আমি বসে আছি ভার্সিটির সামনের শহীদ মিনারটার বেদীতে। আমাদের ভার্সিটির ছেলে মেয়েদের আড্ডা মারার বেশ প্রিয় একটা জায়গা এটা, অবশ্য মেয়ে খুব কম দেখা যায়! আমাদের ভার্সিটিতে মেয়ে আবার খুব কম কিনা! এখনো কেন জানি বাংলাদেশের মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারটাকে খুব একটা পছন্দ করে না নিজেদের জন্য। রাস্তা দিয়ে একের পর এক রিকশা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি। আমি অলস চোখে দেখছি। আইস্ক্রীম ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে গাছের ছায়ায়, ঝালমুড়ি বানানো ছেলেটা ক্লান্ত চোখে দেখছে কেউ আসে কিনা। এখন ক্লাশ টাইম। আমার এখানে বসে থাকার কথা না। আপনাদের নিশ্চই জানা আছে আমাদের ভার্সিটিতে ক্লাশে উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ন।এখানে সব নিয়ম কানুন কিছুটা স্কুলের মতন। আর তা মেনেও চলা হয় বেশ কঠিন ভাবেই। আর আমি কিনা ক্লাশ বাদ দিয়ে এই রোদের মধ্যে শহীদ মিনারে বসে আছি।ওহ হো, আপনাদের তো বলাই হয় নি আমি এখানে বসে আছি সুতপার জন্য। অপেক্ষা করছি। সুতপা রিকশা থেকে নামবে, আমাকে দেখে একটু হেসে বলবে, "আজ ও ক্লাশ করলে না? আরে বাবা, আমাকে তো সারাদিনই দেখতে পাবে। ক্লাশ বাদ দিয়ে এভাবে বসে থাকা ঠিক না"। বলতে বলতেই সুতপা গম্ভীর হয়ে বলে উঠবে, "একটা আইস্ক্রীম নিয়ে আস তো"। "তোমার না গলা ব্যাথা"? আমি কথাটা বলার সাথে সাথেই সুতপা ব্যাগটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করে বলে উঠবে, "ডাক্তারি ফলাবে না। যেটা করতে বললাম কর"। ওহ , এই দেখেন আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন একটা বেজে গেল।বেশিরভাগ ব্যাচের থিওরির ক্লাশ শেষ। এখন ব্রেক। আবার আড়াইটা থেকে ল্যাব থাকে। ওই যে আমাদের ক্লাশের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে দুই একবার তাকাল। কিছু বলল হয়ত নিজেদের ভেতর। তাড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ ওদের ল্যাব আছে। ডাইনিং এ খেয়ে ল্যাব রিপোর্টের বাকি কাজ করবে হয়ত। আমার ও যাওয়া উচিৎ। নাহলে ডাইনিং মিস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কি করব বলুন, সুতপা যে এখনো এলো না। জানেন , সুতপার না অনেক ভুলো মন। মাঝে মাঝেই সে ক্লাশে আসার সময় এটা সেটা আনতে ভুলে যায়।আজ হয়ত দেখা করার সময়টাই ভুলে বসে আছে। যদিও আমি হলে থাকি তবুও প্রায় দুপুরে সুতপা আর আমি একসাথে খাই ক্যাফেতে। একটা টিউশনি আছে আমার,সুতরাং কিছু অতিরিক্ত টাকা গেলেও সমস্যা নেই। আর মাঝে মাঝে তো সুতপাই টাকা দেয়। কোনদিন হলের ক্যান্টিন থেকে শুটকি ভর্তা কিনে আনি সুতপার জন্য। ও খায় আর ঝালে মুখ হাঁ করে বারবার। আমার খুব হাসি পায়। কিন্তু হাসতে পারি না। সুতপা তাহলে রেগে যায়।
ইশ, একি বিকেল হয়ে আসছে যে। কি সর্বনাশ, আজ আমার ল্যাবে যাওয়া হয় নি। নির্ঘাত খুব ঝামেলা হবে পরদিন। কিন্তু সুতপা তো এখনো এলো না। জানেন, প্রায় দিন বিকেলে ল্যাব শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসতাম, সবার চোখ আড়াল করে সুতপা আমার হাতে খোঁচা দিত, একটু ছুঁয়ে দিত।ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এমন কর? উত্তরে বলেছিল, " বিকেলের শেষ আলোটা যখন মরে যেতে থাকে আমার ইচ্ছে করে তোমার হাতটা জড়িয়ে ধরে হাঁটতে। কিন্তু এখানে তো সেটা পারব না। তাই ওমন করি"। বলেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়েছিল ও। আমিও হাসছিলাম। যেদিন ল্যাব থাকত না সেদিন বিকেলে দুজন ঘুরতে বের হতাম। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতাম। রিকশায় চড়ে একই রাস্তা দিয়ে বার বার যেতাম। সন্ধ্যা মিলালে কোথাও বসে নাস্তা করা, এরপর দু'জনার নিজ নিজ হলে ফেরা। নয়টা না বাজতেই আবার সুতপার ফোন। "চা খেতে ইচ্ছে করছে, আস তো"। সেই চা খাওয়া রাত দশটাতেও শেষ হত না, যদি না দশটায় ওর হলের গেট বন্ধ হয়ে যেত। দেখুন, কত কত বক বক করছি কিন্তু সুতপা এখনো এলো না।কি যে এই মেয়েটা।
শেষ বিকেল। আলোটা কমে আসছে খুব আস্তে। ল্যাব শেষ করে ক্লান্ত পায়ে গল্প করতে করতে ভার্সিটির সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে কয়েকটা ছেলে। শহীদ মিনারটার পাশে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়ে রায়হান। অভি কে উদ্দেশ্য করে বলে , "দেখ , হাসান এখনো বসে আছে। এবার চল, রুমে নিয়ে যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পরেই"। "কিন্তু চেঁচামেচি করবে তো", অভি আস্তে আস্তে বলে। "করুক, সারাদিন তো এই চেঁচামেচির ভয়েই বসে থাকতে দিলাম। আর না, এখন নিয়ে যাই। কাল তো ওর বাবা মা আসবেই"। সপ্তাহ দুয়েক আগে সুতপা মারা যাওয়ার পরেই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল হাসান। গত কয়েকদিনে প্রায় বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই এই জায়গা ছেড়ে উঠতে চায় না, সুতপার জন্য অপেক্ষা করে। মাঝ রাতেও এখানে চলে আসে। রুমে তালা লাগিয়ে ঘুমিয়েছে ওর বন্ধুরা কয়েকদিন। কাল ওর বাবা মা এসে নিয়ে যাবে।
কি ব্যাপার, রায়হান আর অভি এদিকে আসছে কেন? আমি এখন সুতপার জন্য অপেক্ষা করছি। ওদের সাথে যাব না আমি। কাছে এসে রায়হান বলে, "হাসান ওঠ, যাবি এখন"। আমি মাথা নাড়িয়ে না বলি। অন্য দিকে তাকাই। এক দিকে অভি আর অন্য দিকে রায়হান চেপে ধরে হাসানকে। "এই তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? সুতপা আসবে তো। একি আপনারা কিছু বলছেন না কেন? কি হল? ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে , কিছু বলুন প্লিজ। সুতপা এসে আমাকে খুঁজবে তো......প্লিজ......."
।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৪