যুদ্ধের ছয় বছরে প্রচুর টাকা আয় করেন শিন্ডলার। কিন্তু আয়ব্যয়ের এই হিসেবের মাঝেও তার ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান কিছু ইহুদীর জীবন রক্ষার একটি উপায় হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু যখন যুদ্ধে পরাজয়ের আগের বছরে, পরাজয় আসন্ন টের পেয়ে নাৎসীরা সমস্ত ইহুদীদের পোলান্ডের 'আউসভিচ' নিয়ে গ্যস চেম্বারে হত্যা করা শুরু করলো, তখন শিন্ডলার এর কাছে টাকার চেয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোই বড় হয়ে দাঁড়ালো। ছয় বছরের সমস্ত জমানো টাকা ঘুষ হিসেবে নাৎসীদেরকে দিয়ে ১১০০ ইহুদীর জীবন কিনে নেন। নিজ শহরে আরেকটি কারখানা স্থাপন করেন। সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই ত্রুটিযুক্ত যুদ্ধের জন্যে গ্রেনেট ও বন্দুকের গোলা তৈরী করা হতো। পরে মিত্রবাহিনী এই ইহুদীদের উদ্ধার করে। এখনও এসব ইহুদীদের সন্তান-সন্ততিরা শিন্ডলারের কবরে প্রতিবছর সন্মান জানাতে যান।
এই ছবিটি দেখার পরদিনই মনের তাগিদেই মিউনিখ শহর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দুরে 'ডাখাউ' নামের ছোট এক শহরে এক 'কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প' দেখতে গেলাম। আগেও অনেক বার গিয়েছি ওখানে, বাইরে থেকে অতিথি এলে প্রায় প্রতিবারই নিয়ে যেতে হতো।
১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতা দখলের পরই জার্মানীর প্রথম কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প হিসেবে এটি স্থাপন করা হয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ অবধি ২ লাখেরও বেশী বন্দীকে রাখা হয় এখানে। এর মাঝে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ অবধি ২৮০০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত হত্যার কোন হিসেব রাখা হয়নি। বন্দীদের মাঝে বেশীর ভাগই ছিল ইহুদী। বাকী যারা ছিল, তার সাধারণ অপরাধী, জার্মান কম্যুনিষ্ট, জিপসী ও অন্যান্য দেশের নাগরিক।
এই নিশৃংশতার বর্ণণা আমার সাধ্যের বাইরে। কিছু ছবি তুলেছি। প্রতিটি ছবির সামান্য বিবরণও দিলাম। তাছাড়া ছবিগুলোই কথা বলবে।
১) বন্দীদেরকে ক্যম্পে আনার দৃশ্য
২) মিত্রবাহিনীর হাতে মুক্তির দিন। এসময় ৩৩০০০ বন্দী ছিল ক্যম্পে, যদিও ধারণ ক্ষমতা ৫০০০। ক্রেমেটোরিয়াম ছিল লাশে বোঝাই। পোড়ানোর মতো যথেষ্ট কয়লা ছিল না।
৩) লৌহ দরজা, ওপাশে শুধু আর্তনাদ। কিন্তু বলা হতো, কাজেই মুক্তি।
৪) ক্রেমেটোরিয়াম। প্রথমে ঢোকানো হতো একটি ঘরে। বলা হতো পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা। তাই কাপড়চোপড় সব খুলতে বলা হতো। তারপর ঢোকানো হতো গোসল করার ঘরে। উপরে শাওয়ারও ছিল। কিন্তু বাইরের দরজা বন্ধ হবার পরপরই শাওয়ার থেকে জলের বদলে, দেয়ালে ছিদ্র দিয়ে ঢোকানো হতো বিষাক্ত গ্যস। তবে 'ডাখাও' গ্যস চেম্বার কোন এক অজানা কারণে ব্যবহার করা হয়নি।
৫) ক্রেমেটোরিয়ামএর বিভিন্ন ধাপ। বা'দিক থেকে শুরু।
৬) তথাকথিত পরিষ্কার করার ঘর।
৭) গ্যাস চেম্বার।
৮) গ্যাস চেম্বার। উপরে শাওয়ার, দেয়ালে গ্যাস ঢেকানোর ছিদ্র।
৯) লাশঘর। পোড়ানোর আগে।
১০) নুরুন্নেসা ইনায়েত খান নামে উপমহাদেশের কোন বন্দিনী। বৃটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যা। ওনি সহ আরো কিছু মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাফলক।
১১) লাশ পোড়ানোর চুল্লী। আরো তিনটি এরকম চুল্লী রয়েছে।
১২) মুক্তির পর আকাশ থেকে তোলা ছবি।
১৩) বন্দীদের ব্যরাক।
১৪) টয়লেট।
১৫) যাদুঘর।
১৬) বর্বরতার প্রমাণ।
অনেকেই বলবেন এগুলো দেখিয়ে মন খারাপ করানোর কি দরকার। কিন্তু আমার মতে এসব দৃশ্যও মনে রাখা দরকার। আমাদের আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা, নিজেদের ভেতরে লুকানো হিংস্রতাকে প্রশমিত করা, মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবার জন্যে এর প্রয়েজনীয়তা অপরিসীম। জার্মানরা তা প্রতিনিয়তই ভাবে। স্কুল থেকে নিয়িমত শিশুদের ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেজন্যেই প্রয়াত জার্মান চ্যনসেলর উইলি ব্রান্ট পোল্যান্ডের আউশভিচের মরণ ক্যম্পে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০০৭ সকাল ৮:৩৩