেছি আমার লতাগুল্মের মত ক্রমশ বেড়ে ওঠা পূর্ণযৌবনা শরীরের দিকে তাকিয়ে। তার কুতকুতে চোখগুলো আমার দেহের প্রতিটি ভাঁজে ওঠানামা করতে করতে অবশেষে বুকের মাঝখানে এসে স্থির হত - সেই দৃশ্য দেখে আমি অজানা আশঙ্কায় থরথর করে কাঁপতাম। একদিন সে বাড়ির উঠোনে এসে গলা হাঁকিয়ে আমার নাম ধরে ডাক দিল, "প্রতিমা আচস নিকি?"
আমি দুরুদুরু বুকে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। রইস তার লাল ঠোঁট থেকে পিচিক করে একপ্রস্থ পানের পিক ফেলে শুধালো,
- যাবি নিকি?
- কনে?
- লেব্বাবা! কনে আবার কি? জানিসনে বুজি? নাকি জেনেইও না জানার ভান করতিছিস!
- তুমি কি কতিসো আমি বুজতি পারতিসিনে!
- আচ্ছা! তবে তোরে বুজিয়েই কই। ফুলবাড়ির রেড লাইট এরিয়ার নাম শুনিসিস? আরে যেথায় আমি মেয়েমানুষের চালান দেই। হেথায় তোরে লইয়ে যাপনে। এইখেনে এই পাগলি বুড়ির সাতি আর কদ্দিন? গোটা জীবনডা তো তোর পইরে আসে.......হেথায় গেলি আমোদ ফুর্তিতে কাটাতি পাইরবি। তোর যা রূপের বাহার হেথায় তোর বড় কদর কইরবে সকলে।
- দূর হইয়ে যাও হতচ্ছাড়া। আর একবার এখেনে তুমাক দেখিলে দাও দি কুটি কুটি কইরে কাইটে ফেইলব কইয়ে রাকলাম!
- ওরিব্বাস রে! মালাউনের বেটির সাহস কত! তুই আমাক কুটি কুটি কইরে কাইটবি মাগী, তোরে আমি জবাই করি মাটির তলে গাড়ি দিপনে। তোর পাগলি মা হাজার চিল্লিয়েও কোনো জনমে খুঁজি পাবিনানে। রইস শেখ আমার নাম। এই আমি কইয়ে রাকলাম,বাঁইচতে চাস তো আমার সাতি চইলে আয়। নালি মরতি হপিনে।
গনগনে তপ্ত মুখে রাগে গজগজ করতে করতে রইস শেখ প্রস্থান করলো। আমি তার চলে যাওয়ার পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম............
০৪.
নীলিমার অকস্মাৎ মৃত্যুর পর থেকে মার বিকার দিন দিন বেড়েই চলছিল। আমি জানতাম না কি করে কি করতে হয়......আমি শুধু দুহাত দিয়ে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের শরীরে অসুরের শক্তি ভর করত। আমায় ঠেলে ফেলে দিয়ে পরক্ষণেই আমার কেটে যাওয়া কপালে রক্তের দাগ দেখে আতঙ্কে আর অনুশোচনায় তীব্র বিলাপ শুরু করত। আমি তখন তাকে শান্ত করার জন্য তার মাথাটা আমার কোলের উপর নিয়ে আলতো হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমপাড়ানি গান গাইতাম। একদিন মধ্যাহ্নে রান্নার চুলোয় আগুন জ্বলতে দেখে মার পুরনো বিকার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ছুটে গিয়ে চুলোর পাশের কেরোসিনের টিন খালি করে সবটুকু তেল ঢেলে নিল গায়ের উপর। তারপর নিমেষেই চ্যালাকাঠের আগায় আগুন নিয়ে ধরিয়ে দিল নিজের গায়ে। আমি ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম........বাধা দিতে আমার ইচ্ছে করলো না কেন যেন আর।
তপ্ত উঠোনের মাঝখানটায় যেখানে বাবার দেহ জ্বলে গিয়েছিল নিমেষেই সেখানে লেলিহান অগ্নি তার চতুর্মুখী শিখা ছড়িয়ে একটু একটু করে পুড়িয়ে দিল মায়ের শরীর। আমি দেখলাম, এক অগ্নিস্নাত নারী তার বিষাদের সমস্ত লোমকূপ অগ্নির উপাসনায় জলাঞ্জলি দিয়ে শুকতারার মত জ্বলে গেল আর কিছু ছাইভস্ম পড়ে রইলো শূন্য উঠোনের পরে।
আমি তবু কাঁদতে পারলাম না।
আমি শুধু বোবা হয়ে গেলাম।
এবং আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।
এবং বধির হয়ে গেলাম।
০৫.
রইস আমাকে বলেছিল হয় বাঁচো নয় মর। মরে যাওয়া খুব সহজ আমি জানতাম। সকলের মত সস্তা সহজ কাজটা করতে তাই আমার রুচিতে বাধলো।
মা বলেছিল আমি হীরের নাকছাবি হব। এতদিনে আমি জেনেছি বেঁচে থাকতে হলে কখনো কখনো কয়লা হয়ে যেতে হয়। শত সহস্র যুগ ধরে মাটির ভিতর অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় গুমরে গুমরে মরার পরই অবশেষে একদিন কয়লা থেকে হীরের উত্থান হয়। আমি জানতাম মায়ের স্বপ্ন সত্যি হবে।
সুতরাং আমি বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
অতঃপর এক সূর্যপিয়াসী সকালে রইসের হাত ধরে আলো ঝলমল পথে কোনো এক অনিঃশেষ আঁধারের উদ্দেশ্যে আমি রওনা দিলাম ধীরপায়ে.....................