ছুটির দিনে সুন্দর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যা আমাদের এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনবে, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বিরোধিতাকারীদের মুখে ঝামা ঘঁষে দেবে এবং জঙ্গীদের ঘুম হারাম করে দেবে। ভারতবিরোধী ধর্মীয় রাজনীতি যারা করে এতোদিনে তাদের বোধদয় হবে, তারা যে এতোদিন বোকার স্বর্গে বাস করেছে, তা বুঝতে পারবে এবং তারাও একটিবার মোদিজীর শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ খুঁজবে।
তবে দেশীয় মিডিয়ায় ও কিছু আইডি থেকে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, আসলে বিষয়টি তেমন নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা শুধুই একটি সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ। এটা দেখে ভাবার অবকাশ নেই ভারত সেভেন সিস্টার্স হারানোর ভয়ে মিটিংয়ে বসতে বাধ্য হয়েছে বা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ভারত। না, রাজু থেকে দিল্লী ঘেরাও কর্মসূচিতেও তারা ভীত নয়। তবে প্রতিবেশী যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য বারবার হাত বাড়ায়, সেই হাত ধরে ফেলাই সকলের জন্য উত্তম-- এটা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত বোঝে। যে অস্ত্র শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছেন, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতে কোনো জঙ্গী কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না-- এমন নিশ্চয়তা যদি এই সরকারও দেয়, তবে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্যসহ উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এগিয়ে নেওয়াই উভয় দেশের জন্য মঙ্গলকর।
প্রতিবেশী যখন একটাবার দেখা করার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে, বারবার চিঠির পর চিঠি দিয়ে যায়, নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে, প্রতিনিধি পাঠিয়ে একটা মিটিংয়ের জন্য সবার সামনে পাবলিক প্লেসে বারবার চাপাচাপি করে, তখন আসলে 'না' করার আর উপায় থাকে না৷ তখন একটা মিটিং হয়েই যায়। কিন্তু তার কিছু শর্ত থাকে। কী করা যাবে, কী করা যাবে না, কী দেয়া যাবে, কী দেয়া যাবে না, কে কে থাকবেন মিটিংয়ে এর সবটাই আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও দুই নেতার থেকে পাশ করানো থাকে। এমনকি কে কতটা হাসবেন, কয়বার হাত মেলাবেন, তাও আগে থেকে ঠিক করা থাকে বলেই জানি।
তো, বিমসটেক সম্মেলনের আগে থেকেই বারবার চিঠি দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছিলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার একটা মিটিংয়ের জন্য। তাতে সাড়া পাওয়া না গেলেও দেশের মিডিয়াগুলো প্রচার করছিলো মিটিং হবে। তবে সম্মেলনের শুরুর থেকেই বারবার চেষ্টা চালানো হয় মিটিং আয়োজনের। প্রতিবেশী বারবার মিটিং চাইলে আর অল্প কয়েকটা দেশের সম্মেলনে বারবার দেখা হয়ে গেলে বারবার এড়িয়ে চলার সুযোগও থাকে না।
এতটা আকুল হয়ে দেখা করতে চাইলে স্বয়ং ভগবানও বর দানের জন্য এসে হাজির হতেন। মোদিজী তো সামান্য এক মানুষ! শেষমেষ দেখা হয়েই গেলো। ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কোনো নিশ্চয়তা ছাড়া মিটিংয়ে বসার ও বসানোর লোক নন। আমার ধারণা তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাসহ কিছু বিষয়ে বিশেষ সহকারী ও লামিয়া মোর্শেদের থেকে আশ্বস্ত হয়েই মিটিংয়ে সম্মত হয়েছেন গতকাল রাতে। তাছাড়া কথা না বলে কয়দিনই বা থাকবেন আর? ৮ মাস চলে গেছে। পাকিস্তানের মতো 'চিরশত্রু' প্রতিবেশীর সাথেও ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। সেখানে বাংলাদেশ তো এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি।
সেই মিটিংয়ের ভিডিওটি ভালো করে দেখলেই বুঝা যায়, যারা মোটামুটি নিউট্রাল ছিলেন গত ৮ মাস, তারাই মিটিংয়ে হাসিমুখে আছেন। প্রেস সচিব বইমেলায় শেখ হাসিনার ছবি ডাস্টবিনে ছাপিয়ে বিতর্কিত কাজ করেছেন, তাঁকে দেখবেন মিটিংয়ে অতোটা প্রাণবন্ত নন। বাকি যারা আছেন, তাঁরা কেউই ভারতবিরোধী কোনো বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন কিনা জানা নেই। ইউনূস স্যার যখন আসলেন, তখন ভারতের ডিপ্লোম্যাটরা সবাই উঠে দাঁড়ালেন, কয়েকজন হাত উঁচু করে আদাবও দিলেন। এটাই কার্টেসি। অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। ভারত আগে এসে বসে আছে মানেই তারা মিটিংয়ের জন্য অধিক আগ্রহী বা চাপে পড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এমনটা নয়। হতে পারে তারা যথাসময়ে এসে বসেছেন আর আমরা একটু বিলম্বে এসেছি। দেখবেন মোদিজী এক হাতের বিপরীতে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্যার দুই হাত এগিয়ে মোদিজীকে চেপে ধরলেন। এটাও সৌজন্য। এই কথাগুলি বলছি কারণ আমাদের কিছু আবাল এসব নিয়েও পাড়ার কাকিদের মতো নোংরা কথা বলে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার ব্যাংককে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে একটি ছবি উপহার দিচ্ছেন। ছবিটি ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ১০২তম ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত থেকে অধ্যাপক ইউনূসের স্বর্ণপদক গ্রহণের মুহূর্তকে তুলে ধরছে। অর্থাৎ জুলাই আন্দোলনের ছবি বা বইটি কিন্তু তিনি মোদিজীকে উপহার দেননি। এসব বাদ দিয়েই তিনি মিটিংয়ে বসেছেন বা বসতে পেরেছেন। সুতরাং এটাও জুলাইপন্থীদের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা।
বয়কটিদের এরপরেও অস্ত্র একটাই-- অপপ্রচার। তারা বলে বেড়াবে অধ্যাপক ইউনূস একজন নোবেল লরিয়েট, তাঁর সাথে একজন 'চা বিক্রেতা' মিটিং করতে পারছে, উপরে বসতে দিছে-- এটাই অনেক! অলরেডি AI দিয়ে এমন ছবি বানিয়ে গতরাত থেকে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে! চা বিক্রেতার পেশাটা ভারতে অনেক সম্মানজনক। এই দেশ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে ভারতে গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে লাখ লাখ মানুষ কলকাতায় ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে চা বানিয়ে পেট চালায়। ঐ দেশে কোনো পেশাই ছোট নয়। একজন চাওয়ালা থেকে ভারতের মতো বড় দেশের বারবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোদিজী, এজন্য তাঁর প্রশংসা করা উচিত, হাসি-তামাশা নয়।
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত দিতে বাধ্য নয়। তবে এটাও ঠিক তাঁর ও তাঁর দলের নেতাকর্মীদের অনেক দোষত্রুটি ছিলো, অনেক অন্যায়-দুর্নীতি তারা করেছেন। করেছেন বলেই পালিয়ে বিদেশে আরামের জীবন যাপন করছেন, দেশে বসে স্বনামে কলম ধরারও তেমন কেউ নাই, রাজপথ দূরের কথা, ধানমণ্ডি-৩২ কিংবা পার্টি অফিস বাঁচাতে কেউ যায়নি। আমার মতো মানুষকেও তাঁর বেয়াইর লোকজন ১৬ বছর ধরে নির্যাতন করে যাচ্ছে। এখন মন্ত্রীত্ব নেই, এমপিত্ব নেই, রাজনীতিও নেই, তবুও সুইজারল্যান্ডে বসেও তিনি আমাদেরকে ফরিদপুরে একঘরে করে রেখেছেন। আমি ও আমার মা কোথাও দাওয়াত পাইনা, আমাদেরকে পূজায় অংশ নিতে দেয়া হয় না। আমার বাবা কবি বাবু ফরিদী ফরিদপুরের মূখ্য সংগঠকদের একজন হলেও তাঁর নামটাও সেভাবে কেউ উচ্চারণ করে না, তাঁর মৃত্যুরহস্য এখনও তদন্ত করে না প্রশাসন, কোনো সাহিত্য বা সামাজিক সংগঠনে আমাদেরকে কমিটিতে রাখা হয় না। ফেসবুক ছবির অ্যালবামে এখনও এইসব নির্যাতনের কথা লিখে যাচ্ছি। এর পিছে প্রথম আলোর ফরিদপুরের নিজস্ব প্রতিবেদকও জড়িত।
তো, লীগের নেতাকর্মীদের এটা ভাবাও ঠিক না যে ভারত সবসময় তাদেরকে সাপোর্ট দেবে। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে এখানে কী হচ্ছে সেই খবরও তাঁদের কাছে থাকে। ভারত দেখবে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় আছে কিনা, এই অঞ্চল তাঁদের জন্য হুমকির কারণ হচ্ছে কিনা। যে সরকারই এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারবে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে তাঁদের সাথেই কাজ করবেন তাঁরা। এর বেশি বা কম কিছু ভাবার সুযোগ নেই।
তবে এই মিটিংয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট: এখন থেকে দেশে আর ভারতবিদ্বেষী বক্তব্য বা কাজকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দেওয়া হবে না। হাসনাতরাও আর 'দিল্লী না ঢাকা' শ্লোগান দেয় না অনেকদিন। এমনিতেও তারা ডাকলে এখন আর ২০০ লোকও রাজুতে আসে না। তারাও বুঝে গেছে পাকিস্তান বা চীনের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে ভারতকে দূরে ঠেলে এই অঞ্চলে রাজনীতি করার ফল ভালো হয় না। কাজেই, উভয় দেশের মঙ্গল হয় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই উত্তম। আজকের এই মিটিং সেই সিদ্ধান্তেরই প্রথম ধাপ এবং পিনাকী-ইলিয়াস-ব্যা. ফুয়াদ ও তাদের চ্যাংড়া ছানাপোনাদের মতো ভারতবিদ্বেষীদের মুখে একদলা থুতু। দেব দুলাল গুহ -- দেবু ফরিদী।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৪২