ডুবে যাচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি। এই পড়ে যাওয়ার শেষ নেই, ডুবে যাওয়ার গভীরতা অপরিমেয়। এই হারিয়ে যাওয়ায় খুঁজে ফিরে লাভ নেই। অসংখ্য হাত আমার দিকে বাড়ানো, তার মাঝে মমতা যেমন আছে। আছে হয়তো স্বার্থপরতাও। তবে আমার অবিশ্বস্ত মন এই হাতগুলোকে সাহায্যের মমতা মেশানোর বদলে ভয়ঙ্কর ভালোবাসাহীন নিষ্ঠুর কিছু একটা হিসাবে উপস্থাপন করে চলেছে প্রতিমুহুর্ত। হাতগুলো যেনো আমার ডুবে যাওয়া ঠেকানোর জন্য নয় বরঞ্চ আমিই হাত থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছি, ডুবে যেতে চাচ্ছি, হারিয়ে যেতে চাচ্ছি পরম শূণ্যে। যেখানে কিছু নেই, কিছু থাকে না, কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু কখনো কখনো সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে যে আমাকে আমার ছোট্ট কক্ষটির অচেনা যায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। এই আশ্রয়টাও আমার কাছে আশ্রয়হীন মনে হয়। কারন ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে মনে হয় আমার কাছে, আমার প্রিয় ছোট্ট কক্ষটি। স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না আমার প্রিয় পুতুল গুলোর, ছুড়ে ফেলে দিতে হচ্ছে অবসরের আশ্রয় বইগুলোকে। নিতান্ত স্বল্প স্থানে নিজেকে ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুই বড়ই বেমানান লাগছে। সবচেয়ে বেমানান লাগছে নিজেকে। এত বিশাল পৃথিবীকে এখন ছোট্ট খেলনা মনে হচ্ছে নিজের কাছে। যেটা মনের আনন্দের উপকরনের চেয়ে ভয়ঙ্করের প্রতিমূর্তি হিসাবে বার বার দেখা দিচ্ছে আমার ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র হতে চলা মনটার কাছে।
এমন ছিলোনা আমার পৃথিবী একটা সময়। বিশাল পৃথিবীকে বিশালতর মনে হত নিজের জন্য। এতেই আনন্দিত ছিলাম কখনোবা যথকিঞ্চিত মনে হত নিজের জীবনকে। হাসি খেলায় মেতে উঠতাম। নিজের ছোট্ট রুমটাকেও অসম্ভব বড় মনে হত। দুনিয়ার সবকিছুর স্থান দিতে পারবো বলে মনে হতো। দিয়েও ছিলাম। পুতুলগুলো সঙ্গী করে, খেলনাগুলো কখনোবা অস্ত্র কখনোবা চলার পথের পাথেয় করে রহস্যময় দ্বীপের খুঁজে ছুটতাম, কখনোবা গুপ্তধজন আবিস্কারের নেশায় বুদ হয়ে থাকতাম, রাতে ভুতের ভয় আবার সেই ভয়কে জয় করার নায়ক হয়ে উঠতাম। কখনোবা বীরের বেশে নিদ্রায় চলে যেতাম কখনো বা আশ্রয় নিতাম বিশ্বাসের জানালায় অবস্থানকৃত মমতার কাছে। মমতাগুলোও আশ্রয় দিত পরম ভালোবাসায়। এইগুলোই আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলো, ভালোবাসতে শিখিয়েছিলো, বুঝতে শিখিয়েছিলো, কিভাবে বিশ্বাস করে ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। কিভাবে বিশ্বাসের জানালায় প্রসারিত করতে হয়, কিভাবে প্রশ্রয় দিতে হয় ভালোবাসাহীন বস্তুকেও। তাই বন্ধু তালিকায় যেমন ছিলো নানা রঙের প্রজাপতি, তেমনি ছিলো অবিশুদ্ধতার প্রতিক গুবরে পোকাও। যেমন ছিলো কোকিল শ্যামা তেমনি ছিলো লোভাতুর তীক্ষ্ণ চক্ষুর শকুনো।সবাই আমার বন্ধু ছিলো, ছিলো বিশ্বাসের জানালা। তাদের চোখেই বিশ্ব ধরা দিত আমার চোখে। তাদের সুখেই দিন কাটতো সুখে, রাত হতো স্বপ্নের বাগিচায় ফুটে উঠা অসংখ্য তারাদের আলোকমালার উজ্জল্যে। হয়তো পেতে চেয়েছিলাম আরো কিছু কিংবা বেড়ে গিয়েছিলো বিশ্বাসের পরিধি। তাই নিজের বিশ্বাস অন্যের হাতে জমা দিয়ে হতে চেয়েছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ, উড়তে চেয়েছিলাম তাদের মত করে। ভুলটা ছিলো সেটাই, অন্যের বিচরন জগতে উড়তে দেখে তীক্ষ্ণ চঞ্চু নিয়ে ছুটে এসছিলো সেই জগতের বাসিন্দারা অযাচিত প্রবেশকারী হিসাবে আমার দিকে। অথবা বিনোদনের খোরাক হিসাবে। ক্ষত বিক্ষত আমি পড়ে গিয়েছিলাম মুক্ত আকশ হতে কোনো এক বিরান ভূমিতে, ভেবেছিলাম এইখানের ঘাসফড়িংগুলো হয়তো আমার বন্ধুতা অস্বীকার করবে না, হয়তোবা পরম মমতায় আমার ক্ষতে প্রলেপ দেবে। আবার আমি ছুটতে পারবো পুরোনো আমি হয়েই। তবে ঘাসফড়িং আসার পূর্বেই ছুটে এসেছিলো হিস হিস শব্দে শীতল স্রোত নিয়ে বিষময় করে দিতে আমাকে বিষন্ন কোনো সাপ। বিষে বিষন্নতার চাদরে মোড়া আমার উঠে দাঁড়ানোর জন্য দরকার ছিলো শক্তি। ভেবেছিলাম পরম বন্ধু সূর্য, উড়তে থাকা প্রজাপতি আমায় সাহায্য করবে কিন্তু না ঘণ আঁধারে মুড়ে থাকা সূর্য আসতে অস্বীকার করেছিলো, অস্বীকার করেছিলো মিষ্টি প্রজাপতিও তাদের জীবনের উপভোগ্য সময় অপচয়ের। নিজের প্রতি বিশ্বাসটাকে হারিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম অন্যের বিশ্বাসে শক্তি সঞ্চয় করতে। বার বার ফেরত এসেছি, আমার মত বোকা কেউ নয়। তারা তাদের বিশ্বাসের অংশীদার করতে রাজি হলেও মালিকানা হস্তান্তরে রাজি ছিলো না।
বিশ্বাসহীন আমি বিশ্বস্ততার মাঝেও অবিশ্বস্ততার কালো ছায়া খুঁজে পাই। তাই বিশ্বাস করতে যাইনা আর কাউকে কিংবা পারিনা। যেখানে নিজের বিশ্বাসকেই হারিয়ে ফেলেছি সেখানে অন্যের বিশ্বাসকে কিভাবে বিশ্বাস করি। বিশ্বাসটা হারিয়ে এখন আমি আমার ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসা কক্ষটির সঙ্কীর্ণ কোনটা বেছে নিয়েছি কিংবা নিতে হয়েছে চরম অনিচ্ছায়। মাঝে মাঝে তীব্র শীৎকারে চিৎকার করে উঠি। ভাবি আমি বুঝি ইসরাফিলের শিঙ্গাটা পেয়েছি, আমার ফুৎকারে উড়ে যাবে ধ্বসে যাবে সবকিছু। এক একে বিচ্ছিন্ন হতে থাকবে খুবি কাছাকাছি আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। ধূলা হয়ে মিশে যাবে সবকিছু। আমি সেই ধ্বসে যাওয়া দেখবো পরম মমতায় যার মাঝে মমতার চেয়ে ক্রুরতা থাকবে বেশি, দেখবো বাতসের সাথে মিলিয়ে যাওয়া ভস্মের মত করে বেঁচে থাকা বিশ্বাসের পান্ডুলিপি। সব কিছু শূন্য হয়ে যাবে। আবার জন্ম নেবে সবুজ ঘাস, নীল আকাশ, ফিরে পাব আমার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস।
উৎসর্গঃ আমার এক বন্ধুকে। যাকে দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় সে হয়তো নিজেকে বিশ্বাস করার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছে।