somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবর্তনে বাংলার গান: আজকের হালচাল

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
এফ.এম রেডিও শোনা হয় কেবল অফিসের গাড়িতে চড়লেই। বিশেষ করে জ্যামে আটকা পড়লে টাইম পাসের জন্য এফ.এম রেডিও এর চ্যানেলগুলো ঘুরাতে থাকি। রেডিও ফুর্তি, এবিসি, রেডিও টু-ডে, রেডিও আমার। ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রায়দিনই ডেইলী নিউজ পেপারটা না পড়েই গাড়িতে চড়ে বসি- ফলে দিনের প্রথম খবরগুলো পাই এই রেডিও চ্যানেলগুলো থেকেই। ঘন্টায় ঘন্টায় খবর প্রচারিত হয়- ঐ সময়টাতে গাড়িতে থাকলে তা শুনি। বাকি সময়টাতে এ্যাড আর বকর-বকর এর ফাঁকে ফাঁকে গান- গানের খোঁজে এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরাঘুরিও কম করা হয় না। যাহোক, আজকের পোস্টের মূল উদ্দেশ্য এফ.এম রেডিও নয়, গানবাজনার হালচাল নিয়ে দু-চার কথা বলতে চাই। এবং শুরুতেই বলে নিচ্ছি যে, এসমস্ত বিষয়ে আমার জানা-বুঝা খুব কম, এগুলো সম্পর্কে আমার কিছু অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে আমার অনুভূতি, মনোভাব এগুলোই একটু লিখতে চাচ্ছি।

মূলত এফ.এম রেডিও'র সুবাদে আজকালকার গানগুলো শোনার সুযোগ হয়। অনকে সময়ই রেডিও জকিদের বকর বকর এভোয়েড করা সম্ভব হয় না বলে শ্রোতাদের পাঠানো ম্যাসেজগুলোও শুনি, সেখান থেকে আজকের ইয়ং জেনারেশনের (ধারণা যে- ইয়ংরাই- টিনএজাররাই মূল শ্রোতা) পছন্দ/অপছন্দগুলো বুঝার চেষ্টা করি। ৩১ ডিসেম্বরে কোন রেডিও চ্যানেলে যেন শ্রোতাদের জরিপে ২০০৯ সালের সেরা ১০ গান নির্বাচিত করা হয়েছে- যার ১ম গান হাবিব-ন্যান্সি জুটির দ্বিধা, এছাড়াও আছে ফুয়াদ, শিরিন, বাপ্পা, মিলা, আনিলা .... এমন নানা নাম এবং আরো কিছ ব্যান্ডের নাম (অনেকের নাম আসলে মনে রাখতে পারিনি)। এফ.এম রেডিও এর কল্যানে জনপ্রিয় এ গানগুলোর অধিকাংশই শোনা হয়েছে। এগুলো শুনতে কেমন লাগে, কি অভিজ্ঞতা সেটা দিয়েই শুরু করি।

গত ডিসেম্বর মাস ছিল বিজয়ের মাস। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গানগুলো (স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের গান) রেডিও চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়েছে। এটাই কাম্য। ছোটবেলা থেকেই ১৬ই ডিসেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চে পাড়া-মহল্লায় মাইকে, টেলিভিশনে এই গানগুলো শুনে আসছি। এফ.এম রেডিওতেও এ গানগুলো প্রচারিত হবে- সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার ডিসেম্বরে অবাক হয়ে প্রথমে শুনলাম নজরুলের একটা বিখ্যাত গান: "দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! ..."- কান্ডারী হুশিয়ার গানটি। অবাক হলাম, কারণ এই অসাধারণ গানটি এতদিন যেভাবে শুনে এসেছি- এবার সেভাবে নয়- একটু অন্যভাবে শুনলাম। বিকট সব আওয়াজ, বাজনা- যাকে মনে হয় বলা হয় হার্ড মেটাল, এবং সেই সাথে উৎকট চিৎকার-চেচামেচি। ব্যান্ড আর্টসেলের পরিবেশনা। শুধু এই একটি গান নয়- পুরো ডিসেম্বর জুড়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোর অনেক কটিরই এইরকম উৎকট পরিবেশনা পর্যায়ক্রমে সবগুলো চ্যানেলে চলেছে (তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর, নোঙ্গর তোল, রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, সোনায় মোড়ানো বাংলা, একটি ফুলকে বাচাবো বলে, পূর্ব দিগন্তে- কে গেয়েছে তা মনে নেই)। অবাক ব্যাপার- এই গানগুলো যাতে না চালানো হয়- এমন প্রতিবাদ বা অনুরোধ সম্ভবত রেডিও জকিরা পায়নি এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই গানগুলো বাজানোর জন্য মাঝে মধ্যেই শ্রোতারা অনুরোধ জানাতো!! আমি বেশ কনফিউজড- এগুলো কি কেবল আমার কানেই এমন যন্ত্রণার অনুভূতি তৈরী করছে? অন্যদের কি মত? সমর্থন পেলাম কলিগের কাছ থেকে- সেও প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রেডিও বন্ধ করতে বলে। কিন্তু কলিগের বয়স তো আমার বয়সের কাছাকাছি- মানে আমরা একই জেনারেশনের- নতুন জেনারেশনের আর সবার টেস্ট কেমন? বুঝতে পারছি না।

কিছু বিপরীত যুক্তিও শুনলাম। বেশ অকাট্য যুক্তি। যুক্তি খুব শক্ত হলেও কেন যেন মানতে পারছিলাম না। বেয়াড়াভাবে পাল্টা প্রশ্ন করতে থাকি...
: গানগুলোর প্রেজেন্টেশন যেমনই হোক- আজকের ছেলে-পেলেরা এর ফলেই এইসব গান বেশী করে শুনছে। অন্তত আমাদের সময়কার চেয়ে এখন এসব গানের চর্চা বেশী হচ্ছে- ইয়ং জেনারেশন এই গানগুলোতে আকৃষ্ট হচ্ছে।
: ঐ গানগুলো এভাবে শুনেই বা কি লাভ? কোথায় অরিজিনাল গান আর কোথায় এসব চিল্লা-ফাল্লা!
: এগুলো হচ্ছে নতুন সময়ের নিদর্শন, সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই বিবর্তিত হয়। এটাকে তো মানতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে- বিবর্তনের পথে আমাদের রুটকে পুরো অস্বীকার করা হচ্ছে কি না! এইদিক থেকে মনে হয়- আজকে স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের গানগুলো, লালনের গান, ফোক গান, প্রান্তিকজনের গানগুলোর চর্চা হচ্ছে। এটাকে তো পজিটিভ বলতেই হবে।
: কিন্তু যে ঢং এ চর্চাটা হচ্ছে- তাতে ভালো কিছু হচ্ছে? লালন ব্যান্ডের গাওয়া লালনের গান, আর্টসেলের গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, শিরিনের গাওয়া শেফালি ঘোষের গানে অরিজিনাল লালনের গান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, শেফালি ঘোষের গানের ছিটেফোটাও কি পাওয়া সম্ভব? চিৎকার করে "দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার" গাওয়া আর চিৎকার করে "ওহু- আহু- ইয়া" টাইপের গান- দুয়ের মধ্যে কি পার্থক্য?
: পার্থক্য তো আছেই। "আমি একাকী" বলে চিৎকার করা আর "দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার" বলে চিৎকার করার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। এসব গান এখন যেভাবেই গাওয়া হোক না কেন- এদের মাধ্যমে অন্তত পরিচিতিটা তো ঘটছে। পরে শ্রোতারা যখন অরিজিনাল গান শুনবে- তখন নিশ্চয়ই পার্থক্যটা ধরতে পারবে। আনুশেহ'র মুখে লালন শুনে পরে ফরিদা পারভীনের ভক্ত হয়েছে এমন নজীর অনেক আছে।
: আমার সন্দেহ আছে। হাবিবের মাধ্যমে শাহ আব্দুল করিম, লালন ব্যান্ডের মাধ্যমে লালন, শিরিনের মাধ্যমে শেফালি ঘোষ, আর্টসেলের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোতে আদৌ কেউ ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না! এইসব শুনলে তো কানটাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা!
: কান এত সহজে নষ্ট হওয়ার জিনিস না। একটা বয়সে একটু হই হুল্লোড় ধাচের গান সবাই শুনে, পরে ধীরে ধীরে এমনিতেই রুচি পরিবর্তিত হয়। সবচেয়ে পজিটিভ দিক হচ্ছে- দশ বছর আগেও ঝাকা-নাকা টাইপের গানের জন্য আমরা হিন্দী-ইংলিশ গানের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। কোন পার্টিতে, বা ঈদে-পুঁজায় পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সী ছেলেরা সাউন্ড বক্স এ হিন্দী গান যে হারে বাজাতো আজ কিন্তু তা অনেক কমেছে। কেননা, সাউন্ড বক্সে বাজানোর মত গান আজ এখানেই তৈরি হচ্ছে।
......

তারপরেও আমি কনফিউজড। বুঝতে পারি না- এসবে ভালো কি হচ্ছে! আমার কাছে হিন্দী "ওলে ও - ওলে ও অ", বা "তু তু তু তারা" আর শিরিনের "মাতোওয়ালি", "পাঞ্জাবিপয়ালা" বা মিলার গানগুলোর মধ্যে ইতর বিশেষ নেই। আর, রেমিক্সের নামে যেগুলো হচ্ছে- শচীন দেব বর্মনের গান, বা চিত্রা সিং এর গানগুলোকে যেমনে গাওয়া হচ্ছে- শুনলে তো মেজাজ খারাপ হয়ে যায়! যেসময় ব্যান্ড ফিডব্যাক আর মাকসুদের গান খুব শুনতাম (এবং যখন রবীন্দ্র সংগীত শুনতে তেমন একটা ভালো লাগতো না- বাবা-মামাদের শুনতে দেখতাম ও ভাবতাম এগুলো বুড়োদের গান)- সেই সময়েও মাকসুদের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত খুব খারাপ লেগেছিল এবং প্রিয় একজন শিল্পী এমন যখন জঘণ্য কাজ করেছে বিধায় লজ্জিতও হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হলে বিভিন্ন রুমে ফুল ভলিউমে যখন আনুশেহ'র লালন বাজতো- লালনের ও ফরিদা পারভিনের ভক্ত হিসাবে- তখনও খুব খারাপ লাগতো। তারপরেও আনুশেহ'র গান শুনে মনে হয়েছে- তার গায়কি খুব একটা খারাপ না- কেবল মডার্ন মিউজিকের আধিক্য বাদ দিয়ে দেশীয় ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করলেই তা উতরে যেত! কিন্তু- এখন লালন নামের ব্যান্ডের মেয়েটা যা গায়- সেটা পুরো অখাদ্য ছাড়া কিছুই মনে হয় না।

পাশ্চাত্য বাজনার আধিক্যকে মনে হয় সকলে এখন স্বাগতই জানায়, অন্তত আমার মত সেকেলে অবস্থায় থাকতে কেউ রাজী নয়! এমন ধারণা হয়েছে- জাতীয় সম্পদ রক্ষা সংস্কৃতি মঞ্চের সাংস্কৃতিক সমাবেশে উপস্থিত হয়ে। সেখানে অরূপ রাহী'র গানে ঢিম-ঢুম আওয়াজে তার চিৎকারও পর্যন্ত ঠিকভাবে বুঝতে পারছিলাম না। অথচ খালি গলায় রাহীর "তুমি সেই সোনার কিষাণ" গানটা শুনে ভালোই লেগেছিল। সংস্কৃতি মঞ্চে যখন পাশ্চাত্য মিউজিকের আধিক্য সহকারে গানগুলো গাওয়া হচ্ছিল- এমনকি সমগীত কিংবা কৃষ্ণকলির গাওয়া গণসংগীতেও যখন একই অবস্থা দেখি, তখন বুঝতে পারি- এতো আমারই সমস্যা! যুগের আহবানকে অস্বীকার করা মোটেও উচিৎ নয়। আর, "সংস্কৃতি মঞ্চ" যুগের সাথে তাল মেটাবেই না বা কেন?

আসলেই কি তা-ই? আপনাদের কি মত?
=============================================

দুই
আরো বেশ কিছু যুক্তি পাচ্ছি। সেগুলোকে নিয়ে এবং আমার কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন/আলোচনা নিয়ে এই পর্বটা কন্টিনিউ করছি:

: আসলে ব্যাপারটা সময়ের চাহিদা ছাড়া কিছুই না, আপনার কাছে শুনতে খারাপ লাগছে বা আমার কাছে শুনতে খারাপ লাগছে সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, বড় ব্যাপার হচ্ছে যে অনেকেই এই সব গান শুনছে, মানুষ শুনছে জন্যই তৈরি হচ্ছে .....। গান তো আমরা শুনি বিনোদন পাওয়ার জন্যে, আনন্দ পাওয়ার জন্য, কেউ যদি এসব শুনে আনন্দ পায় তাহলে আনন্দ পাক না! তাদের সাথে হয়তো আপনার রুচিটা মিলছে না... একেক জনের রুচি একেক রকম হবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
: একেক জনের রুচি একেক রকম হবে- এটা যেমন স্বাভাবিক- তেমনি নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট ধরণের রুচি দেখা যায়- যেখান থেকে এটাও বুঝতে পারি যে- এই রুচিগুলো বাই বর্ণ পাওয়া না- এগুলো তৈরি হয়- চর্চার মাধ্যমে পরিপুষ্ট হয়। মাকসুদের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতের বিরুদ্ধে ছায়ানটকেই সবচেয়ে বেশী সোচ্চার দেখেছিলাম। ফরিদা পারভিনকে যখন সাক্ষাতকারে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, "আজ যে লালনের গান নিয়ে ফিউশন হচ্ছে- সেগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?"- তার জবাবে তিনি বলেন: "ফিউশন হচ্ছে- হতেই পারে- কিন্তু সবার আগে তো এগুলোকে শ্রাব্য হতে হবে। আজ যা হচ্ছে- তার কোনটা কি শ্রাব্য?" একজন যে বিশুদ্ধ সঙ্গীতের শ্রোতা অর্থাৎ রবীন্দ্র-নজরুল বা ক্লাসিকাল মিউজিক এর যে শ্রোতা বা যে এধরণের সঙ্গীতের চর্চার মধ্যে আছেন- তাদের কাছে - তাদের কানে আর্টসেল, ব্লাক, অর্থহীন, মিলা, শিরিনদের গান বা চিৎকার চেচামেচী ও উৎকট বাজনা কেমন লাগতে পারে? প্রশ্নটা উল্টোভাবে করলেও জবাব কি মিলবে (অর্থাৎ আর্টসেল, মিলা, শিরিনদের গানের শ্রোতাদের কাছে ক্ল্যাসিকাল মিউজিক কেমন লাগে)?

আবার, সবাই বা বেশীরভাগ কি গান পছন্দ করছে- সেটা দিয়েও ভালো গানের বিচার করা কি যায়? এ মুহুর্তে বাংলাদেশে ক্যাসেট/সিডি বিক্রির তালিকার শীর্ষে আছে মমতাজ ও আসিফ- অথচ এদের গানের রিকোয়েস্ট কিন্তু রেডিও চ্যানেলগুলোতে তেমন শুনিনি। এখানে ক্লাসটাও গুরুত্বপূর্ণ। হার্ড রক, হেভি মেটাল গান কাদের টানছে? তাহলে এই রুচির পার্থক্যটা গোষ্ঠীভেদে, শ্রেণীভেদে পার্থক্য হচ্ছে কেন? সিনেমার ক্ষেত্রেও একইরকম প্রযোজ্য। মধ্যবিত্তদের হলে টানার জন্য তানভির মোকাম্মেল, হুমায়ুন আহমেদ, মোস্তফা সারোয়ার ফারুকি, তারেক মাসুদরা যতই চেষ্টা চরিত্র করুক না কেন- এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মান্না বেঁচে থাকতে মান্নার হাতেই সবচেয়ে বেশী সিনেমা থাকতো। শোবিজ জগতে ডিপজলের ডিমান্ড যেকোন সময়েই জাহিদ হাসান, অপি করিম, চঞ্চল চৌধুরী'র চেয়ে বেশী। মানে- এগুলোরও কাটতি মানুষের কাছে ছিল বা আছে- যতই মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর দর্শকেরা নাক সিটকাক না কেন (অবশ্য উচ্চবিত্তদের জন্য আছে হলিউডি, বলিউডি মুভি- স্টার সিনেপ্লেক্সে কোন ধরণের সিনেমাগুলো স্থান পায়- সেটাও খুব দ্রষ্টব্য)।

এখন কথা হচ্ছে, ময়ুরির নাচের কাটতি খুব আছে বলেই কি- সেটা খুব ভালো কিছু? অন্যের রুচি নিয়ে আমি আপত্তি তুলছি না, তাদের রুচিকে উড়িয়েও দিচ্ছি না। মান্না/ময়ুরির সিনেমা বা আসিফ-মমতাজ (মমতাজের কন্ঠ মানে গলা আমার খুব ভালো লাগে)-আর্টসেল-অর্থহীন-শিরিন-মিলার গানগুলো বন্ধ করার কথাও বলছি না, বরং বন্ধের বিরোধিতাই করি। কারণ- মেইনস্ট্রিমের বাংলা সিনেমাগুলোর যারা দর্শক- তাদের সিনেমাই হচ্ছে একমাত্র বিনোদনের জায়গা, সেটাকেও তো কেড়ে নিতে পারি না। ভালো কিছু দিতে না পারলে- এগুলোই তারা দেখবে- এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে, শিরিন-মিলা-হাবিবরা, আর্টসেল-ব্লাকরা যাদেরকে আকৃষ্ট করছে- সেই ডিজুস জেনারেশনকেও তো অলটারনেটিভের স্বাদ দিতে হবে আগে। শুন্যতা তো সেখানেই! আর- সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে বাজার সংস্কৃতি। বাজার যখন সংস্কৃতিকে গাইড করে তার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু হয় না- সেটার ফলাফলই হচ্ছে এসব কিছু।

: একটু চিন্তা করে দেখুন আপনার সময় আপনি যে গানগুলো বা তার প্রেজেন্টেশন স্টাইলকে খুব ভালো বলে জেনেছেন তাকেই আপনি ভালো বলছেন... এখন যারা এই সব শুনছে তারাও তো তেমন ই বলতে পারে ....
: হ্যাঁ - এটাতো স্বীকার করিই। একটা সময়ে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের গানের যতটুকু চর্চা ছিল- ভালো না লাগলেও পরিবারের গার্জিয়ানেরা যতখানি বাজাতো- তা শুনতে হতো; এখন সে পরিমাণ চর্চা হয় বলে মনে হয় না। বা চর্চা না হলেও- সেসময়ে কিম্ভুত গানগুলো অত শুনতে হতো না। ডিশ কালচার ছিল না, বাংলা চ্যানেলও এত এত ছিল না। সবে ধন নীল মনি ছিল বিটিভি। বিটিভি'র যতই সমালোচনা থাকুক না কেন- এর একটা দায়িত্ববোধ ছিল। সেদিন মোস্তফা মনোয়ারের এক সাক্ষাতকার শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন: "প্রাইভেট বাংলা চ্যানেলগুলো দেখতে পারি না। সবগুলোর প্রায় সব অনুষ্ঠানই এত তরল যে দেখা যায় না। এরা তো কেউ কোন রেসপন্সিবিলিটি নেয় না। দেখুন- বিটিভিতে আমরা প্রতিরাতে ১১টা, সাড়ে ১১ টায় সুর লহরী নামে একটা অনুষ্ঠান প্রচার করতাম। গোটা বাংলাদেশ মিলে এর দর্শক খুব বেশী হলে কত হবে? পাঁচ হাজার? বা তারো কম? তারপরেও এটা প্রচার করা হতো। এটাই হলো দায়িত্ববোধ"। (মূল ভাবটা নিজের ভাষায় লেখা)।

আজকে আসলেই- চর্চাটা নেই। টিভি চ্যানেল ঘুরালেই মিউজিক এক্সপ্রেস, গ্লামার ওয়ার্ল্ড, .... আরো নানা ধরণের গানের অনুষ্ঠান, এফ.এম রেডিওতেও গান বাজছে- কিন্তু এগুলোতে সারাদিন চলছে মিলা-শিরিন-হাবিব-ফুয়াদ। ফেরদৌসিকে, নীলুফার ইয়াসমিনকে, কলিম শরাফিকে, কাদেরি কিবরিয়াকে চিনবে কেমনে? মনে আছে- ছোটবেলায় বিটিভিতে সন্ধার সময়ে পল্লীগীতির অনুষ্ঠান হতো- ঐ সময় সে গানগুলো নিজ থেকে মোটেও শুনতাম না; তারপরেও দেখা গেছে- নানা বেড়াতে আসলে- তার কোলে বা পাশে বসে শুনছি- কারণ নানার ঐ অনুষ্ঠানই ছিল প্রিয় অনুষ্ঠান। এসো গান শিখি নামে একটা অনুষ্ঠান হতো, সেটা দেখার জন্য মা-বাবা উৎসাহিত করতো। এই চর্চাগুলো না থাকলে- আমার মনে হয়, আমার রুচিটা পরিবর্তিত হতো না। মাইলস-সোলস-ফিডব্যাক-জেমস বা এ.আর.রহমান বা এইস অব বেইস, মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, এভারগ্রীন লাভ সংস- এগুলোও এককালে খুব শুনেছি স্বীকার করছি! কিন্তু অলটারনেটিভগুলোও তখন খুব এভেইলেবল ছিল।

: হয়তো আর্টসেল এর ঐ গানটার প্রেজেন্টেশন আপনার ভালো লাগেনি, ঠিকাছে ভালো না-ই লাগতে পারে ... এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আপনি আর্টসেলের "দুঃখ বিলাস", "অনিকেত প্রান্তর", "ধুসর সময়" এই গানগুলো শুনলে মনে হয় আর্টসেল সম্পর্কে আপনার ধারণা বদলে যাবে ..... আর আর্টসেল হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রগতিশীল মেটাল ব্যান্ড। শুধু আমাদের সংস্কৃতি না বর্তমান পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সাথে তুলনা করতে গেলেও আর্টসেলই বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য সেরা ব্যান্ড।
: ইউটিউবে "দুঃখ বিলাস", "অনিকেত প্রান্তর", "ধুসর সময়", "চিলে কোঠার সেপাই", "উৎসবের উৎসাহে" গানগুলো শুনলাম। এবং দুঃখের সাথে জানাতেই হচ্ছে- আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি বলাটাও যথেস্ট মনে হচ্ছে না- আমার কাছে ফালতু মনে হয়েছে, এবং "অনিকেত প্রান্তর" গানটা ৯ মিনিট ধরে শুনতে গিয়ে মাথা ধরে গিয়েছিল। (যাদের এসব গান খুব ভালো লাগে - তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি- এভাবে বলার জন্য, এটা একান্তই আমার অনুভূতি ও রুচি)। গানগুলোর সুরে কিছুই পেলাম না হই হুল্লোড় ছাড়া, গায়কের গায়কি/কন্ঠ/গলা একঘেয়েমি ফ্ল্যাট - মনোটোনাস (ব্ল্যাকের তাহসানের গলাও তো দেখি একইরকম, মেটাল যারা গায়- সবার গলা একই রকম নাকি?)। এরা কি কেউ গলা সাধে না নাকি? কলিম শরাফী, নীলুফার ইয়াসমিন, ফরিদা পারভিন ... এনাদের কন্ঠ, কন্ঠের কারুকাজ, উঠা নামা- নিয়ন্ত্রণ- এগুলো কি রাতারাতি হয়েছে? কি পরিমাণ সাধনা করতে হয়- আজকালকার এই সব হিট গায়করা কি তা জানে? শচীন কর্তার গানের একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখানে কিরন চন্দ্র নিজেকে শচীন কর্তার শিষ্য হিসাবে উল্লেখ করে বলছিলেন : "সারাজীবন সাধনা করেও শচীন কর্তার গান শুদ্ধভাবে গাওয়া সম্ভব না। তাই আমি শচীন কর্তার গান গাওয়ার সময়ে সব সময়ই খুব ভয়ে থাকি- খুব নার্ভাস থাকি, এই বুঝি ভুল করে বসলাম!" আর, কি অবলীলায় শচীন কর্তার গানের রিমিক্স করে যায়! এমন শিল্পীকেও চিনি যিনি নজরুল একাডেমি, বুলবুল একাডেমিতে পাঁচ/সাত বছর শিখেও স্টেজে উঠতে ভয় পান- এখনো নজরুল সঙ্গীতটা ঠিকভাবে আয়ত্ত করা হলো না বলে- আর এরা অবলীলায় "দুর্গম গিরি ..." গেয়ে যাচ্ছে! চর্চার দরকার কি- নিজেরা যেভাবে যে স্টাইলে গাইলো- সেটাই তো সবাই খাবে। ফলে কোন সমস্যা তো নেই!

আর, সবচেয়ে প্রগতিশীল মেটাল ব্যান্ড বলতে কি বুঝায়? মেটাল ব্যান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল? অন্য মেটাল ব্যান্ডের সাথে তুলনা করতে পারবো না- কারণ কোন মেটাল ব্যান্ড সম্পর্কেই জানি না। কিন্তু প্রগতিশীলই বলা হচ্ছে কোনদিক দিয়ে? "প্রগতিশীল" আসলে কি বুঝি? এরা কি করেছে? পাশ্চাত্যে বিটলস, জ্যাজ এমন অনেক গোষ্ঠীকে প্রগতিশীল বলা হতো, কারণ তারা মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জড়িত ছিল, রাস্তায় রীতিমত পুলিশের সাথে ফাইটও করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে, কালো মানুষের লড়াইয়ে অনেক প্রগতিশীল গান হয়েছে। পিট সিগাল তো জেলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানকার মেটাল ব্যান্ডগুলো কি করেছে? আমি আসলেই জানি না। আর, বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্টের কথা যেটা হচ্ছে- সেটার সাথে মোটেই একমত নই। আমাদের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে একমাত্র আমার দেশের কৃষ্টি-কালচার। পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করে আমরা যেগুলো তৈরি করছই- তা ককরে আমাদের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে?

: মেটাল গানের চিৎকার (screaming) অনেকেই সহজভাবে নিতে পারেনা। কিন্তু আমরা যারা মেটাল ভালবাসি তাদের কাছে এটা হলো আবেগের বহিপ্রকাশ। আমি উদাহরণ দিয়ে বলি:
আর্টসেলের "উতসবের উতসাহে" গানটির কথা এরকম:...
"তখন ভাঙতে হবে ঘর, হাতে রেখে হাত
হেরে যাওয়াকে বন্দি করে রেখে
জাগতে হবে রাত আলো জ্বেলে রেখে
উতসবের উতসাহে"
আপনি গানটা শুনলে বুঝবেন গানটা মেটাল/ হার্ডরক হওয়াতে এটা আবেগের যে প্রকাশ হয়েছে সেটা অন্যভাবে হয়তো হতনা। মেটাল গান আমাদের আবেগ বুকের গভীর থেকে টেনে বের করে আনে। বর্তমান তরুন সমাজ হতাশাগ্রস্থ, আমাদের জীবন খুব জটিল, এটা আমাদের চেয়ে ভালো কেও বুঝেনা, আমরাও একে অপরেরটা বুঝিনা, হতাশার মূহুর্তে মেটাল গান সাথে ঠোট মিলিয়ে আমরা আবেগটাকে বাইরে ছুড়ে দিতে পারি। মেটাল গান আমাদের অনেকভাবে অনুপ্রেরনা দেয়।
"লক্ষ্য হারিও না, স্বপন ছেড়না, ডাকছে জীবন তুমি বসে থেকনা,
তুমি কি সাড়া দিবে, আবারো কি সাড়া দিবে?"
ব্ল্যাকের গানের এ লাইন যে আমাকে কত সময় অনুপ্রেরনা দিয়েছে আমি বুঝাতে পারবনা, লিরিকস নয় গান গাওয়ার ধরনের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।
মেটালিকার এ গানের screaming শুণ অনেকেই ভাবে এটা কি কোনো গান?
অথচ লিরিকস দেখেন:
"Lady Justice Has Been Raped... See More
Truth Assassin
Rolls of Red Tape Seal Your Lips
Now You're Done in
Their Money Tips Her Scales Again
Make Your Deal
Just What Is Truth? I Cannot Tell
Cannot Feel"
আপনি হয়তো গানটাকে বলবেন "চিৎকার" কিন্তু এই চিৎকার আমার কাছে বাস্তবতাকে ঘিরে কিছু আবেগের প্রকাশ।

: এবারে চিৎকারের একটা উপযোগিতাও বুঝতে পারছি। অর্থাৎ এইভাবে গাওয়াটা এক রকম আবেগের বহি:প্রকাশই বটে। এবং এখান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করাও সম্ভব। আমি আসলেই জানতে চাচ্ছিলাম ও বুঝতে চাচ্ছিলাম - এই গানগুলো কেন অনেকের এত ভালো লাগছে, এগুলোতে আসলে কি আছে, কোন উপাদানের জন্য এই জেনারেশন এই গানগুলোর এত ভক্ত! ভালো লাগার কিছু কারণ/উপাদান পাওয়া গেল। এই ঢং এ গাওয়াতে আবেগের যে বহিপ্রকাশ ঘটে সেটা শ্রোতাকে নাড়া দেয় এবং অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা অনেকে কেন সেই আবেগটাকে ধরতে পারছি না? আমাদেরই সীমাবদ্ধতা হয়তো! অনুপ্রেরণাটাও পাচ্ছি না- কারণ গানটাই যখন বিরক্তি উদ্রেক করছে- তখন এর কথায় মনোযোগ দেয়ার উপায় থাকে না। ভাবছি- "মুক্ত করো ভয়- আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়", বা "ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু- পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু" বা "হাল ছেড়ো না বন্ধু- বরং কন্ঠো ছাড়ো জোরে" বা "ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথীরে", বা "কিসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের ..", "পাল উড়াইয়া দে", "কারার ঐ লৌহ কপাট" প্রভৃতি যেসব গান আমাদের দারুন অনুপ্রেরণা দেয়- সেগুলো কি এসব মেটাল গানের শ্রোতারা শুনে, বা শুনলে কি তারা কোন অনুপ্রেরণা পায় না? (অনুপ্রেরণার জন্যে কেবল এই গানগুলোই শুনতে হবে- ওগুলো শুনা যাবেনা তা বলছি না)। আর, সঙ্গীত তো কেবল অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্যে না, মনের নানা বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে সঙ্গীতের কাজ কারবার, - কোন এক বইয়ে পড়েছিলাম শিল্পের সংজ্ঞা যদি হয় অনুভূতির এবস্ট্রাকশন, তবে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ শিল্প হচ্ছে সঙ্গীত কলা এবং তারো মধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে উচ্চমার্গীয় শিল্প হচ্ছে ক্ল্যাসিকাল মিউজিক (ইন্সট্রুমেন্টাল ও ভোকাল)। অনুভূতির সূক্ষাতিসূক্ষ্ম জগতে কি বিচরণ করতে পারে এই হার্ড মেটাল গানগুলো?

: রিমিক্স ব্যান্ডের ব্যাপারে আরো আলোচনা দরকার। মডার্ণ ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে পুরানো গান মূল সুর বজায় রেখে ক্লাসিক গান শালীনভাবে গাওয়া হলে সেটা কোন চোখে দেখবেন?
: তাহলে কি সেটাকে আর রিমিক্স বলা হবে? সুমন তো গিটারেও রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন। সেতার আর তবলা দিয়ে রাগ নির্ভর রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটা প্রযোজনা শুনেছিলাম- বাজনাটাই মূল- ফাঁকে ফাঁকে শ্রীকান্তের কন্ঠ, অসাধারণ একটা কাজ। লালনের গানও তো ফরিদা পারভিন হারমোনিয়ামে গেয়েছেন- দোতারা, একতারা ছাড়া আরো অনেকেই গেয়েছেন। সমস্যা কি? ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারটার বিরুদ্ধে কিন্তু বলছি না, বলছি না যে- সঙ্গীত স্রষ্টা প্রথম যে যে ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেছিলেন- সবসময়ই সেটাই করতে হবে। মূল সমস্যাটা সঙ্গীত আয়োজনে, ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারে পরিমিতি বোধে। "আমার সোনার বাংলা" বা "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি" গান যদি গিটারে বা পিয়ানোতে মূল সুরে গাওয়া হয়- আপত্তি কি? কিন্তু ড্রাম সেটে প্রচণ্ড দ্রিম-দ্রুম শব্দ দিয়ে, হাই বিটে যদি এগান গাওয়া হয় বা গানের মাঝে মধ্যে গিটার-পিয়ানোর ঝ্যা-ঝ্যা আওয়াজ যুক্ত করে দেয়া হয়- তবে সেটা কেমন হবে? আর যদি তাল লয়- সব গড়বড় করে "কাণ্ডারি হুশিয়ার" গানটির মত করে চিৎকার করে করে গাওয়া হয়- তাহলে কি বলবেন? বা দু-চার লাইন গাওয়ার পরে তার মধ্যে র‌্যাপ সং ঢুকিয়ে দেন তবে কেমন লাগবে?

: ভাই রিমিক্স সবসময় ই ছিল .. এখনো আছে ... মারত্মক কিছু হয়ে না গেলে ভবিষ্যতেও থাকবে ..। আমার তো মনে হয় যে, যারা এর বিরোধী, তাদের সমস্যা রিমিক্স গান নিয়ে না, তাদের সমস্যা "রিমিক্স" শব্দটাতেই। রিমিক্সের জায়গায় যদি সিডি'র গায়ে লেখা হতো "অমুকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি" অথবা "অমুক স্মরণে", তাহলে দেখা যেত যে বিরোধীরা আর আপত্তি করছে না, মান্না দে যখন নজরুলের গান গায় এবং সুরের কিছুটা অদল বদল করে, তখন কেউ দোষ দেখে না, শ্রীকান্ত যখন হেমন্তের গান নতুন করে গায়, তখন আপত্তি করে না ....। ধরে নিলাম যে আমাদের বাংলাদেশ এর গায়করা এত ভালো গাইতে পারে না জন্যে আসলের কাছাকাছি যেতে পারে না, কিন্তু পুরানো গান গাওয়াটা আমি সমর্থন করি .. কারণ মানুষের মানুষের মানবীয় গুন বা দোষ যাই বলেন- একটা থাকবেই- সেটা হচ্ছে স্মৃতি কাতরতা ..
: দেখুন, আমরা যারা রিমিক্সের বিরোধী তারা সিডি বা ক্যাসেট তো কিনতেই যাবো না, ফলে সেগুলোর কাভারে কি ট্যাগিং আছে তা নিয়ে কোন হেডেকও থাকার কথা নয়। মূল আপত্তিটা করি- অরিজিনাল গানের সুরের বিকৃতিতে। একটা ভালো গানকে বিকৃত ও নষ্ট করা যখন হয়, তখন তার চেয়ে বেদনার আর কিছুই হতে পারে না। আর উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না যখন দেখি- অরিজিনাল গানগুলোর চেয়ে বাজার যখন নষ্ট গানকে অধিক প্রোমোট করে, মূল গানকে যখন নষ্ট গানগুলো রিপ্লেস করতে চায় তখন(গুগল সার্চে অরিজিনাল "কান্ডারী হুশিয়ার" গান খুঁজে পেলাম না, সবই আর্টসেলের পরিবেশনা)।

মান্নার নজরুল গীতিতে কোন বিকৃতি কি আছে? মান্নার গাওয়া নজরুল গীতিকে কি রিমিক্স বলা হয়? আসলে "রিমিক্স" এর সংজ্ঞাটিতেই আপনি বোধ হয় ভুল করছেন। মান্না রীতিমত নজরুলের গানের চর্চা করতেন এবং করেন। যাকে বলে- ওস্তাদের কাছে হাতে কলমে শিখেছেন। এখন নজরুলের গানের বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে গায়কির, সুরের বেশ কিছু এদিক-ওদিক আছে। আমাদের ফিরোজা বেগম আর ভারতের সতীনাথ একরকম গান না, ড: অঞ্জলি মুখার্জী আর ইফফাত আরার গানেও পার্থক্য পাবেন, শাকিল যতই অজয়ের মত গাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, কিছু এদিক ওদিক তো হয়ই। এই পার্থক্যগুলোকে কি আপনি রিমিক্স বলবেন? শ্রীকান্ত যখন হেমন্ত, শিবাজি, সতীনাথ প্রমুখের আধুনিক গানগুলো করেছেন- তখন কি সুর বিকৃত করেছেন? যতই বলা হোক যে- শ্রীকান্তের গলা খুব ফ্ল্যাট, হেমন্ত-সতীনাথের অরিজিনাল গান যারা শুনেছেন, তাদের শ্রীকান্তের গানে মন ভরবে না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে কি শ্রীকান্ত রিমিক্স করেছেন, ঐ গানগুলোতে নতুন সুরারোপ করেছেন- এমন তো কেউ বলতে পারবে না! সাগর সেনের মাধ্যমে রবীন্দ্র সঙ্গীতে আমার প্রবেশ, কিন্তু যখন কলিম শরাফি, কনিকা, সুবিনয় প্রমুখে গিয়ে উপস্থিত হলাম- তখন সাগর সেনের ফ্ল্যাট গায়কিতে তো আর মন ভরে না। সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে কিশোর কুমার কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন, চারুলতা সিনেমার গানটির পরে একটা ক্যাসেটও বোধ হয় বের করেছিলেন। বেশ সমালোচনা হয়েছিল- কারণ তিনি সুর-তাল-লয়ে ভুল করেছিলেন। তিনিও রিমিক্স করেছেন এমনটা কেউ বলেননি, তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার চেষ্টা করেছেন- কিন্তু একিউরেট সুরে গাইতে পারেন নি। পরে নিজেই বুঝতে পেরে- সে চেষ্টা আর করেনও নি।

সুতরাং, মান্না-শ্রীকান্তের উদাহরণগুলো হাবিব, আর্টসেলের রিমিক্সের সাথে কিভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? আমার মনে হয়েছে না বুঝেই এ প্রসঙ্গকে অহেতুক টানা হয়েছে।

... (চলবে .. এই পোস্টেই যুক্ত হতে থাকবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:০২
৫৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×