১।
বিকালের প্যাতপ্যাতা হাওয়ায় উড়ে উড়ে রিকসায় ফিরছিলো সে।
ঘাম শুকানোর ঠান্ডা আর্দ্রতাসহ উড়ে উড়ে।
তার ভাবনা জুড়ে বিষাদের পূর্ণসন্তুষ্টি।
এই তৃতীয় বিশ্বের ঘিন্জি ঘুপচির একটা দেশে যেখানে চোখ কোথাও দূর সীমানায় না আটকে লেটকে যায় পটকে যায় থ্যাবড়া ঢালু দেয়ালে অথবা মানুষের সংকরজাত চেহারা আর দুলুদুলু কী চিমসে ধরা শইলে; সেখানে আজও রিকসা একটি ডেটিং প্লেস হিসেবে বিবেচিত হয়।
শাদা টেকো বুড়া লোকটার রিকসাকে কেউ পেছন থেকে ধাক্কা মারে।
আলসেমি আয়েশে পা চেগিয়ে বসায় তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় কি না দ্যাখা যায় না, কিন্তু বোঝা গেলো কোথাও গরমিল হয়েছে।
তার ধোন খাড়া রিকসাঅলাও ইতিউতি চোখ চালায়।
বাংলা সিনেমার রংচঙা পোস্টার আর পথচারী মেয়েদের দুলুনি ছাড়া অবশ্য অন্য কিছুতে সে তাকাবার অবকাশ বোধ করে না।
তাই সে নিজেই কারণ খুঁজতে শুরু করে।
বিকেলের মতই ছিলো শুরুতে এখন তা হঠাৎ করেই ভীতিকর
সন্ধ্যায় রূপ নিয়েছে।
এবং সবাই চুপ।
নিঃশব্দে কথা হলো বিদ্যুত চলে গেছে, এ যেন পরকীয়া আসক্ত প্রণয়ীর গমন, প্রত্যাবর্তনহীন।
এমন কি ভীষণ অনীহায় মার্কেটের কামলাগুলা জেনারেটর চালালো না, থাম্বা ফ্লাটবাড়িগুলায় হাঁপানো দারোয়ানটা আইপিএস চালু করলো না।
যেন এটা অনিবার্য ছিলো একদিন সব আলো সব শক্তি আত্মহত্যা করবে।
দ্রুত অন্ধকার হওয়ায় তাকে মোটামোচ রিকসাঅলা বাসস্টপে নামিয়ে ছুট লাগালো।
কোনো বাড়িতে আলো নেই, কোনো দোকান আলো জ্বালেনি; যেন জ্বালাতেই ফুরিয়ে যাবার ভয়।
খুপড়ি হোটেলে আজ মোগলাই ভাজার গন্ধ নেই। পেট্রল তেলে অনেক দিন রান্নার পর আজ ছুটি।
সব বাস শেষ ট্রিপে নামিয়ে দিচ্ছে প্যাসেন্জারদের।
আজ এখানের সমস্ত শক্তির শেষ হলো।
২.
হাতড়ে পাতড়ে সে পৌছালো বাড়িতে গন্ধ শুঁকে শুঁকে ।
সকালের কাক পোড়ার গন্ধে।
কেউ দরজা খুলতে চাইছিলো না, আসন্ন ডাকাতির আশংকায়।
তারপর মা নামাজ শেষে দরজা খুলল।
-তর সটু বোইন ত ফিরলো না রে!
সে জানত বোন টিকবে না এই বৈরী অন্ধকারে, তবে শুরুতেই হারাবে ভাবে নি।
তারপর মাও আর উচ্চবাচ্য করল না।
-খাওন কী আসে মা?
কাইলকার তরকারি ছারা আর কিসু নাই?
-যা আসে তাই দিয়া খায়া লা।
খেতে খেতে সে দ্রুত ঠিক করে পালানোর কথা।
এ শহর টিকবে মাত্র আর দশ বারো ঘন্টা।
মোবাইল নেটওয়ার্ক নষ্ট, কাজ করছে না ওয়ারলেস নেট, এখানের সমস্ত শক্তির পতন ঘটায়।
মিটমিটে মোমবাতির আলোতে সে মাকে দ্যাখে।
কাছে এসে টের পায় মৃত।
এমন কী বাতাসই মৃত ।
শুধু মৃত্যুর তৃপ্তি বয়ে আনে।
দরজার খুটখুট শব্দে তার কল্পনা ভাঙে।
অন্ধকারে তিরিশ বছরের বাড়িওয়ালি আড় সুপ্ত সাধ পূরণ করতে আসায় সে ভাবে হয়ত আবার আলো ফিরে আসবে, সামনের মাসে ভাড়া বাড়বে না শুধু এই সন্ধ্যাকালীন ব্যাভিচারের খাতিরে।
না, বাড়িওয়ালি জানালো সে মেইন গেট তালা দিয়ে দেবে।
সে বলল না তরুণী বোন ঘরে ফিরে নি।
৩.
মৃতলাশ মাকে পাশের ঘরে রেখে সে ব্যাগ গুছালো।
আর কোনো যন্ত্র চলবে না এরপর। অনেকেই এ খবর জানে না, তাই বাইসাইকেল আর পাম্পার চুরির শেষ সময়সীমা এ রাত।
চলে যেতে হবে পিচে মোড়ানো এই শহর ছেড়ে। মাকে কবর দেবার জায়গাও পাওয়া গেলো না।
অবশ্য রাস্তায় এতক্ষণে দূর্বৃত্তরা দাপটের টহল দিচ্ছে।
বেশ্যারাও জীবনের ঝুঁকি নেবে না আজ।
পড়ে আছে বিলবোর্ডের দেঁতো হাসির মডেলরা।
আর তরুণী বোন কোথাও ধর্ষিত হয়ে কুঁকড়ে আছে। তাই শেষ আশ্রয় নিজেকে সে জীবিত থাকার জন্য প্রস্তুত করলো।
শহুরে নরখাদকরা রাস্তায় উপচে পড়েছে কি না খবর জানা গেলো না।
অতিদ্রুত পলায়ন প্রয়োজন।
ব্যাগ সহ দরজা পেরোতেই বুঝলো বাতাসেও পৌছেঁছে হলদে কালচে মৃত্যুর গন্ধ যার আঘাতে তিরিশের বাড়িওলি সিঁড়িতে মরে লেটকে আছে।
হয়ত রাজনীতিবিদদের এসিগুলোর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত বাতাস।
৪.
সেই বাতাসকে উপেক্ষা করে সে চুরি করলো চিকনা মৌলভির লাল সাইকেলটা। সাইকেল নিয়ে ভেসে ভেসে গেলো লাশ আর লাশখেকোদের পাশ কাটিয়ে পরিত্যাক্ত মাঠে।
ঘাস খোড়া মাটিতে সে শুয়ে দম নিলো এতটুকু।
তারপর ক্লান্তি।
ঘুম।
ঘুম শেষে সে তাকালো।
তবে নড়বার অনুমতি নেই।
পলকহীন তাকিয়ে থাকার ক্লান্তি আর,
ভেতরে জমাট বাঁধা রক্ত ও শ্বাস নেবার দমবন্ধ তৃষ্ণা।
আর লাল পিঁপড়ার মাংস খাবার উৎসব।
সে মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কালো নীল আকাশের দিকে মুখ করে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় আর্ত মৃত কান্নায়।
চির জাগরণে,
তার মৃত্যুতে।
পুনশ্চ: তখন রাত পৌনে দশটা যখন বাতি ফিরে এলো, চোখে আলো লাগায় ঘুমন্ত মা জেগে দেখলো মেয়েটা প্রণয়ী নিয়ে ঘরে ফিরেছে;
ছেলেটার খোঁজ নেই।