নীল ১
বছর দেড়েক থেকেই ডাক আসছিল হাওড়-বাওড়ের দেশ থেকে, ঘুরে আসার জন্যে। সময় এবং যথার্থ সংগী উভয়ের অভাবে বার বার সে ডাক ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। ইদানীং যখন মাথায় ভূত চাপল- অনেক তো বাইরে বাইরে ঘুরলাম, কিছুদিন না হয় একটু ঘরে থাকি; সেই মুহূর্তেই পুরনো ডাক নতুন করে আসায় সংগী বা সময়ের তোয়াক্কা না করে একা যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছুট লাগালাম; তবে শেষ মুহূর্তে বর দান করলাম আমার কুট্টুস বড় ভাগ্নেটাকে, সাথে নিলাম।
যাওয়ার গপ্প শুরু করার আগে ডাক কোত্থেকে এসেছিল সেই গল্প একটু বলি, প্লিজ বোর হয়ে চলে যাবেন না কিন্তু। ডাকটা মূলত যার কাছ থেকে এসেছিল তিনি আমায় ছোটবেলায় অঙ্ক করাতেন। প্রতি সন্ধ্যাতেই লোডশেডিং তখন সাধারণ ঘটনা হওয়ায় ছোট্ট টেবিলটাকে আমি আর স্যার দুজন ধরাধরি করে নিয়ে যেতাম উঠোনে। মাথার উপরে বিশাল তারাভরা আকাশ আর তার নীচে হারিকেনের আলোয় দরদর করে ঘামতে ঘামতে অঙ্ক করছে অষ্টমশ্রেণীতে পড়া একটা মেয়ে আর তার গৃহশিক্ষক তাকে হাতপাখায় বাতাস করছে- এই দৃশ্যটা মনের পর্দায় গেঁথে গিয়েছে আমার। ভাবলে এখনো হাসি পায় গণিতের কোন জটিল সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষক উপরের দিকে তাকিয়ে সমাধান খুঁজছে আর সাথে সাথে সেই মেয়েটিও ভাবছে অঙ্কের সমাধান কী লুকানো আছে নাকি আকাশের তারার মাঝে! মনে প্রাণে দোয়া করতাম যেন কোন অঙ্কে ঝামেলায় না পড়ি, নইলে যে স্যার সেই সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত হলে হাতপাখাটাকে চক্ষুলজ্জায় তুলে নিতে হবে যা আমার বড়ই অপছন্দের ছিল।
যাই হোক, ভ্রাতৃতুল্য না বলে বলতে চাই আমার সেই ভাই এখন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, গত দুই বছর থেকে পোস্টেড সিলেটের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাম আজমিরীগঞ্জ। ভাবী আর আড়াই বছরের ভাতিজাকে নিয়ে ওখানেই থাকেন। আর ওখানেই কোন এক কেসে তার পরিচয় আমার ফুপি আর ফুপার সাথে, দুর্গম এলাকায় বাস বলে যাদের বাড়ী আমি কখনোই যাই নি। আমার ফুপাই হলো সেই কালপ্রিট যার কারণে আমাদের ছোট্ট ফুপিকে সবাইকে ছেড়ে যেতে হলো সেই পানির দেশে। কথিত আছে, আমার চাচা যেতেন সেই উত্তরে বাণিজ্য করতে, আমাদের দাদাবাড়ীর বাগানে ফলা হাজার ফলমূল নিয়ে। সেই দূরদেশে গিয়ে ফুপার সাথে দোস্তি যার সুবাদে দোস্তের আগমন আমার দাদাবাড়ীতে। শুনতে পাই, ফুপা যেদিন প্রথম আসে দাদাবাড়ী মানুষের সাড়াশব্দ না পেয়ে বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দেন বাড়ীর ভিতরে আর তাতেই সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যায়- তরুণী ফুপি সেই মুহূর্তে স্নান সেরে সিক্ত কেশ থেকে জল ঝরাচ্ছিলেন উঠোনে দাঁড়িয়ে। যাই হোক তার পরের ঘটনা হল সকলের তীব্র আপত্তিকে পরাজিত করে প্রথম দর্শনে প্রেমের জয় হয়ে ফুপি এখন সেই বাড়ীতে যেখান থেকে বর্ষায় চারদিকে তাকালে কেবল উথাল-পাথাল পানি!
অনেক শানে নুযুল হলো, এবার আসল কথায় আসি নইলে যে কে আবার মাইনাস দিয়ে দিবে! আজমিরীগঞ্জ যাওয়ার নিমন্ত্রণটা তাই স্যার বদলী হওয়ার আগেই গ্রহণ করে ফেললাম, প্রথমে যাব ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের বাসায় সেখান থেকে তার পুরো পরিবারসহ আরো ভিতরে পিটুয়ারকান্দীতে যাব বেড়াতে আমার ফুপির বাড়ী। যাওয়ার আগে অনেকে আমাকে হাওড়ের ডাকাতের ভয়ও দেখিয়েছে, তাই বলে ডাকাতে ডরায় না মিশু বলে যাত্রা শুরু করে দিলাম। সারারাত না ঘুমিয়ে (ব্লগীং করে) সকালে হবিগঞ্জের বাসের একদম প্রথম ট্রিপ ধরে ভিতরে বসেই ভাগ্নেকে 'গুড নাইট' জানিয়ে নিদ্রা দেবীকে আপন করে নিলাম। ঘুম ভাঙ্গল এক্কেবারে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এসে যখন আর জানালার বাইরে থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না- প্রকৃতি এত রূপ নিয়ে বসে আছে!
সোনালী স্বপ্ন ১
সোনালী স্বপ্ন ২
আমরা একসাথে
কত খাইবা খাও
জীবনের ভারবহনে ক্লান্ত (হবিগঞ্জ নৌঘাটের কাছে)
একা
একা নয়, অনেকে
সংশয়
খুব ভেবেছিলাম দুর্গম এলাকায় একটু এডভেঞ্চার করতে করতে যাব, তা আর হলো না ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পাইক-পেয়াদাদের জালায়; বাস স্টপ থেকে তারা এনে তুলে দিয়ে গেল আজমিরিগঞ্জগামী নৌকায়। নৌকার ছই এর চালে বসে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দুপুর বারোটার কড়া রোদে তাকে বিসর্জন দিয়ে ভিতরেই থাকলাম, কিন্তু নৌকার ভিতর থেকেও খোলা জানালায় বাইরেটা দেখতে অনেক ভালো লাগছিল- মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম হাওড়ের রূপ; ক্যামেরার সাটার চালালেও ১৮-৫৫ এ বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ক্ষান্ত দিয়ে মনের লেন্সে বন্দী করতেই বেশী মনোযোগী হলাম। মাঝপথে এক জায়গায় এসে মাছ ধরার সুন্দর এক মুহূর্তে ক্লিক করতে গিয়ে দেখি ব্যাটারী নেই, এর একদিন আগে ব্লগীয় ফটোওয়াকে ক্যামেরা চালানোর পর ওই বেচারাকে আর চার্জ দেওয়া হয় নি।
স্পীড/ বেগ
পেছনটাকে পেছনে ফেলে চলা
আলোড়ন
চাওয়া ১
চাওয়া ২
পাক্কা তিন ঘন্টা হাওড় ভ্রমণের পর চারটার দিকে আমরা পৌঁছুলাম আজমিরীগঞ্জ ঘাটে, যেখানেও প্রতীক্ষিত ছিলেন পাইক-পেয়াদারা। সেখান থেকে রিকশায় আমরা পৌঁছুলাম ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাসায় যিনি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের প্রতীক্ষায়। পাঠকগণকে বলি যে পথে আমরা নৌকায় আসলাম বর্ষা বাদে অন্য মৌসুমে তা খটখটে শুকনো থাকে আর যানবাহন বলতে থাকে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অমূল্য পদযুগল আর মাঝে মাঝে চান্দের গাড়ীর মতো কিছু জীপ যেখানে চড়লে তার ছাদে ক্ষণিক পরে ঠুয়া খেতে খেতে মগজমশাইয়ের অক্কা পাওয়ার দশা হয়!!
(চলবে! মিছিমিছি লম্বা করার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী!)
পরের পর্বে থাকছে-
বাসার সামনের পুকুর, তার ওপারে বিল
সাঁঝের আলো
আমাদের জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের স্বহস্তে বরশি দিয়ে মাছ ধরন ও কর্তন চান্দের আলোয়
রাতে পূজা পরিদর্শন
এবং আরো অনেক কিছু।
আমার সাথেই থাকুন।